সিলেট ১০ই এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৭শে চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১১ই শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ১:৪৮ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৫, ২০১৮
স্টাফ রিপোর্টার :: জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত হয়ে পড়ছে মানুষ। শত ব্যস্ততা আর যান্ত্রিক জীবন মুক্তি পেতে প্রকৃতির কাছাকাছি ফিরে দুদণ্ড স্বস্তির নিঃশ্বাস ব্যাকুলতাও আছে সব বয়সের মানুষের মনে।
আর তাই কি শীত, কি গ্রীষ্ম-বর্ষা প্রায় সব ঋতুতেই দেশের দর্শনীয় স্থানগুলো মুখর করে রাখে দেশি-বিদেশি হাজারও ভ্রমণপিপাসু। পর্যটকদের কাছে এদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান ‘দুটি পাতা আর একটি কুড়ি ও পুণ্যভূমি’ খ্যাত সিলেট অঞ্চল।
হযরত শাহজালাল (রহ:), হযরত শাহপরান (রহ:)-এর মাজার, জাফলং, লালা খাল, বিছানাকান্দি, রাতারগুল, মাধবপুর লেক, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, চা বাগান, কমলার বাগান, মনিপুরী পাড়া, খাসিয়া পুঞ্জি, টাংগুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ।
এছাড়া সিলেটজুড়ে রয়েছে পাহাড়ি ছড়া আর ঝরনা। বেশির ভাগ স্থানই সীমন্ত এলাকায় হওয়ায় ধীরে ধীরে পর্যটন বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সীমান্ত এলাকার মানুষের জীবিকার অবলম্বনও হয়ে উঠছে এ পর্যটন শিল্প।
কিন্তু এ অঞ্চলে পর্যটন শিল্পের বিকাশ যেভাবে হচ্ছে সেটা আশাতীত মনে করেন না স্থানীয়রা। অনেকেই মনে করেন শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহালদশাই এই শিল্প বিকাশের অন্তরায় হয়ে আছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা নাজুক থাকার পরও দেশি পর্যটকদের আনাগোনা থাকে বছরের সব সময়, কিন্তু সেভাবে দেখা মেলে না বিদেশি পর্যটকদের।
পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাও মনে করেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেটের পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটাতে হলে দ্রুত যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে এবং যত দ্রুত পর্যটন এলাকার রাস্তাঘাটের উন্নয়ন সম্ভব হবে ঠিক ততটা গতিতেই এ অঞ্চলে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে। বিশেষ করে এ অঞ্চলের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিত সীমান্তবর্তী বিছানাকান্দি, জাফলং অন্যতম।
বিছানাকান্দি আর জাফলং
সবশেষ বিগত ঈদুল আজহার লম্বা ছুটিতে পর্যটকদের ঢল নামে বিছানাকান্দি আর জাফলং এ। পাহাড়ের গায়ে মেঘেদের লুকোচুরি, দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা স্বচ্ছ পানির জলধারায় গা ভেজানোর লোভ সামলানো দায়।
কিন্তু প্রকৃতির সেই রূপের ডাকে যারা সাড়া দিয়েছিলেন তাদের সেখানে পৌঁছাতে বেশ যন্ত্রণাও সহ্য করতে হয়েছে। সিলেট থেকে গোয়াইনঘাট উপজেলার শালুটিকর পর্যন্ত প্রশস্ত রাস্তায় নির্বিঘ্নে পৌঁছাতে পারলেও শালুটিকর থেকে সরু রাস্তায় কিছুটা স্বস্তিতে পৌঁছাতে পারবেন উপজেলার বঙ্গবীর রোড পর্যন্ত।
তারপরই হাদারপাড় পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার রাস্তায় ভোগান্তি মাত্রা চরম আকার ধারণ করবে। এ সামান্য রাস্তায় কয়েক ফুট পরপরই বড় বড় খানাখন্দকে যানবাহন চলাচল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এলজিইডির তত্ত্বাবধানে তৈরি এ সাধারণ রাস্তায় প্রতিনিয়ত অধিক ওজনের পাথরবাহী ট্রাক চলাচলের কারণে গত ৫ বছর ধরেই এই সড়কের বেহালদশা।
মাঝে মাঝে কিছুটা সংস্কার কাজ হলেও এক সপ্তাহেই আবার আগের রূপ ধারন করে। পর্যটকদের এ ৭ কিলোমিটার রাস্তা পেরুতে সময় লাগে প্রায় দেড় ঘণ্টা। এখানে ঘুরতে আসা ভ্রমণপিপাসুদের মতে এ সড়ক সংস্কার হলে যে কোনো যানবাহনে বঙ্গবীর থেকে হাদারপাড় পৌঁছাতে সময় লাগবে মাত্র ১০ মিনিট।
ঘাটে ঘাটে সিন্ডিকেট
এত গেল সড়ক যোগাযোগের কথা। বছরের এপ্রিল থেকে অক্টোবর ৭ মাস বিছানাকান্দিতে যেতে হলে পাড়ি দিতে হয় ৩০ মিনিটের নৌপথ। পর্যটকদের বিছানাকান্দিতে পৌঁছাতে হাদারপাড় কিংবা পিরের বাজারে এলাকায় তৈরি হয়েছে বেশ কয়েকিট নৌঘাট।
কিন্তু ৩০ মিনিটের পথে যেতে আসতে পর্যটকদের গুনতে হয় ১২০০ থেকে ২০০০ হাজার টাকা। লম্বা ছুটিতে পর্যটকদের ভিড় বাড়লে নৌকা ভাড়াও পৌঁছে যায় অসহনীয় পর্যায়ে। এখানে ঘুরতে আসা পর্যটক এবং স্থানীয়দের মতে নৌঘাটগুলোতে তৈরি হওয়া সিন্ডিকেটের কারণে অসহায় হয়ে পড়েন পর্যটকরা।
পর্যটকরা যাতে নির্বিঘ্নে ঘুরে আসতে পারেন বিছানাকান্দি সেই ব্যবস্থা তৈরি করতে স্থানীয় প্রশাসনকে এ সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। নৌকা ভাড়ায় আনতে হবে নীতিমালা। এত গেল বিছানাকান্দির হালচাল।
সিলেটের আরেক দর্শনীয় স্থানের নাম জাফলং। ভারতের মেঘালয়ের বিশালাকৃতির দুটি পাহাড়ের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসা পিয়াইন নদীর স্রোতধারা পড়েছে জিরো পয়েন্ট হয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে।
কোথাও পায়ের পাতা, কোথাও গোড়ালি আর কোথাও হাঁটু সমান স্বচ্ছ শীতল জলের ধারার নিচে রং বেরঙের গোলাকৃতির পাথর বিছানো। দুই দেশের সীমানায় কোনো দেয়াল বা কাঁটাতারের বেড়া পর্যন্ত নেই।
বিজিবি-বিএসএফ পাশাপাশি দায়িত্ব পালন করছে। এখানে বেড়াতে আসলে ভারতের মেঘালয়ের দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়, টিলা, ওপারের ডাউকি নদীর উপরের ঝুলন্ত ব্রিজ, বহমান পিয়াইনের স্বচ্ছ নিলাভ জলরাশি, নুড়ি পাথরের সঙ্গে পানির কলতান, আদিবাসী খাসিয়াদের মাচাং বাড়িঘর, পান-সুপারির বাগান, জাফলং টি কোম্পানির একমাত্র সমতল চা বাগান ভ্রমণ মুখরতায় হারিয়ে যান পর্যটকরা।
সুবিধা নেই পর্যটকদের জন্য
ভারত অংশে ওপর থেকে নিচে নামার জন্য রয়েছে বিভিন্ন স্থানে সিঁড়ির ব্যবস্থা, স্থানটিকে সাজানো হয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে। চারদিকের সব কিছুতে শৃঙ্খলার বিষয়টিও দূর থেকেই বোঝা যায়।
কিন্তু বাংলাদেশ অংশে পর্যটকদের জন্য সুবিধা নেই বললেই চলে। ভোগান্তি শুরু হয় ২০ কিলোমিটার দূর থেকেই। সিলেট-তামাবিল সড়ক হয়ে জৈন্তাপুর উপজেলা সদর পার হলেই গতি হারায় যানবাহন।
বড় বড় খানাখন্দকে ভরা এ ২০ কিলোমিটার রাস্তার বেহালদশা দীর্ঘদিনের। প্রায় সোয়া ঘণ্টার অসহনীয় ভ্রমণ শেষে মামার বাজারেই থামতে হয় পর্যটকদের। কারণ মামারবাজার এলাকা থেকে জাফলং টুরিস্ট স্পটে যেতে যে ৭শ’ মিটার রাস্তা রয়েছে তাতে গাড়ি তো দূরের কথা হেঁটে চলাও দুরূহ হয়ে পড়েছে।
গত দুই বছর ধরে সেই পথে না গিয়ে এখন দুই কিলোমিটার আগেই থেমে যান পর্যটকরা। স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্পের সামনে গাড়ি রেখে হেঁটে জিরো পয়েন্টে যান তারা। জিরো পয়েন্টে আসতে বড় বড় দুটি টিলা বেয়ে, কয়েকটি ছোট ছোট ছড়া (খাল) পেরিয়ে প্রায় আধা কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়।
একটু অসাবধান হলে, কিংবা পা পিছলে গেলে ভয়নাক বিপদ ঘটতে পারে। নারী, শিশু কিংবা বয়োবৃদ্ধ হলে তো কথাই নেই। আর নদীতে মাঝিদের দৌরাত্ম্যে আরও বেশি বিরক্ত হন পর্যটকরা।
প্রশাসনিক তৎপরতা চলছে
সেই সঙ্গে বিদেশি পর্যটকদেরও সেখানে ঘুরতে যেতে আর বাধা থাকবে না। স্থানীয় প্রশাসন বলছে, আর বেশিদিন এমন যন্ত্রণা পোহাতে হবে না ভ্রমণপিপাসুদের। আগামী ৬ মাসের মধ্যেই যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হতে যাচ্ছে এই দুই পর্যটন কেন্দ্রের।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার পাল জানান, পর্যটকদের ভোগান্তির কথা সরকারের ওপর মহলে জানানো হয়েছে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে খুব কম সময়ের মধ্যেই এ দুই পর্যটন কেন্দ্রসহ বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের কাজ শুরু হবে।
জৈন্তাপুর-গোয়াইনঘাট-কোম্পানীগঞ্জ এ তিন উপজেলা নিয়ে গঠিত সিলেট-৪ আসনের সংসদ সদস্য ইমরান আহমেদ জানান, এ অঞ্চলে পর্যটন শিল্প বিকাশের বিষয়টি মাথায় রেখেই নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে অন্যতম জৈন্তাপুর থেকে জাফলং টুরিস্ট স্পট পর্যন্ত খানাখন্দকে ভরা ১৬ কিলোমিটার সড়ক নতুন করে তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছে।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd