সিলেট ৩০শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৭শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ৮:৩২ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৭
ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : সবে এসেছি আমেরিকায়। কালিফোর্নিয়ার মাউনটেইন ভিউ। ভিনদেশে বলতে গেলে আমি পুরোই একা। ২০০২ এর শুরু। কাজ নিয়েছি বাসা থেকে দশ মিনিটের হাঁটা পথ সু-প্যাভেলিয়নে। তখনও দেশের যাবতীয় সঙ্কোচ এবং কোমলতা জড়িয়ে আছে আমাকে ঘিরে। চাকরির ইন্টারভিউয়ে গেলাম সাদা শার্ট, কালো পান্টস পরে, ঠোঁটে লিপিস্টিক, চোখে কাজল। পারফিউম লাগাতেও ভুল হলো না। একেবারে ফিটফাট বাবু আবার বয়সও কম। এরিয়া ম্যানেজার জিজ্ঞেস করলেন, ঘন্টায় কত ডলার চাও?
সেকেন্ডের জন্যে নিজেকে মনে হলো কামলা নাকি, ঘন্টায় টাকা চাইবো? ওদিকে আমেরিকায় আসার খায়েসে দেশের সরকারী চাকরিটি ছেড়ে এসেছি। মনের গহীণে সেই বেদনাটিও মুচড়ে উঠলো। হেসে উঠলাম। তিনি বললেন, কই বললে নাতো কত-বলো! বললাম, তোমার যা মন চায় তাই দিও। বলে, না-তাকি হয়, বলতেই হবে। চাপাচাপিতে বললাম, আগের কাজে ঘন্টায় আট ডলার পেতাম তুমি না হয় নয় দিও। বলে, সাড়ে আট দেবো। বললাম, তাহলে আটই দাও, আর সেন্টে যাবার দরকার নেই।জীবনে কোনদিন বাধ্য না হলে বাবা-মায়ের কাছেও টাকা চাইনি সেখানে আট আনা নিয়ে দরাদরি, পোষায়? তবুও বলে, পঞ্চাশ সেন্ট নেবে না কেন?
আমি, হাসি। মনে হয়, পারলেতো আমি বিনে পয়সাতেই ঐ কাজ করে দেই সেখানে টাকা নিয়ে এভাবে টানাহেচড়া! সে বোঝে না টাকার দরাদরি এখনও শিখে উঠতে পারিনি। তবুও চাকরি হলো। দু`সপ্তাহ পর তিনি চেক হাতে দিয়ে বললেন, খুলে দেখোতো কত পেয়েছো। মিটিমিটি হাসছেন। খুলে দেখলাম, ঘন্টায় নয় ডলার। রিপিট করলাম, নয় ডলার করে দিয়েছো, আট ডলার হলেও কিন্তু অসুবিধা ছিল না। বললেন, তাহলে তুমি যে সাড়ে আট নিতে চাইলে না? আবারও হাসি। কী করে বোঝাই সাড়ে আট বললেই দেশীয় মানুষের রিক্সাওয়ালার সাথে দরাদরির দৃশ্যটি চোখে ভাসে আর নিজেকে রিক্সাচালকের আসনে মনে হয়।
সু-প্যাভেলিয়ান ছিল বিশাল এক জুতার দোকান। পাঁচ হাজারের উপরেও সু রয়েছে ওদের। সব কিছুই করতে হয়, সু সাজিয়ে রাখা, কাষ্টমার সাপোর্ট, বিক্রি এবং ক্যাশ সামলানো। কাজে গেলে সু-সাজাই আর পরিবার এবং নিজের জন্যে মনে মনে পছন্দ করি, এটা না ওটা, কখন? একেকটি সু তিন সপ্তাহ পরেই সেলে চলে যায়। ফিফটি বা সেবেন্টি ফাইভ পারসেন্ট অফ। অপেক্ষা করি ঐ সময়টির।
দোকানের ম্যানেজার দু`জন। একজন আমেরিকান পুরুষ আরেকজন রাশান নারী। পুরুষ ম্যানেজারটি ভালো হলেও রাশান মেয়েটি ছিল বদের বাসা। তবে দু`জনই সাদা। আমার চাকরিদাতা ছিলেন এরিয়া ম্যানেজার- দোকানে হয়ত মাসে একদিন আসতেন তিনি।
একদিন ডিসপ্লেতে জুতা সাজাচ্ছি। একটু পাশেই দুই মেক্সিকান মহিলা জুতা দেখছে গোটা দশেক বক্স চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিয়ে। অতঃপর জুতা না কিনেই তারা বের হয়ে যাচ্ছিল হঠাৎ গেইটের এলার্ম বেজে উঠলো চরমভাবে। ম্যানেজার তৎক্ষণাৎ দৌঁড়ে দোকান থেকে বের হয়ে গিয়ে ধরে আনলেন তাদের। বক্সে নিজেদের পুরোনো সু রেখে নতুন জুতা পরে ভাগছিল তারা। ম্যানেজার আমায় বললেন, তুমি না পাশেই ছিলে- দেখোনি চুরি করছিল তারা?
আমারতো মাথায় হাত, বলি আমি কী করে বুঝবো যে দুই মহিলা মিলে একত্রে চুরি করতে পারে? মাথায়ই আসেনি ঐ চিন্তা, নজর রাখাতো আরও দূরের কেইস।
জুতা রেখে ওদেরকে হুমকি দেয়া হলো, আর যদি কখনও দোকানের আশপাশেও দেখা যায় তাহলে পুলিশে ধরিয়ে দেয়া হবে।
আরেকদিন কাজ করছি। হঠাৎ দেখি রাশান মহিলা ম্যানেজার আমায় খুব ডাকাডাকি করছেন, আলগা খাতির ঝরে পড়ছে তার আচরণে । আমাকে প্রমোশন দেবেন সে কথাও বললেন জোরেসোরে সবাইকে শুনিয়ে। কিছু সময় যেতেই বুঝলাম আরেক কলিগকে চাপে রাখতেই তার এই টেকনিক। মেয়েটিকে হার্ড টাইম দিতে তার বিরুদ্ধে আমাকে ব্যবহার করতে চায়। সে মেয়েটিকে দিয়ে তার নিজের বরাদ্দের কাজটি করাতে চেয়েছিল আর মেয়েটি বলেছে আমারটা শেষ হলেই তোমারটা করে দেবো এই তার অপরাধ। যখনই বিষয়টি ধরতে পারলাম তখন আমি মুখে কিছু না বললেও আদর কদরে শুধু ফসকে যাই- লোভের কোন টোপেই আর সাড়া দেই না। মেয়েটিও দেখছে আমাকে, আমি কী করছি। কাজ শেষে যখন বেরুচ্ছি তখন রাত দশটা। সিলভিয়া এসে বললো, চলো তোমায় বাসায় পৌঁছে দেই, ওপথ দিয়েই আমি যাবো।
সিলভিয়া ক্রোয়েশিয়ান মেয়ে। সাদা সুন্দরী, মাত্র আঠারো বছর বয়স তখন। তার ভাই আর সে মিলে আমেরিকায় এসেছিল এজেন্ট ধরে ন্যানির কাজ নিয়ে, এইচ ওয়ান ভিসায়। দিনভর তিন গেদা বাচ্চার দেখাশোনা করতো-তাদের খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, গোসল করানো, হাগু পরিস্কার সবই। তবে তাদের কান্নাকাটি বেশীদিন সইতে পারেনি। তিন বাচ্চা মিলে যখন জোরেসোরে কান্না চালাতো ওর নাকি মনে হতো গলা চেপে ধরি। ক`দিন যেতেই তার ভাই নিজ দেশে ফিরে গিয়েছে। আর কান্নার ভারে অতিষ্ট হয়ে সিলভিয়া পালিয়েছে ঐ বাসা থেকে। তাও পাসপোর্ট ভিসা ছাড়াই। ফলে অবৈধ স্টাটাস নিয়ে পথে পথে ঘোরা- কাজ নেই আবার থাকার জায়গাও নেই। কতদিন রাস্তায় হটডগ বিক্রি করেছে। তারপর ক্যালিফোর্নিয়ায় পালিয়ে আসে কাজিনের বাসায়। তখন বাসের টিকিট কেনারও পয়সা ছিল না তার হাতে আবার পরিচিতরাও ফোন ধরতো না যদি আবার….। ওদিকে ইংরেজীও জানে না ভালো আবার কাজের অনুমতিও নেই। অবৈধ হওয়ায় রেষ্টরেন্টে অতি অল্প ক্যাশের বিনিময়ে কাজ নেয় সে, ওয়েটারের- টিপসই ভরসা। ওখানেই পঁচিশ/ত্রিশ বছরের বড় নিকের সাথে তার পরিচয়।
নিক ছিল পুলিশ অফিসার। চাকরির কারণে দূর্ঘটনায় তার দু`পা খোঁয়া গেলে বউও তাকে ছেড়ে চলে যায় তখন। সিলভিয়াকে সে তার বাসাতে থাকতে দেয়। অতঃপর বিয়ে। আজও একসাথে আছে তারা।
আজ পর্যন্ত যত মেয়ে দেখেছি তারমধ্যে সিলভিয়া অন্যতম, বিকিনি পরা অতি সুন্দরী মেয়ে। জীবনে এমন কোন ঝুঁকি নেই যে সে সহসা নিতে পিছপা হয়। কার রেস, প্যারাস্যুট জাম্পিং থেকে শুরু করে স্কুবা ভাইভিং পর্যন্ত সবই সে করেছে। সেই সাথে বিশাল একটি হৃদয়েরও অধিকারীও। এই অপরিচিত আমাকেই আমেরিকার মত জায়গায় অফার করেছিল তার বাসায় বিনে পয়সায় থাকতে, তাও যতদিন ইচ্ছে, যেখানে আপন বাবামাও আঠারো বছর হতেই সন্তানের কাছ থেকে থাকাখাওয়ার খরচ নেয়।
সিলভিয়ার সাথেই আমেরিকায় মুভি থিয়েটারে প্রথম মুভি দেখতে যাই। সেই টিকিট কাটে কিন্ত পয়সা দিলেও নেয়নি। জোরের সাথে বলেছে, মানি ইজ নাথিং। মুভিতে সাপ দেখছি আর মনে হচ্ছে সাপটি যেনো একেবারে আমার হাতের কাছে, এখনই কামড় দেবে। চিৎকার করে উঠছি। বৃষ্টি দেখেও একই মনোভাব, যেনো একেবারে মাথায় পড়ছে, ভিজে যাবো। সামনের লোকটির দশাও আমারই মত। সিলভিয়া বলে, ওর সাথে গিয়ে বসো তুমি পাশাপাশি। তার সাথে ডিসকোতেও গিয়েছি একবার। এক কথায় তার সঙ্গ মহা ফান- জীবনকে একেবারে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখা। আবার আমার যে কোন বিপদ দেখলেও সে ঢাল হয়ে এসে একেবারে সামনে দাঁড়িয়েছে সর্বশক্তি নিয়ে।
যখন অরিগনে চলে এলাম একদিন রাতে দেখি দুই পুলিশ এসে হাজির, আমার বাসায়। সিলভিয়া কয়েকদিন আমার কোন খোঁজ না পেয়ে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে অরিগনের পুলিশের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করেছে যেনো তারা আমায় খুঁজে বের করে যে কোন মূল্যে। তখন এক দেশীয় বদমাশের পাল্লায় পড়ে আমার জীবন ছিল ডেঞ্জারে আর সে আমার অনভিজ্ঞতার সুযোগে আমার সাথে লাড়েলাপ্পা খেলছিল। সিলভিয়ার সাথে মাত্র কয়েক মাসের পরিচয় আমার অথচ আজও আমাদের বন্ধুত্ব অমলিন।
মানুষের বিপদের সময়ে যে বন্ধুত্ব ঘটে তার বন্ধন চির অটুট।
লেখক : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সমাজকর্মী
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd