নিরুপায় মানুষের বেঁচে থাকার শেষ উপায় ভিক্ষা। এমনটিই দেখেছি। তিন কূলে যার দায়িত্ব নেবার কেউ নেই অথবা থাকলেও যার দায়িত্ব কেউ নিচ্ছে না তেমন দরিদ্র, বিশেষত, বয়স্ক মানুষই ভিক্ষায় নামতেন। মানুষের করুণাই এদের বাঁচার সম্বল।
আমাদের পাড়ায়, আমাদের শহরে, আমার নানাবাড়ির গ্রামে নারী-পুরুষ যত ভিখিরিকে দেখেছি তাদের সকলেরই ছিল কোনো না কোনো অসহায়ত্ব। তাই, ভিক্ষাও যে হতে পারে মানুষকে প্রতারণা করার কৌশল এই ধারণার সাথে আমার পরিচয়ই ঘটেনি ঢাকায় আসার আগে।
প্রায় দেড় দশক আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে আমার ঢাকাবাস শুরু। আর তখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বিভাগের বারান্দাতেই প্রথম জেনেছি, মানুষের করুণাকেও রেহাই দেয়নি ঠগবাজ মানুষেরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে সবে ভর্তি হওয়া অপাপবিদ্ধ আমি একদিন দেখি, বিভাগের বারান্দা দিয়ে মাঝবয়সী এক নারী অঝোর নয়নে কেঁদে-কেঁদে সাহায্যের জন্য জনে-জনে আবেদন করছেন।
তার বাবা মারা গেছেন। লাশ পড়ে আছে মেডিকেলের বারান্দায়। লাশ বাড়ি নিয়ে যেতে তার কিছু সাহায্য দরকার। কিন্তু কেউ তাকে পাত্তাই দিচ্ছে না।
এমন দৃশ্য দেখে ব্যথায় আমার হৃদয় চৌচির হয়ে গেলো। আমি চকিতে একটা কুড়ি টাকার নোট তার হাতে গুঁজে দিলাম।
কিন্তু ৫০ বা একশ টাকা দিতে না পারায় খারাপ লাগছিল খুব। ভাবছিলাম, বেশি টাকা দিলে হয়তবা লাশ নিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারতো।
আমার টাকা দেয়ার এই ঘটনা দেখে বারান্দার অন্য মাথা থেকে বিভাগের সিনিয়র দুই ভাই আমাকে ডাকলেন। তাদের নাম আজ আর মনে নেই। কিন্তু কথাগুলো খেয়াল আছে।
মুখের দিকে চেয়ে একজন বললেন: কী! ফার্স্ট ইয়ারে পড়ো? দিল এখনো নরম! ব্যাপার না, কিছু দিন গেলেই সব ঠিক অইয়া যাইবো।
আমার ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখ দেখে পাশের জন বললেন: যারে তুমি টাকা দিছো, তার কেউ মরে নাই। সে মিছা কথা কইছে। এইসব বইলাই তারা ভিক্ষা করে।
এই কথা শুনে আমি এমন এক ধাক্কা খেয়েছিলাম যে, মুখে কোনো রা জোটেনি। আর মনে ভাবছিলাম, এ-ও কি বিশ্বাসযোগ্য!
তারপর তো বুড়িগঙ্গায় কত জল বয়ে গেলো। একসময় আমি সাংবাদিকতা শুরু করলাম। রাতবিরেতে কাজে-অকাজে শহরের রাস্তায় কত পাক খেলাম।
এই সমস্ত দিনগুলোতেই খুব নিকট থেকে দেখেছি, দিনে যে ভিখিরি হাইকোর্টের মোড়ে হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে ভিক্ষা করে, রাত দশটার পর সেই আবার হাইকোর্টের সামনের ফুটপাথে পাতা বিছানায় আধাশোয়া হয়ে ব্যান্ডেজ খুলতে-খুলতে হাতের আড়মোড়া ভাঙছে। দিনে যে পঙ্গু, রাতে সে দিব্যি দু’পায়ে হাঁটে।
এই রকম আরো কত সব ঘটনার সাক্ষী হয়ে গেলাম। না চাইতেও। আর মনের মধ্যে যেনো একটা কাঁটা খচ-খচ করতো এদের দেখে। মানুষ এমনও করে! মানুষের সংবেদনশীলতাকেও এভাবে পুঁজি করে মানুষ?
এক কম-বয়সী নারীকে দেখতাম কোলে একটা শিশু নিয়ে ভূতের গলিতে নর্থরোডে প্রতিদিন বিলাপ করে কাঁদে। খাবারের জন্য টাকা চায়।
কিন্তু তার বিলাপে কেউ বিশেষ গা করেনি। সত্যি বলছি, আমিও না। বরং একটা সময়ে এই বিলাপকারীকে দেখলে আমার মধ্যে কেমন ক্ষোভের জন্ম হতো।
মনে হতো, মানুষের সংবেদনশীলতাকে প্রতারিত করার দায়ে এদের পুলিশে দেয়া দরকার।
এই প্রতারকদের কারণেই সত্যিকারের বিপদগ্রস্ত ও করুণা প্রার্থী মানুষকেও আমরা সন্দেহের চোখে দেখি।
কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হতো, যতো সব অলীক ভাবনা। যে দেশে প্রকাশ্য ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না, সেই দেশে এই হত-দরিদ্র নারীর মতন ভিখিরিদেরকে শাস্তি দেয়ার কথা ভাবাটাই বরং বাড়াবাড়ি — অন্যায়।
হ্যাঁ, যারা হয়তো আমার মতনই পরিবার থেকে রপ্ত করেছিল যে, দানের সামর্থ্য থাকলে কোনো ভিখিরি বা করুণা প্রার্থীকে খালি হাতে ফেরাতে নেই, প্রতারণার এই যুগে তারা সেই শিক্ষা ভুলে গেছে। যে দেশে ভিখিরিও ‘আসল’ আর ‘নকল’ হয়, সেই দেশে মানুষের সংবেদনশীলতাই একদিন নষ্ট হয়ে যাবে এ আর আশ্চর্য কী!
তবু, খারাপ লাগে।
এই অনৈতিক চর্চাকে এভাবে কতদিন সয়ে যাওয়া যায়? আর এই বাস্তবতার সবচেয়ে খারাপ দিক হচ্ছে, মানুষের বিলাপের প্রতিও আমরা উদাসীন হয়ে যাচ্ছি। অন্যের কাতর আহ্বানেও সাড়া না দেবার এই ঔদাসীন্য তো একটা ভয়ঙ্কর সামাজিক অসুখ।
এই অসুখেরই হয়তবা চূড়ান্ত রূপ হলো, চোখের সামনে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে একটা মানুষ রাস্তায় পড়ে থাকলেও তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে না যাওয়া; সন্ত্রাসীদের হাতে তাড়া খাওয়া একটা মানুষ বাঁচাও বাঁচাও বলে অন্যের সাহায্য চাইলেও উদাসীন ও সন্দিহান হৃদয় নিয়ে সেই আক্রান্ত মানুষের ডাকেও সাড়া না দেয়া।
এই ঔদাসীন্য কি কোনোভাবেই হতে পারে একটা সুস্থ সমাজের লক্ষণ?
ধর্মীয় কারণে একসময় মাধুকরী বৃত্তি করে জীবন-যাপন করতেন ভিক্ষুরা। বৌদ্ধ ধর্ম ছাড়া অপরাপর আরো কিছু ধর্মে এরকম মাধুকরী বৃত্তির অনুমতি আছে। ক্ষুৎ-পিপাসা নিবারণের জন্য অর্থোপার্জন করতে গিয়ে জাগতিক ভোগ-বিলাসের চক্রে সাধক যেনো জড়িত হয়ে না যান সেই জন্যেই ছিল মাধুকরী বৃত্তি।
জাগতিক মোহ থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে আধ্যাত্মিক সাধনায় রত থাকাই ছিল সেই ভিক্ষাবৃত্তির উদ্দেশ্য।
কিন্তু আজকাল ভিক্ষা হয়ে উঠেছে বিনাশ্রমে অর্থোপার্জনের উপায়। দুর্নীতি করে বা ঘুষ নিয়ে বেশি টাকা উপার্জন করে সম্পদ অর্জনের মানসিকতা আর মানুষের সংবেদনশীলতাকে পুঁজি করে, অন্ধ না হয়েও অন্ধ হবার ভান ধরে মানুষকে প্রতারিত করে টাকা কামানোর মানসিকতাও একই সূত্রে গাঁথা।
আমার তো মনে হয়, সংবেদনশীলতা হারিয়ে আমরা যে সামগ্রিকভাবে একটা উদাসীন ও অন্যের ব্যথাকে গা-না করার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি, এটির প্রকৃত ক্ষতি অনেক বেশি।
কিন্তু এই ক্ষতিটাকে অর্থনৈতিকভাবে টাকার অংকে প্রকাশ করা হচ্ছে না বলেই এটিকে নিয়ে আমরা ভাবছি না।
কিন্তু এটি নিয়েও বোধহয় ভাববার সময় এসেছে। গ্রামের দুঃস্থ, বিধবা ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ বা কার্ড এলাকার প্রভাবশালীরা প্রবঞ্চনার মাধ্যমে নিজেদের নামে বরাদ্দ নিয়ে নেয়ার বহু খবর গণমাধ্যমে আসে। এসব অপকর্মের কারণে প্রকৃত দুস্থরা থেকে যায় সেবা ও সুযোগ প্রাপ্তির বাইরে। এটি যেমন দুর্নীতি তেমনি অসুস্থ ও অসহায় না হয়েও শঠতা করে অন্যের সাহায্য প্রার্থনা করাটাও অনৈতিক।
কেন একজন সুস্থ সবল তরুণ হাতে ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে ভিক্ষার মাধ্যমে সহজে উপার্জন করার মানসিকতায় আক্রান্ত হচ্ছে? কেন এমন জীবন বেছে নেয়ার আগে তার নীতিতে বাঁধছে না? দরিদ্র হলেই মানুষ নীতিহীন হয়— এমন তো ভাবার কোনো কারণ দেখি না।
তাহলে, আমাদের ঘাটতি বা সংকটটা কোথায়? সুস্থ সবল যুবা নারী বা পুরুষ-ও কাজ না করে পঙ্গু ও অসুস্থের ভান ধরে কেন সিগন্যালে বাড়াচ্ছেন ভিক্ষার হাত? আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক শিক্ষায় মৌলিক কোনো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক কি বাকি থেকে যাচ্ছে?
সূত্র-বিবিসি