সিলেট ৩০শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৭শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ৭:৪৫ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৩, ২০১৯
ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : এক প্রতিবাদী যোদ্ধাকে হারিয়ে দিয়েছে একজন ওসি! একজন মা! একজন বাবাকে আমৃত্যু পোড়া লাশে জিইয়ে রাখলেন একজন ওসি! বোনের বিধ্বস্ত দেহ এবং কাটা ছেঁড়ার আয়োজনে উদ্যোক্তা যেন ওসি! যে ওসির ভূমিকায় অনেক প্রশ্নের জবাব মিলছেন না। হেরে যাওয়ার ১০ দিন আগে কাঁদতে কাঁদতে নুসরাত ওসিকে বলে গিয়েছিল— ‘স্যার! ওরা আমায় বাঁচতে দেবে না’। উত্তরে সেই ওসি বলেছিলেন, ‘এমন কিছু হয়নি যে এখনো তোমাকে কাঁদতে হবে।’ সত্যই নুসরাত কাঁদেনি, আশ্বাস-বিশ্বাসের স্থানকেই কাঁদিয়ে চলে গেল। নুসরাতের পোড়া লাশ কবরে রেখে আসার পর থেকেই গত দুদিনে প্রশ্ন উঠেছে, কে সেই ওসি! খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। যিনি নুসরাতের মামলা নিয়ে নাটক করায় সমপ্রতি সোনাগাজী মডেল থানা থেকে প্রত্যাহার হয়েছেন। এর আগে ডজন ডজন নাটকের অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় ফেনী মডেল থানা ও ছাগলনাইয়া থানা ছাড়তেও বাধ্য হয়েছিলেন ওই ওসি। আরো জানা যায়, নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে হত্যার আগেই যৌন হয়রানির অভিযোগ করতে গিয়ে ফেনীর সোনাগাজী থানার ওসির কক্ষে আরেক দফা হয়রানির শিকার হতে হয়েছিল এইচএসসি পরীক্ষার্থী নুসরাতকে! ওসি নিয়ম ভেঙে জেরা করতে করতে গোপনে নুসরাতের বক্তব্য ভিডিও করেন। নুসরাতকে ধমক দিয়ে ওসি বলাতে চেয়েছিলেন— নুসরাত নিজেই অধ্যক্ষের কক্ষে যেত! ধমকের সুরে ওসির ভাষা ছিল এমন— ‘অধ্যক্ষ তোমাকে ডেকেছিল, নাকি তুমি ওখানে গেছিলা?’ এমন ঘটনার প্রেক্ষিতে আইনজীবীরা বলছেন, যৌন হয়রানির অভিযোগ করার সময় ওসির ভিডিও ধারণের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা করার সুযোগ রয়েছে নুসরাত পরিবারের। ওসির এ ধরনের আচরণের বিষয়ে পুলিশ কর্তৃপক্ষ বলছে, আইন না মেনে অভিযোগ করতে যাওয়া কারোর ভিডিও করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে। নুসরাতকে ডেকে নিয়ে মানসিক চাপ প্রয়োগ করে কথা আদায়ের ঘটনার ভিডিও ফাঁসে ফুঁসে উঠছে দেশের সচেতন মহল। দাবি উঠছে, ওসিকে এখনই আটক করতে। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, নুসরাত জাহান রাফিকে দিন-দুপুরে পরীক্ষাকেন্দ্রে পুড়িয়ে হত্যাকাণ্ডে জড়িত ও নেপথ্য খলনায়কদের সঙ্গে ওসি মোয়াজ্জেমের যোগসূত্র রয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালীর ইঙ্গিতেই ওসি নুসরাতকে থানায় ডেকে মানসিক চাপ প্রয়োগ করেছেন। নুসরাত অধ্যক্ষের রুমে যেত কি না এমন কথা আদায়ের চেষ্টায় প্রমাণিত হয়, ওসি নিজেই নুসরাত হত্যায় জড়িত। আগুনে পোড়ানোর ১০ দিন আগেই নুসরাত ওই শঙ্কার কথা ওসিকে বলেছিল। এর প্রেক্ষিতে ওসি মোয়াজ্জেম কী ভূমিকা নিলো? পরীক্ষাকেন্দ্রে পুলিশ পাহারায় হামলাকারীরা এত নিরাপদে কিভাবে ছিল? মানুষ পুড়িয়ে এত অল্প সময়ে কিভাবে স্থান ত্যাগ করল নুসরাত হত্যাকা্লের সঙ্গে জড়িতরা। এখন স্থানীয়দের মুখে মুখে নুসরাত হত্যাকা্লের পুরো মাস্টার প্ল্যান প্রত্যাহার হওয়া ওসি অবশ্যই জানত। ওসির ইশারায় অধ্যক্ষ সিরাজ ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা এলাকায় দাপট দেখিয়ে চলত। একাধিকবার সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে ছাত্রী-নিপীড়নের গুরুতর অভিযোগ উঠলেও তার কোনো সুরাহা করেনি ওই ওসি। এ ছাড়া নুসরাতের ওপর ভয়ানক এই আক্রমণের প্রতিবাদ ও বিচার দাবিতে যারাই রাস্তায় নেমেছেন, এমন সবাইকে ফোন করে ওসি সতর্ক করেছেন। মামলায় ঢুকিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়েছেন। ২৭ মার্চ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নুসরাত শ্নীলতাহানির অভিযোগ আনলেও বিষয়টিকে তেমন আমলে নেননি ওসি মোয়াজ্জেম। অভিযুক্ত সিরাজের বিরুদ্ধে মামলা নিয়েই তিনি নামকাওয়াস্তে ‘দায়িত্ব’ শেষ করেন। এমন ঘটনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পরিচালক (অভিযোগ ও তদন্ত) আল মাহমুদ ফায়জুল কবীর বলেছেন, ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী ও আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহানকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন, গত ২৭ মার্চ নুসরাতকে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার শ্লীলতাহানির চেষ্টার ঘটনায় মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসন দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা নিলে হয়তো নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়ার ঘটনা এড়ানো যেত। আল মাহমুদ বলেন, বেশ কয়েকজন ছাত্রী, অভিভাবক, শিক্ষক, পুলিশসহ অনেকের সাক্ষ্য নিয়েছেন। তদন্ত সাপেক্ষে তিনি বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন, যে ২৭ মার্চের ঘটনার সঙ্গে ৬ এপ্রিল নুসরাতের গায়ে আগুন লাগিয়ে দেয়ার যোগসূত্র রয়েছে।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, ভিডিও করার সময় নুসরাত দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছিলেন। বক্তব্য দেয়ার সময় অঝোরে কাঁদছিলেন। ওসি বারবারই ‘মুখ থেকে হাত সরাও, কান্না থামাও’ বলার পাশাপাশি তিনি এ-ও বলেন, ‘এমন কিছু হয়নি যে এখনো তোমাকে কাঁদতে হবে।’ ভিডিওতে দেখা যায়, থানার ভেতরে নুসরাতকে জেরা করা হচ্ছে ‘কিসে পড়ো? ক্লাস ছিল?’ ‘কারে কারে জানাইছ বিষয়টা?’ নুসরাত যখন জানান তাকে অধ্যক্ষ ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তখন প্রশ্ন করা হয়, ‘ডেকেছিল, নাকি তুমি ওখানে গেছিলা?’ পিয়নের মাধ্যমে ডেকেছিল বলে নুসরাত জানালে প্রশ্ন করা হয়, ‘পিয়নের মাধ্যমে ডেকেছিল? পিয়নের নাম কী?’ নুসরাত তখন পিয়নের নাম বলেন, ‘নূর আলম।’বক্তব্য দেয়ার সময় নুসরাত কাঁদতে থাকায় ভিডিও ধারণকারী তাকে ধমকের সুরে বলেন, ‘কাঁদলে আমি বুঝব কী করে, তোমাকে বলতে হবে। এমন কিছু হয়নি যে তোমাকে কাঁদতে হবে।’ ভিডিওর শেষে নুসরাতের কথা বলা শেষ হলে ধারণকারী বলেন, ‘এইটুকুই?’ আরও কিছু অশালীন উক্তির পাশাপাশি তাকে উদ্দেশ করে ওসি বলেন, ‘এটা কিছু না, কেউ লিখবেও না তোমার কথা। কিছু হয়নি। রাখো। তুমি বসো।’ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলিমের পরীক্ষার্থী নুসরাত। মাদ্রাসাটির অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা তাকে যৌন নিপীড়ন করেন। এ অভিযোগে নুসরাতের মা ২৭ মার্চ সোনাগাজী থানায় মামলা করলে অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করা হলেও শুরুতেই ঘটনাটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহের চেষ্টা করেছিলেন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। পরে মামলা তুলে নিতে বিভিন্নভাবে নুসরাতের পরিবারকে হুমকি দেয়া হয় অধ্যক্ষের পক্ষ থেকে।জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণেও রাফি বলেছেন, ‘আমার যাই হোক, দোষীরা যেন কোনোভাবেই ছাড় না পায়। আমি এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করব। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। সারা বাংলাদেশের কাছে বলব। প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলব। সারা পৃথিবীর কাছে বলব।’ টানা পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে গত বুধবার রাতে রাফি যখন না ফেরার দেশে চলে গেলেন, তখন কেঁদেছে লাখো মানুষ। রাফির প্রতি ভালোবাসা ও অপরাধীদের প্রতি চরম ঘৃণায় ভরে উঠেছে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। রাফির পরিবার এবং সচেতন মহলেরও এখন একটাই দাবি, রাফিকে যেসব কাপুরুষ আগুন দিয়ে ঝলসে দিয়েছে, তাদের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। ‘তনু, রাফিয়া, নুসরাত’ আগামীকাল আমি নই তো?’, ‘আমার বোন হত্যার বিচার করুন অথবা আমাকে হত্যা করুন’, ‘বার্ন ইউনিটে জ্বলছে বোনের লাশ, রাষ্ট্র কী করে ধর্ষকের মুক্তি চাস’ এমন স্লোগানে বিক্ষোভে-গণঅবস্থানে উত্তাল সারাদেশ।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd