মিডওয়াইফরাই তাদের ‘ডাক্তার আপা’

প্রকাশিত: ৪:৪৫ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৩, ২০১৮

মিডওয়াইফরাই তাদের ‘ডাক্তার আপা’

ক্রাইম সিলেট ডেস্ক :: ২২ বছরের হাসিনা বেগম মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন গতবছরের সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে। শ্বশুরবাড়ির সবার সঙ্গে কোনোরকমে প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে আসেন হাসিনা। প্রথম সন্তানের জন্মের ১ বছর ৯ মাস পর আবার গর্ভবতী হয়েছেন হাসিনা।

হাসিনারা থাকছেন উখিয়ার কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। ক্যাম্পের মধুরছড়া এলাকাতে ক্যাম্পের পাশেই গড়ে উঠেছে হোপ ফাউন্ডেশনের হোপ ফিল্ড হসপিটাল ফর উইমেন। গর্ভবতী হওয়ার পর থেকে এ হাসপাতালেই নিয়মিত চেকআপে আসেন হাসিনা।

হাসিনা সারাবাংলাকে বলেন, মিয়ানমারে প্রথম সন্তানের জন্ম হয়েছে, কিন্তু সেখানে এসব চেকআপের কোনো বালাই ছিল না। কিন্তু এখানে বরং ‘ডাক্তার আপা’রাই তাকে খুঁজে নেয়, তারাই সব করে। হাসিনা যখন এসব কথা বলছেন তখন পাশে তার দিকে তাকিয়ে আছেন কানেতা আক্তার। ২২ বছরের কানেতা একজন মিডওয়াইফারি গ্রাজুয়েট, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিন বছরের ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি কোর্স সম্পন্ন করে কানেতা এখন এই হাসপাতালে মিডওয়াইফ হিসেবে কাজ করছেন। হাসিনা বেগমের মুখে ডাক্তার আপা শুনে হেসে দেন কানেতা। বলেন, ওদের কাছে আমরাই ডাক্তার আপা, আমাদের ওপর খুব ভরসা ওদের।

কানেতা জানালেন, প্রতিদিন প্রায় ৩০ থেকে ৪০ জন করে গর্ভবতী নারী তাদের কাছে আসছেন। আবার প্রসবের পরও এসব নারীরা থাকছেন তাদের ফলোআপে।

পুরো রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঘুরে জানা গেল, কেবল কানেতাই নন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪৮ জন গ্রাজুয়েট মিডওয়াইফ রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বিভিন্ন সংস্থার হয়ে সেবা প্রদান করে যাচ্ছেন। বিগত ছয়মাসে মিডওয়াইফদের মাধ্যমে প্রায় তিন হাজার ২০০টি স্বাভাবিক প্রসব সম্পন্ন হয়েছে।

জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (এনআইপওআরটি) আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর) ও দাতা সংস্থা ইউএসএআইডির এক গবেষণা থেকে জানা যায়, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে এখনও প্রতি লাখে ১৯৬ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে।  যা ২০৩০ সাল নাগাদ ৭০ জনে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু এ জন্য প্রয়োজন দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফ।

বাংলাদেশে মাত্যৃস্বাস্থ্য এবং শিশুস্বাস্থ্য সেবার পরিবর্তন করার লক্ষ্য নিয়ে ২০১২ সাল থেকে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপিং মিডওয়াইভস প্রজেক্ট (ডিএমপি) এর যাত্রা শুরু হয়। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ এর অধীনে যুক্তরাজ্য সরকারের অনুদান নিয়ে ৩ বছরের মিডওয়াইফারি ডিপ্লোমা শুরু করে ডিএমপি। প্রকল্পটি প্রথম ধাপ সফল ভাবে শেষ হবার পর দ্বিতীয় ধাপের কার্যক্রম শুরু করে ২০১৬ সালে, যা আগামী ২০২১ সাল পর্যন্ত চলবে, জানান ডেভেলপিং মিডওয়াইফস প্রজেক্টের অ্যাডভোসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট কাওসার আহমেদ।

কাওসার আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ডেভেলপিং মিডওয়াইফভস প্রজেক্ট ( ডিএমপি) এর মাধ্যমে দেশে প্রথম প্রাইভেট সেক্টরে মিডওয়াইফারি শিক্ষার সূচনা হয়েছে। বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল ( বিএনএমসি) এবং ইন্টারন্যাশনাল কনফেডারেশন অব মিডওয়াইভস এর অনুমোদিত কারিকুলাম অনুযায়ী এখানে শিক্ষা দেওয়া হয়।

ঢাকা, সিলেট (২টি), ময়মনসিংহ, খুলনা ও দিনাজপুরে অবস্থিত দেশের ছয়টি বিভাগে সাতটি অ্যাকাডেমিক সেন্টারে এখন পর্যন্ত ৮৫৯ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন। যার মধ্যে ৪০০ জন ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি কোর্স সম্পন্ন করেছেন। ৩৯৭ জন বিএনএমসি এর লাইসেন্স প্রাপ্ত হয়েছেন, ১৬১ জন সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পেয়েছেন।

তবে এর মধ্যে ঢাকায় অবস্থিত অ্যাকাডেমিক সাইটটি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ সরাসরি পরিচালনা করে। আর বাকিরা বিভিন্ন এনজিও সংস্থার সহযোগিতায় পরিচালিত হচ্ছে।

এসব সাইটে এ পর্যন্ত পাঁচটি ব্যাচে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়েছেন এবং প্রতি ব্যাচে ২৩০ জন করে ভর্তি হতে পারেন।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপিং মিডওয়াইভস প্রোজেক্ট এর স্ট্রেটেজি অ্যাডভাইজার শারমিনা রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ২০১২ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ডেভেলপিং মিডওয়াইভস প্রজেক্ট প্রথম বেসরকারি পর্যায়ে কাজ শুরু করেছে। তিন বছরের ডিপ্লোমা কোর্স হলেও সেটি সরকারি কারিকুলাম অনুযায়ী কিন্তু সেইসঙ্গে ইংরেজিতে জোর দেওয়া হয়েছে বেশ, ইংরেজি ভাষাকে ভালোভাবে রপ্ত করাতে বিশেষ একটি কোর্স পাঠ্যসূচির অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে তাদের জন্য। একইসঙ্গে আমরা চেষ্টা করি আইসিএম (ইন্টারন্যাশনাল কনফিডারেশন অব মিডওয়াইফ) এর মানদণ্ডের কাছাকাছি থাকার।

তিনি বলেন, পড়াশোনার পাশাপাশি প্রতিজন প্রতিটি শিক্ষার্থীকে ছয়মাস বিভন্ন কমিউনিটি ক্লিনিকে কাজ করতে হয়। সেখানে নিজ হাতে ৪০টি ডেলিভারি সম্পন্ন করতে হয় আর এ কাজটি তারা করে থাকেন একজন ফ্যাকাল্টির অধীনে।

শারমিনা রহমান বলেন, কর্মক্ষেত্রে কীভাবে ডিউটি করবে, জটিল কিছু হলে কীভাবে সেগুলো ব্যবস্থাপনা করবে সেসবও তাদের শেখানো হয়ে থাকে।

এ সব ক্যাম্পে কবে থেকে মিডওয়াইফরা কাজ করছেন জানতে চাইলে শারমিনা রহমান বলেন, গত বছর আগস্টের পরপর যখন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আসা শুরু করলেন তখনই কাকতালীয়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিডওয়াইফদের একটা ব্যাচ বের হয়। তখনই এসব মিডওয়াইফদের এখানে নিয়োগ দেওয়া হয়। খুব কাকতালীয় হলেও বিষয়টি অত্যন্ত ইতিবাচক ছিল মিয়ানমার থেকে আসা গর্ভবতী নারীদের জন্য বলেন শারমিনা রহমান।

তিনি বলেন, প্রথমে ৩০ জন দিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে ১৪৮ জন মিডওয়াইফ কক্সবাজারের কুতুপালং, বালুখালি, উখিয়া, হলুদিয়া পালং, হাকিমপাড়া, মধুরছড়া,পালংখালির রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করছে।

আমাদের মনিটরিংয়ে দেখেছি, এসব মিডওয়াইফদের একসেপটেন্স (গ্রহণযোগত্যা) রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অনেক বেশি। কারণ, তিন বছরের কোর্স শেষ হবার পর ‘কমিউনিটি এনগেজমেন্ট’ বলেও একটি কোর্স রয়েছে যেখানে ছয়মাস ইন্টার্নশিপে তাদের কাজ করতে হয়। সেখানে তাদের দক্ষতা আরও বেড়ে যায়, কারণ ওখানে তারা আরও নিবিড়ভাবে কাজ শেখার এবং মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ পায়। যার কারণে ছয়মাস পরে তাদের আত্মবিশ্বাসটাও বেড়ে যায়। কর্মক্ষেত্রে গিয়ে কাজ করার সময়ে তাদের লিডারশিপ ক্যাপাসিটি, আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়, বলেন শারমিনা রহমান।

শারমিনা রহমান বলেন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডওয়াইফারি প্রজেক্টে এই ‘ইন্টার্নশিপ’ অত্যাবশ্যকীয় করা হয়েছে। একইসঙ্গে সরকারের নীতিনির্ধারকদের এর প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি এবং মিডওয়াইফারি যে পলিসি তৈরি হচ্ছে সেখানেও সরকার অন্তর্ভুক্ত করেছে যারা পাস করবে তাদেরকে অবশ্যই ইন্টার্নশিপের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে-এটা অনেক বড় সাফল্য ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপিং মিডওয়াইভস প্রজেক্ট এর।

বাংলাদেশের জন্য মিডওয়াইভ অপরিহার্য মন্তব্য করে শারমিনা রহমান বলেন, দেশে মাতৃমৃত্যুহার লক্ষ্যমাত্রায় পৌছাতে পারিনি, একইসঙ্গে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে বর্তমান সময়ে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশু জন্মের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এ দুই ক্ষেত্রেই মিডওয়াইভসরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে।

তিনি বলেন, একটি প্রসবে চিকিৎসকরা সময় দিতে চান না বা পারেন না, তার সঙ্গে অন্যান্য অনেক কিছুই রয়েছে। সেখানে একজন মিডওয়াইভ অনেক সময় দিতে পারেন। একইসঙ্গে তাদেরকে শেখানে হয়, রেসপেক্টফুল মেটারনিটি কেয়ার। একজন হবু মায়ের সঙ্গে কী ব্যবহার করতে হবে, তার সঙ্গে কী করে কতা বলতে হবে-সেটাও কিন্তু উন্নত বিশ্বে রয়েছে। মায়ের আস্থার জায়গা তৈরি করা, তাকে কাউন্সিল করা, তার স্বজনদের কাউন্সিলিং করা-এই পুরো প্রক্রিয়া তারা একটি বিশেষ প্রশিক্ষণের ভেতর দিয়ে শিখে আসে। তারা মায়েদের আস্থার জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছে।

দেশে আরও বেশি মিডওয়াইফ তৈরি করতে পারলে সন্তান প্রসবেব অস্ত্রোপচারের সংখ্যা কমে যাবে। মায়েরা মিডওয়াইফদের কাছে আসবেন ভরসার জায়গা থেকে, যোগ করেন শারমিনা রহমান।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে মিডওয়াইভসদের প্রয়োজনীয়তার কথা জানান ইন্টারন্যাশনার অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম)-এর ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অফিসার ড. মহিউদ্দিন এইচ খান।

তিনি বলেন, দেশে আসা রোহিঙ্গা নারীদের মধ্যে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার নারী গর্ভবতী। এদের মধ্যে মিডওয়াইভসদের চাহিদা তৈরি হয়েছে এখানে।

মিডওয়াইফস প্রয়োজনের তুলনায় কী পরিমাণ আছে এমন একটি প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া, অনেকেই আসছেন কাজ করছেন। আবার অন্য কোথাও ভালো সুযোগ পেলে চলে তারা চলেও যাচ্ছেন।

তাই শুরুর দিতে তাদেরকে সদ্য পাস করা গ্রাজুয়েটদের নিতে হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, নতুন করে যারা আসছেন তাদেরকে নতুন করে প্রশিক্ষণ দিতে হয়। কারন সেখানে শুধু প্রসবকালীন নয়, প্রতিটি নারীর প্রসবের সময়ে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকে-সেসব বিষয়েও তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হয়।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

October 2018
S S M T W T F
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031  

সর্বশেষ খবর

………………………..