বিএনপি-জামায়াত সরকারের পুরো সময়েই ছিল জঙ্গিদের পৌষ মাস

প্রকাশিত: ৭:৫২ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৩, ২০১৮

বিএনপি-জামায়াত সরকারের পুরো সময়েই ছিল জঙ্গিদের পৌষ মাস
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা :: দুর্বৃত্তের রাজনীতিকায়নে বাংলাদেশের ছোটখাট পরিচিতি সবসময়ই ছিল। কিন্তু ২০০১-সালের নির্বাচনে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপির ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভাব দেশে রাজনৈতিক দুর্বত্তায়নের এক নতুন মাত্রা এনে দিয়েছিল। লাগাতার ধর্ষণ, সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, জজ মিয়া নাটক, প্রধানমন্ত্রীর পুত্রের হাওয়া ভবন নামের বেসরকারি সচিবালয় গঠন, ১০ ট্রাক অস্ত্র আর তালেবান স্টাইলের জঙ্গি সংগঠন জেএমবি’র আত্মপ্রকাশ বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে এক নতুন তালিকায় নিয়ে গিয়েছিল।

বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা নিয়ে অনেক কথা প্রচলিত আছে। অতিরিক্ত রাজনীতিসচেতনতা থেকেই আমরা যুগ যুগ ধরে বিরুদ্ধবাদী বা প্রতিপক্ষের ঘরে আগুন দেয়া, লুটপাট চালানো, ধারালো অস্ত্রাঘাতে খুন করা দেখে এসেছি। তবে জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারই প্রথম দেখালো সংসদের প্রধান বিরোধী দলের পুরো নেতৃত্বকে কিভাবে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার চেষ্টা করা যায়।

সেই রোমহর্ষক ঘটনার বিচার হলো আজ। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২১ আগস্ট চালানো গ্রেনেড হামলা মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এই মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, হারিস চৌধুরী, সাবেক সাংসদ কায়কোবাদসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছে। এছাড়া এ মামলার আসামি ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতারা অলৌকিক ভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন। আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২৪ নেতা-কর্মী নিহত হয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন শতাধিক। অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। তাদের অনেকেই আর স্বাভাবিক জীবন ফিরতে পারেননি। সেদিন বিকেলে সরকারী মদদে ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠী হরকাতুল জিহাদের গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ দলের মূল নেতৃত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে কি হত তা ভেবে কুল পাওয়া যায়না।

তারেক রহমানসহ তৎকালীন বিএনপি নেতৃত্ব হয়তো ভেবেছিলেন আওয়ামীলীগকে নেতৃত্বশূণ্য করে তাদের ক্ষমতায় থাকা চিরস্থায়ী করবেন। কিন্তু হুজির মতো একটি ভয়ংকর জঙ্গি গোষ্ঠিকে দিয়ে এমন কাজ করালে যে পরিণাম অপেক্ষা করছিল তা নিয়ে হয়তো তাদের বড় ভাবনা ছিল না। প্রকৃতপক্ষে তারা নিজেরাও ক্ষমতায় থাকতে পারতেন না, ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হতো জঙ্গিদের হাতেই। জঙ্গিদের শাসন চলতো। শেখ হাসিনা সেদিন না বাঁচলে বাংলাদেশ হয়ে উঠতো আরেক আফগানিস্তান বা পাকিস্তান।

২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পক্ষ থেকে এমন অবিশ্বাস্য কথাও প্রচার করা হয়েছিল যে আওয়ামী লীগ নিজেরাই জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন পেতে সেই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। ২০০৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদেও জোট সরকারের সাংসদেরা ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বিএনপি সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য আওয়ামী লীগ ছাড়াও প্রতিবেশী দেশ ভারতকেও দায়ী করেছিল।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সমর্থক বুদ্ধিজীবী চক্রও সভা-সেমিনারে একই সুরে বক্তব্য দিয়ে, পত্রিকায় কলাম লিখে সেই মিথ্যা প্রচারে সহায়তাও করেছিলেন। কিন্তু ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সত্য প্রকাশ পেয়েছে। জোট সরকারের আমলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার তখনকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ ধরনের মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করেছিলেন, প্রচার করেছিলেন। চারদলীয় জোট সরকারের গঠিত এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় কমিশনের প্রধান বিচারপতি জয়নুল আবেদীন তার প্রতিবেদনে প্রায় একই কথা বলেছিলেন।

আদালতে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার জেনেশুনে সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ঘটনা এবং উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠী ও প্রকৃত আসামিদের আড়াল করার চেষ্টা করেছিল। তৎকালীন জোট সরকারের উচ্চপর্যায়ের পরামর্শেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা, সিআইডি ও পুলিশের তখনকার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা হুজিকে দিয়ে এই ঘটনা ঘটিয়ে পরবর্তীতে আবার গ্রেনেড হামলার তদন্তকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিলেন।

জোট সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরকে সে সময়ে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা সম্পর্কে কোনো তদন্ত করতে নিষেধ করেছিলেন। বিগত সময়কালে যখন শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে হত্যা করতে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো অবিশ্বাস্য ভয়াবহ ঘটনাবলির সব তথ্য বের হয়ে এসেছে, তখন এটা সত্যি বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে পড়ে যে একটি নির্বাচিত সরকার ও নেতৃত্ব কীভাবে তাদের প্রতিপক্ষ শক্তিকে ধ্বংস করতে কী নির্লজ্জভাবে সত্যকে উল্টোপথে পরিচালিত করতে পারে!

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেছেন, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ‘প্রধান রূপকার’ তারেক রহমান। তিনি পেছন থেকে সব কল কাঠি নেড়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করতেই গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা করা হয়। আর এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পাকিস্তান থেকে গ্রেনেড, অর্থ ও প্রশিক্ষিত লোক আনা হয়।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। সাধারণ কোনো প্রেক্ষাপট নয়। এটি অনেক বড় চক্রান্তের একটি অংশ। এ মামলার আসামিরাও কোনো সাধারণ ব্যক্তি নন। তারা প্রত্যেকেই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। এ ঘটনায় প্রত্যেক ব্যক্তিই জড়িত ও অপরাধী।

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা চালানো হয় মুলত দুটি কারণে। প্রথমটি হচ্ছে- বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নেতৃত্বকে হত্যা করা, দ্বিতীয়তটি হচ্ছে- বাংলাদেশকে পাকিস্তান রাষ্ট্র বানানো। পৃথিবীর অনেক দেশেই রাজনৈতিক দাঙ্গা বা গোলামাল হয়ে থাকে। কিন্তু ২১ আগস্টের হামলা এটি কোনো সাধারণ ঘটনা নয়।

সন্ত্রাসী রাজনীতিক যখন যাবতীয় রাজনৈতিক মতাদর্শ হতে বিযুক্ত হয়ে পড়ে, তখন জঙ্গি হামলাই আদর্শ হয়ে উঠে। সেই সময়ের বিএনপির নেতৃত্বরও সে অবস্থাই হয়েছিল। জামাতসহ জঙ্গিদের সাথে নানা সমীকরণ মেলাতে মেলাতে এক সময় তারা বুঝতে শুরু করলেন দেশের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকতে হলে তাদের জঙ্গিদের আরও কাছে টানতে হবে। আর সে কারণেই জামাত-বিএনপি সরকারের পুরো সময়টিই ছিল জঙ্গিদের পৌষ মাস। হিংসা, সন্ত্রাস ও সশস্ত্র হামলার প্রতি আকর্ষণ কেবল বেড়েই চলেছিল।

আওয়ামীলিগের পক্ষে জঙ্গি জেহাদি মতাদর্শ ও কর্মসূচি সমর্থন করার প্রশ্ন নেই। তাই জঙ্গিদের সাথে তার বৈরিতা চলবেই। আওয়ামীলিগকে দমাতে, তথা অসাম্প্রদায়িক আদর্শকে ঠেকাতে বিএনপিকে বেছে নিতে হয়েছিল তালিবানি দাওয়াই। আর তার পথ ধরেই একুশে আগস্টের হামলা।

আজ বিচার হলো। কিন্তু আমরা জানি বিচার শেষ হয়নি। উচ্চ আদালত হয়ে বিচার সম্পূর্ণ হতে সময় লাগবে। অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত হোক। বিচার প্রার্থীর দীর্ঘশ্বাস আর যেন দীর্ঘায়িত না হোক।

Sharing is caring!

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

October 2018
S S M T W T F
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031  

সর্বশেষ খবর

………………………..