সিলেট ৩০শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৭শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ৮:০২ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৬, ২০১৭
ভারতের গোয়ায় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব হচ্ছে। ওই উৎসব থেকে তথ্য মন্ত্রণালয় দুটো ছবিকে বাদ দিয়েছে। ছবি দুটোর নাম সেক্সি দুর্গা আর ন্যুড। চিত্রকরদের মডেলদের নিয়ে তৈরি ছবির নাম ন্যুড হতেই পারে। এই ন্যুড নামটি নিয়েই সম্ভবত আপত্তি। মাঝে মাঝে অবাক হই খাজুরাহো আর ইলোরা অজন্তার অমূল্য শিল্পকর্মের জন্য ভারত সরকার কি গর্ববোধ করে না? শিল্পকর্ম নিয়ে গর্ববোধ না করা মানে ভারত নিয়ে গর্ববোধ না করা। ‘সেক্সি দুর্গা’ দেবি দুর্গার গল্প নয়। মেয়েদের নামের জন্য দুর্গা খুব জনপ্রিয় নাম। কোনও এক দুর্গার কাহিনী নিয়ে তৈরি এই ছবিটি সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পেলেও সরকারের ছাড়পত্র পায়নি। পরিচালক সেক্সি দুর্গার নাম বদলে এস দুর্গা করে দিলেন, তাতেও কাজ হয়নি। সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী ছবির মূল চরিত্রে ছিল কিশোরী দুর্গা। দুর্গা তো পুঁতির মালা চুরি করেছিল, তাতে কি কেউ অভিযোগ করেছে, দুর্গা নামের মেয়ে কেন চুরি করবে, এ দেবি দুর্গাকে অপমান! কেউ অভিযোগ করেছে বলে শুনিনি, তবে কী হয়েছে আজকাল ভারত বর্ষের! একই রকম দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, রাধা, কৃষ্ণ, রাম, অর্জুন, বিষ্ণু, পার্বতী, শিব নামের কাউকে নিয়ে কি ছবি হতে পারবে না, যেহেতু নামগুলো ভগবানের নাম? কিন্তু ওরা তো ভগবান নয়।
আসলে যে কোনও নামের যে কোনও মানুষকে নিয়েই ছবি হতে পারে। এমনকি ভগবান ইত্যাদি নিয়েও ছবি হতে পারে। কিন্তু শিল্পীর স্বাধীনতায় যারা বিশ্বাস করে না, তারা চায় শিল্পীর হাতের ক্যামেরা কেড়ে নিতে, তুলি মুচড়ে দিতে, তারা লেখকের কলম চায় বন্ধ করতে। তারা চায় না ওদের মতো করে ওরা কথা বলুক। চায় শাসকদের খুশি করে চলুক। চায় দেশের প্রতিটি মানুষ তুষ্ট থাকুক। সবাইকে তুষ্ট করে চলা, খুশি রাখা কোনও সচেতন শিল্পীর পক্ষে সম্ভব নয়। দেশে দাঙ্গা লাগতে পারে এই অজুহাতে শিল্পীর মত-প্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করা হয়, বিশেষ করে ভারতবর্ষে। দেশে মুসলিম মৌলবাদীরা তাণ্ডব করতে পারে, এই অজুহাতে বাক স্বাধীনতাকে খর্ব করেছে বাংলাদেশ। দাঙ্গা বা তাণ্ডব যদি করেও কোনও গোষ্ঠী, সেসব দমন করার শক্তি যদি সরকারের না থাকে, তবে কাজটা কী সরকারের? জনগণকে নিরাপত্তা দেবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েই তো তারা সরকার গঠন করেছে।
ধর্মান্ধতা, রক্ষণশীলতা, কূপমণ্ডূকতা কোনও সমাজের জন্য ভালো নয় জেনেও শাসকেরা বারবার ওসবকে প্রশ্রয় দেন। জেনেশুনে সমাজকে অন্ধকূপে ফেলে রাখতে চান। আসলেই কি দাঙ্গা তাণ্ডব ইত্যাদির ভয়? নাকি শাসকদের মধ্যেই আছে ধর্মান্ধতা, রক্ষণশীলতা আর কূপমণ্ডূকতা? আমার তো মনে হয় শাসকরাই অনাধুনিক! শাসকরাই হাজার বছর আগের কুসংস্কার আঁকড়ে পড়ে আছেন।
সমাজ ঠিক যে অবস্থায় আছে, সে অবস্থায় রেখে দেওয়া কোনও প্রগতিশীল নেতার স্বপ্ন হতে পারে না। সমতার সমাজ তৈরি করতে না পারলে সমাজের জন্য সত্যিকার কিছু করা হয় না। অসাম্য, বৈষম্য যেমন কমাতে হবে, মত-প্রকাশের অধিকার তেমনি সম্পূর্ণই দিতে হবে। সরকারের কাজ শোষণ করা নয়, শাসন করাও নয়, সরকারের কাজ সেবা করা। মানুষের সেবা করতে হবে, মানুষের কথা বলার স্বাধীনতাকে সম্মান করতে হবে, মানুষের ভিন্ন মত-প্রকাশ করার অধিকারকে মূল্য দিতে হবে।
আমাকে বাংলাদেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল এবং গত ২৪ বছরে আমাকে দেশে ফিরতে দেয়নি বাংলাদেশ সরকার। কারণটা দেখিয়েছিল, ধর্মীয় মৌলবাদীরা যেহেতু আমার বিরুদ্ধে, আমি দেশে থাকলে ওরা তাণ্ডব করবে, ফাঁসির দাবি তুলবে। সুতরাং ঝামেলার দরকার কি? আমি বের হয়ে গেলেই ঝামেলা চুকে যায়। আমাকে দেশ থেকে বের করে দিয়ে ‘সমস্যার সমাধান’ করেছিল বাংলাদেশ সরকার। মূল সমস্যা কিন্তু থেকেই গেছে। মূল সমস্যা নারীবিদ্বেষী, গণতন্ত্রবিরোধী, প্রগতিবিরোধী, ভিন্নমতবিরোধী, মুক্তচিন্তাবিরোধী এক ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর উত্থান। এই গোষ্ঠীকে দমন না করে বরং এই গোষ্ঠীর সঙ্গে সব সরকারই আপস করে চলেছে। আপস করতে করতে এদের সন্ত্রাসী বানিয়েছে, যে সন্ত্রাসী যে কোনও সময় টুঁটি টিপে ধরতে পারে দেশের সামান্য যেটুকু গণতন্ত্র অবশিষ্ট আছে, সেটুকুর। একবার আপস করলে আপস করেই যেতে হয়। আপস করাই অভ্যেস হয়ে যায়। ভারতবর্ষেও আমাকে যারা হুমকি দিয়েছে, আমার মুণ্ডুর দাম ধার্য করেছে, আমাকে শারীরিক আক্রমণ করেছে, তাদের শাস্তি হলো না, শাস্তি হলো আমার। অত্যাচারীর শাস্তি হয় না, শাস্তি হয় অত্যাচারিতের। সত্যের শাস্তি হয়, মিথ্যের নয়। সত্য কথা লিখেছি বলে বই নিষিদ্ধ হয়ে গেল। আমাকে শুধু রাজ্য নয়, ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে হলো। দেশের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের শাসকরা ধর্মান্ধদের পক্ষ নিয়েছেন, আমার পক্ষ নয়। যে আমি সমাজকে বদলাতে চাই, সুস্থ সুন্দর সমতার সমাজের স্বপ্ন দেখি, সেই আমাকে করা হলো নির্বাসিত। আমি আমার জীবন দিয়ে বুঝি বাক-স্বাধীনতার মূল্য। আমি আমার জীবন দিয়ে বুঝি শাসকরা একবার লেখক-শিল্পীর স্বাধীনতায় বাধা হয়ে দাঁড়ালে চিরকাল বাধা হয়েই তাদের দাঁড়াতে হয়, কারণ ধর্মান্ধ কূপমণ্ডূকেরা তখন তাদের ঘাড়ের ওপর চড়ে নৃত্য করে। একের পর এক তাঁদের তখন নিষিদ্ধ করতে হয় নাটক, চলচ্চিত্র, বই, ম্যাগাজিন, চিত্রকলা, ভাস্কর্য। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের পক্ষে না থেকে সরকার পক্ষ নেয় অশুভশক্তির। জেনে বুঝে দেশটাকে নষ্ট করা ছাড়া আর কী!
কে বলবে ভারতে মুক্তবুদ্ধির চর্চা হয়? মানুষ তো জেনে গেছে দুটো ছবিকে চলচ্চিত্র উৎসব থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ছবি দুটো ধারণ করার শক্তি কেন হবে না এত বড় ভারতবর্ষের? সুজয় ঘোষ পদত্যাগ করেছেন উৎসবের জুরির পদ থেকে। আর জুরি যাঁরা আছেন, সবারই পদত্যাগ করা উচিত। সরকার যেন বাধ্য হয় ছবি দুটোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে, যেন বাধ্য হয় ছবিগুলোকে উৎসবে ফেরত দিতে। যদি চুপচাপ এভাবেই ঘটে যেতে থাকে নিষেধাজ্ঞা, মত-প্রকাশের অধিকার লঙ্ঘন, তবে এভাবে আরও ঘটবে। মানুষ প্রতিবাদ না করলে আরও বই, আরও শিল্পকর্ম, আরও সিনেমা নিষিদ্ধ হবে। নিষেধাজ্ঞা সংক্রামক। ঠিক ধর্মান্ধতার মতোই সংক্রামক। সরকারের উচিত জনগণের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, আধুনিকতা, প্রগতিশীলতা ইত্যাদির স্বার্থে ন্যুড এবং সেক্সি দুর্গার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া।
লেখক: নির্বাসিত লেখিকা।
সুত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd