সিলেটে প্রতিদিনই হচ্ছে ছিনতাই, আতঙ্কে নগরবাসি

প্রকাশিত: ৩:৫২ অপরাহ্ণ, মে ১৯, ২০১৮

সিলেটে প্রতিদিনই হচ্ছে ছিনতাই, আতঙ্কে নগরবাসি

সুলতান সুমন:: শান্তি ও সম্প্রীতির নগরী সিলেটে প্রত্যেহ বাড়ছে ছিনতাই। প্রতিদিনই ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন নগরবাসিসহ আগত পর্যটক ও মাজারে আগত অতিথিরা। ছিনতাইকারীদের কবল থেকে মুক্তি পাচ্ছেননা শিক্ষার্থী, মহিলা, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, ব্যবসায়ি,রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার লোকরা গত পরশু মঙ্গলবারই ছিনতাইর শিকার হয়েছেন ৬ জন।

এই ৬ জন ছাড়াও, গত দুই মাসে ছিনতাইর শিকার হয়েছেন প্রায় ৫০জন। ফলে শান্তির নগরী সিলেট পরিনত হচ্ছে অতঙ্কের নগরী হিসাবে। সিলেটে ছিনতাই বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সচেতন নাগরিক বৃন্দ।

ছিনতাইর শিকার হওয়া ব্যাক্তিদের মধ্যে কিছু অভিযোগ থানায় দাখিল করা হলেও, অনেকেই থানায় অভিযোগ না করে নিরবে তা সহ্য করে যাচ্ছেন। থানায় গিয়ে মামলা করে তেমন কোন ফল পাওয়া যায় না, উল্টো আরো উঠকো বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। তাই অনেকেই এসব থেকে বিরত থাকেন।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশের মধ্যে সিলেটকে বলা হয় আধ্যাতিক বা পর্যটন নগরী। তাছাড়া সিলেট প্রবাসি অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় রয়েছে প্রবাসিদের আনাঘোনা। এই নগরীতে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত শত শত মাজার ভক্ত ও পর্যটকরা আসেন মাজার যিয়ারত ও সিলেটের বিভিন্ন ইতিহাস এবং ঐতিহ্যপূর্ণ স্থান দেখতে। কিন্তু এই শহরে এসেই অনেককে হতে হচ্ছে ছিনতাইর শিকার।

এসকল পর্যটকরা গভির রাতে বা খুব ভোরে গাড়ি থেকে নামার পর বা তাদের গন্তব্যে পৌছানোর আগেই নগরীর ক্বীন ব্রীজ, শাহজালাল ব্রীজ এলাকা, হুমায়ুন রশিদ চত্তর, তালতলা, সুবিদবাজার, জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা, কাজীর বাজার ব্রীজ, হাউজিং স্টেট, দাড়িয়া পাড়া সড়ক ও গলির মুখ, আম্বরখানা-টিলাগড় সড়ক, পাঠানটুলা, কেন্দ্রিয় বাস টার্মিনাল, রেল স্টেশন, মীরের ময়দান, পুলিশ লাইন্স, মেডিকেল রোড, উপশহর এলাকা সহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে মোটর সাইকেল বা সিএনজি যোগে বীরদর্পে ছিনতাই করে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা।

তাছাড়া নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা থাকলেও এসবে কোন ফল পাচ্ছেন না নগরবাসি। ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার আওতায় থাকা অনেক এলাকায় প্রায়ই ঘটে মোটর সাইকেল চুরিসহ মহিলাদের ব্যানেটি ব্যাগ, গলার স্বর্ণের চেইন, মোবইল ফোনসহ নানা ধরণের গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র ছিনতাই হচ্ছে অহরহ। এ সকল ছিনতাই’র শিকার হওয়া ব্যাক্তিদের মধ্যে কিছু অভিযোগ থানায় দাখিল করা হলেও, ছিনতাইর শিকার হওয়া অনেকেই থানায় অভিযোগ না করেই নিরবে তা সহ্য করে যাচ্ছেন।

এদিকে, গত মঙ্গলবার (১৫ মে) ভোর থেকে রাত পর্যন্ত ছিনতাইর শিকার হয়েছেন ৬ জন। এদের মধ্যে মানবাধিকার ও পরিবেশ সাংবাদিক সোসাইটির কর্মী মো. ওয়াহিদুর রহমান এসএমপি’র কোতয়ালি থানায় অভিযোগ দাখিল করেছেন। তার অভিযোগটি তদন্ত’র জন্য লামাবজারা পুলিশ ফাঁড়ির এসআই শাহিন মিয়াকে প্রদান করা হয়েছে।

আর ওই দিন গভীর রাতে নগরীর ধাড়িয়াপাড়ায় ছিনতাইর শিকার হওয়া অনলাইন সাংবাদিক মবরুর রহমান সাজু থানায় কোন অভিযোগ দাখিল করেননি। অপরদিকে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় শাহজালাল ব্রীজের দক্ষিণ মুখে মোগলাবাজারের লালই নামের এক কাপড় ব্যবসায়ি ছিনতাইর শিকার হন। তবে এ ব্যাপারে এসএমপি’র দক্ষিণ সুরমা থানায় কোন অভিযোগ দাখিল করা হয়নি বলে জানিয়েছেন অফিসার ইনচার্জ (ওসি) খায়রুল ফজল।
এর পূর্বে, সোমবার (১৪ মে) নগরীর উপশহর এলাকায় ছিনতাইকালে এক যুবককে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যাওয়ার সময় ৪ ছিনতাইকারীকে জনগণ আটক করে গণধোলাই দিয়ে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। ঐ দিনই নগরীরর হাওয়া পাড়ার আরএন টাওয়ার এর সামনে এক কলেজ ছাত্রীর গলা থেকে স্বর্ণের চেইন ছিড়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। এছাড়া ৫ মে দক্ষিণ সুরমায় ছিনতাই’র প্রতিবাদ করায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে ১২ মে নিহত হন কলেজ শিক্ষার্থী ফাহিম, এপ্রিল মাসের শেষের দিকে ছিনতাইর টাকা ভাগভাটোয়ারা নিয়ে খুন হয় এক যুবক।

এ ঘটনায় মামলা তদন্তাধিন। এর আগে দক্ষিণ সুরমা ক্বীন ব্রীজ এলাকায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে খুন হন শাবি ছাত্র মাহিদ আল সালাম। গত ৬ এপ্রিল শুক্রবার সন্ধ্যায় নগরীর শাহজালাল ব্রীজ এলাকায় ছিনতাইর শিকার হন দক্ষিণ সুরমা বলদি এলাকার আজাদ মিয়ার স্ত্রী সেলিনা বেগম। তিনি স্বামী সন্তানসহ সিএনজি অটোরিক্সা যোগে উপশহরে একটি বিয়ের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন। ব্রীজে উঠা মাত্রই একটি কালো পালসার মোটর সাইকেল যোগে দুই ছিনতাইকারী এসে তার ব্যানেটি ব্যাগে টান মারলে তিনি গাড়ি থেকে পড়ে যান।

ঐ সময় ছিনতাইকারীরা তাকে টেনে ৭ থেকে ৮ মিটার দূরে নিয়ে যায়। ফলে ঐ মহিলার বাম হাত ও কোমরের হাড় ভেঙ্গে যায়। পরবর্তীতে একটি বেসরকারী হাসপাতালে তার দু-দফা অস্ত্রোপচার হয়। কিন্তু চিকিৎসকরা বলেছেন তিনি পঙ্গুত্ব বরণ করতে পারেন। এর আরো পূর্বে তালতলায় রাতে ছিনতাইর শিকার হন সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও আইনজীবী বনশ্রী দাস অপু। তাকে ছুরিকাঘাত করে মোবাইল, মানি ব্যাগ, নগদ টাকা নিয়ে যায়।

আর সুবিদবাজারে ছিনতাইয়ের শিকার হন ছাত্রদল নেতা বেলাল। ছিনতাইকারীরা তার গলায় ছুরি ধরে টাকা ও মোবাইল ফোন নিয়ে যায়। গত ৩ মে কেন্দ্রিয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ এর সামনে ছিনতাইয়ের শিকার হন এক সাংবাদিকের স্ত্রী। তবে ঐ সময় ছিনতাইকারীকে ধরে পাবলিক গণধোলাই দিয়ে ছেড়ে দেয়।

এর পূর্বে ছিনতাইর শিকার হন মাই টিভি সিলেটের ব্যুরো চীফ টুনু তালুকদারের বাবা-মা। এ ব্যাপারে এসএমপি’র জালালাবাদ থানায় অভিযোগ দাখিল করা হয়। যা এখনও তদন্তাধীন রয়েছে। তাছাড়া এপ্রিল মাসে হাওয়া পাড়া রাস্তা দিয়ে বাসায় ফেরার পথে ছিনতাইর শিকার হন সরকারী মহিলা কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শফিকুল ইসলাম, নগরীর হুমায়ুন রশীদ স্কয়ারে ছিনতাইর শিকার হন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ব বিদ্যালয়ের এক ছাত্রী। এরা লোক লজ্জা ও উঠকু বিড়ম্বনা থেকে রক্ষা পেতে থানায় কোন অভিযোগ দাখিল করেননি।

ছিনতাইর শিকার অনলাইন সাংবাদিক মবরুর আহমদ সাজু জানান, তিনি মঙ্গলবার দিবাগত রাতে মিরের ময়দান থেকে বাসায় ফেরার সময় রাত ১২টা ১৫মিনিটে দাড়িয়াপাড়া মুখ থেকে তার রিক্সার গতিবেগ করে ছিনতাইকারীরা। তাকে রিক্স্রা থেকে নামিয়ে, দুটি মটর সাইকেলে আসা হেলমেট পরিহিত চার ছিনতাইকারী তার মানি ব্যাগ, স্মার্ট ফোন ছিনতাই করে, মানি ব্যাগে ছিল ২টি কার্ড ও এইচ.এস.সি পরীক্ষায় পর্যবেক্ষকের পাওয়া সস্মানি ৩৭৫০টাকা, এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজপত্র ও বিভিন্ন চাকুরীর পরীক্ষার প্রবেশপত্র ছিল।

এ সময় ছিনতাইকারী দুজনের পড়নে ছিল রেইনকোট ও দুজনের মাথায় হেলমেট। একজন হেলমেট পড়া অবস্থায় যে তার লম্বা চুল রয়েছে তা দেখতে পান। তবে এ ব্যাপারে তিনি কোন অভিযোগ দাখিল করেননি সংশ্লিষ্ট থানায়।

মঙ্গলবার রাতে আম্বরখানায় ছিনতাইর শিকার হওয়া মানবাধিকার কর্মী ওয়াহিদুর রহমান জানান, তিনি তার কাজ শেষ করে বাসায় ফেরার পথে আম্বরখানায় পৌছামাত্রই পালসার মোটর সাইকেল করে তিন ছিনতাইকারী তার হাতে থাকা নতুন লাভা ব্যান্ডের মোবাইল ফোন নিয়ে যায়। ছিনতাইকারীরা ছিল খুবই হ্যান্ড সাম। একজনের মাথার চুল লাল ও গায়ের রং ফর্সা। এ ব্যাপারে তিনি এসএমপি’র কোতয়ালি থানায় অভিযাগ দাখিল করেছেন। যা লামাবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে তদন্তাধীন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেট এর সভাপতি ফারুক মাহমুদ জানান, সিলেটে যে হারে ছিনতাই বেড়ে তাতে আতঙ্কিত নগরবাসি। তাই দ্রুত এর কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে প্রশাসনকে। তা না হলে দিনদিন এ ধরণের অপরাধ প্রবণতা বেড়েই চলবে।
এ ব্যাপারে এসএমপি’র কোতয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) গৌসুল হোসেন জানান, ছিনতাইর শিকার কারো অভিযোগ পেলেই তা তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তাছাড়া ছিনতাইকৃত মালামাল উদ্ধার করতে পুলিশ সকল সময়ই অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়া সিলেটের দিনকালকে জানান, সিলেট নগরীতে যে কোন ধরণের অপরাধ মূলক কর্মকান্ড দূর করতে পুলিশ ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। তাছাড়া মোটর সাইকেলে ছিনতাই রোধে সাদা পোশাক পরিহিত পুলিশ রয়েছে নগরীর বিভিন্ন এলাকায়। আর ছিনতাই রোধে প্রতিদিনই চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি করা হচ্ছে। ইতিপূর্বে ছিনতাই হওয়া অনেক মালামালও উদ্ধার করেছে এসএমপি পুলিশ।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

May 2018
S S M T W T F
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
262728293031  

সর্বশেষ খবর

………………………..