সিলেট ৩০শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৭শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ৩:৫০ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৭
নিজস্ব প্রতিনিধি : সিলেটের জালালাবাদ হোমিও কলেজের অনিয়ম দুর্নীতি স্বজনপ্রীতির তদন্ত শুরু হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে কলেজ ক্যাম্পাসে স্থানীয় সরকার সিলেটের উপপরিচালক দেবজিৎ সিংহ তদন্ত কাজ শুরু করেন। তদন্ত কর্মকর্তা সিলেট জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সিএ নুরুল মুত্তাকিনকে তদন্তের স্বার্থে কলেজের সকল কাগজাদি পর্যালোচনার জন্য কলেজ থেকে নিয়ে তদন্ত টিমের কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দিয়েছেন। সাথে সাথে কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপালকে তদন্তের স্বার্থে সব ধরণের সহযোগিতা করার আদেশ করেছেন।
কলেজ সূত্রে জানা যায়, কলেজের শিক্ষক ডা. মো. নামর আলী এবং ডা. নুরুন্নাহার মজুমদারের অভিযোগের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার সিলেটের উপপরিচালক এই তদন্ত কাজ শুরু করেছেন। কলেজ সূত্রে আরো জানা যায়, শিক্ষকদ্বয় তাদের অভিযোগে উল্লেখ করেন, পরিবারতন্ত্রের আবর্তে নিমজ্জিত: হোমিও চিকিৎসা বিজ্ঞানে সিলেট বিভাগের একমাত্র সরকারী স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান জালালাবাদ হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজ আজ পরিবারতন্ত্রে আবদ্ধ, কলেজ প্রতিষ্ঠাতার পরিবারই সর্বেসর্বা। অথচ প্রতিষ্ঠার ৫৩ বছরেও আধুনিকায়ন হয়নি এ প্রতিষ্ঠানটি। নেই স্থায়ী ক্যাম্পাস, অর্পিত সম্পত্তি একসনা বন্দোবস্ত নিয়ে চলছে প্রতিষ্ঠানটি। জরাজীর্ণ একচালা ঘরেই চলছে কার্যক্রম। এখনো বৃষ্টি হলেই পানি পড়ে। জীর্ণশীর্ণ ক্লাস রুমেই পাঠদান নিচ্ছে প্রায় ১১’শ শিক্ষার্থী। প্রায় ২ বছর ধরে কলেজ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে জেলা প্রশাসন। এর পূর্বে ১৮৬০ সালের সোসাইটি এ্যাক্টে নিবন্ধিত পরিচালনা কমিটি দ্বারা পরিচালিত হত। অভিযোগ উঠেছে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দূর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠানটি ঝিমিয়ে আছে। নগরীর মির্জাজাঙ্গালে ১৯৬৩ সনে মরহুম ডা: হোসেন রাজা চৌধুরী ফারুকী জালালাবাদ হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় সাড়ে ১২ ডিসিমেল ভাড়াটে ভূমিতে অবস্থিত এ প্রতিষ্ঠানটি আজো পায়নি স্থায়ী ক্যাম্পাস। ২০০১ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী মৃত্যুবরণ করেন ডা: হোসেন রাজা চৌধুরী ফারুকী। প্রতিষ্টাতার মৃত্যুর পর অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান ডা: এম.বি খাঁন। ২০১১ সালে অবসরে যান ডা: এম.বি খাঁন। ঐ বছরই অধ্যক্ষের দায়িত্ব সুকৌশলে দখল করেন প্রতিষ্ঠাতার বড় ছেলে ডা: আব্দুল্লাহ ফারুকী চৌধুরী। তার অনুস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন কলেজের আরেক সাবেক অধ্যক্ষ ডা: এম.বি খানের পুত্র ডা: মুজাহিদ খান। কলেজটি বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথি বোডের্র অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। সরেজমিনে জালালাবাদ হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজে গিয়ে দেখা যায়, অগোছালো পরিবেশ। সামনের ছোট্ট একটি কক্ষে একজন বয়স্ক লোক বসে আছেন। জানালেন তিনি ডা: মুজিবুর রহমান, একাধারে একজন প্রভাষক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, হিসাব রক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। পর্যাপ্ত শ্রেণী কক্ষ নেই, পাঠদানের পরিবেশ নেই। পেছনে টিনশেডের ঘর ভেঙ্গে আধাপাকা ভবন নির্মানের প্রস্তুতি চলছে। তবে এখনো সিটি কর্পোরেশনের অনুমোদন মিলেনি। নিজস্ব ভূমি না থাকায় এখানে ভবন নির্মাণের অনুমতি দেয়নি সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ। যে কারণে তিন তিনবার সরকারী অনুদানের ৫০ লক্ষ টাকা ফেরত গেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। শুধু তাই নয়, অন্যান্য সুযোগ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে কলেজটি। অভিযোগ উঠেছে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি না থাকার কারণে এবং সুষ্ঠুভাবে পাঠদান ও ব্যবহারিক শিক্ষার পরিবেশ না থাকায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের মত একটি বিষয়ে শিক্ষার্থীরা দক্ষ না হয়ে শুধুমাত্র সনদ নিয়ে বের হচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা । এখানে বিষয়ভিত্তিক স্থায়ী শিক্ষক চরম সংকটে। তবে কর্তৃপক্ষের দাবী স্থায়ী শিক্ষক রয়েছেন ১৩ জন এবং ১২ জন নতুন শিক্ষক দিয়েই তারা শিক্ষক স্বল্পতা দূর করার চেষ্টা করছেন। একইভাবে কলেজে পিয়ন, অফিস-সহকরী সহ হিসাব সহকারী পদ শূন্য রয়েছে। কিন্তু অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পরস্পর যোগ সাজসে অস্থায়ী ভিত্তিতে ৩ জন অফিস সহকারী নিয়োগ করে ফেলেছেন। পরবর্তিতে সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে এদেরকে স্থায়ী নিয়োগ দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক বোর্ডের চিকিৎসক প্রতিনিধি সদস্য এবং মনোনিত উপাধ্যক্ষ ডা: ইমদাদুল হক মিলন। বসার জায়গা না থাকলেও কলেজে রয়েছেন দুইজন ভাইস প্রিন্সিপাল। ভাইস প্রিন্সিপাল নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার বিষয়টি অনুসরণ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন কলেজে কর্মরত সিনিয়র শিক্ষক ডা: নুরুন নাহার মজুমদার। কলেজের এই সিনিয়র শিক্ষক অভিযোগ করে বলেন, অধ্যক্ষ ডা: আব্দুল্লাহ ফারুকী পদ না ছেড়ে দীর্ঘদিন স্বপরিবারে আমেরিকায় বসবাস করেছেন। কাউকে দায়িত্ব না দিয়ে তার মনোনিত একজনকে সকলের অগোচরে বিধিবহির্ভূতভাবে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি আরো অভিযোগ করে বলেন, অপূর্নাঙ্গ পরিচালনা কমিটিতে শিক্ষকদের সংখ্যা বেশী থাকায় প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ না দেখে নিজেদের স্বার্থ হাসিল ও তাদের পদ ঠিক রাখার জন্যই স্বনামধন্য এ প্রতিষ্টানটির আজ এই করুন অবস্থা। কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে চরম গ্রুপিং বিরাজ করছে। এ বিষয়ে ডা: নুরুন নাহার মজুমদার বলেন এই গ্রপিং শুরু করে দিয়েছেন কলেজের সভাপতি ও কলেজের ২ জন ভাইস প্রিন্সিপাল । কার গ্রুপে কাকে নিলে গ্রুপ বড় হবে ও সহজে অধ্যক্ষের চেয়ারে বসা যাবে এই নিয়ে সবাই ব্যস্ত। কর্মকর্তা-কর্মচারী সিলেকশন কমিটি প্রসঙ্গে গুরুতর আপত্তি জানিয়ে তিনি বলেন একই কলেজের শিক্ষক দ্বারা কিভাবে সিলেকশন কমিটি হয়। সিলেকশন কমিটি করতে হলে বাহির থেকেও যোগ্য বিভিন্ন পেশার ৫/৬ জন সদস্য বাড়িয়ে এবং নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে বিষয় ভিত্তিক শূন্য পদে শিক্ষক নেওয়ার দাবী জানিয়ে আসছি। কিন্তু পরিচালনা কমিটি কাউকে না জানিয়ে গোপনে সিলেকশন কমিটি করে ওদের পছন্দের লোক নিয়োগের সুবিধা করে দেওয়া হল। এতে প্রতিষ্ঠান আরো মারাত্বক সমস্যার সম্মুখীন হবে। কলেজের আরেক সিনিয়র শিক্ষক ডা: এম.এন আলী বলেন, ম্যানেজিং কমিটি অপূর্নাঙ্গ। সহ-সভাপতি পদে একজন যোগ্য ব্যক্তি থাকা জরুরী। যেহেতু সভাপতি সরকারী কর্মকর্তা তিনি অফিসিয়াল কাজে ব্যস্ত থাকেন। এ পদটিও কৌশলজনিত কারণে খালি রাখা হয়েছে। একইভাবে অভিভাবক সদস্য (২জন) পদ খালি রাখা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল মরহুম ডা: হোসেন রাজা চৌধুরীর মৃত্যুর পর থেকেই ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য এবং সময় উপযোগী পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে বিভাগীয় শহরের এই কলেজটি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সরকারী উন্নয়ন বরাদ্দের ৫০ লক্ষ টাকা আসেনি বলে জানান বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক বোডের্র সদস্য ডা: ইমদাদুল হক মিলন। এই মন্তব্যের জবাবে ডা: এম.এন আলী বলেন, ৫০ লক্ষ টাকা কি তাহলে চা-বিস্কুট খাওয়ার জন্য আসছিল? আবার চলে গেল? গ্রুপিং প্রসঙ্গে ডা: এম.এন আলী বলেন, আমরা কোন গ্রুপে নেই। আমরা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ছিলাম, আছি এবং থাকবো। ডা: ইমদাদূল হক বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক বোর্ড সদস্য মনোনিত হওয়ার পর থেকেই গ্রুপিং করে প্রভাব খাটিয়ে নিজে ফায়দা নেয়।
এ ব্যাপারে তদন্ত কর্মকর্তা স্থানীয় সরকার সিলেটের উপপরিচালক দেবজিৎ সিংহ জানান, কলেজের নানা অনিয়মের ব্যাপারে অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমরা তদন্ত শুরু করেছি। তদন্ত কাজ চলছে। তদন্ত কাজ শেষে আমরা বিস্তারিত জানাবো।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd