গোলাপগঞ্জের সেই বিতর্কিত ওসি ফজলুল হক শিবলীর বদলী

প্রকাশিত: ৮:০১ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২০, ২০১৯

গোলাপগঞ্জের সেই বিতর্কিত ওসি ফজলুল হক শিবলীর বদলী

গোলাপগঞ্জ প্রতিনিধি :: গোলাপগঞ্জ মডেল থানার সেই বিতর্কিত ওসি ফজলুল হক শিবলীকে বদলী করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৮ই এপ্রিল) তাকে গোলাপগঞ্জ থানা থেকে ঢাকার পুলিশ হেড কোয়াটারে শাস্তিমূলক বদলী করা হলে গতকাল শুক্রবার গোলাপগঞ্জ থানা ত্যাগ করেন। শিবলী গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার থানায় ১০ বছর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯সালের ২১জুন বিয়ানীবাজার থানায় যোগদান করেন এবং ২০১৩সালের ১৯জুন প্রতিবেশি থানা গোলাপগঞ্জে যোগদান করেন। তার দায়িত্ব পালনকালে গোলাপগঞ্জ উপজেলায় চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যা, গুপ্ত হত্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছিল। ওই থানায় যোগদানের পর বিভিন্ন দুর্নীতির কারণে আলোচনা সমালোচনায় আসেন। মিথ্যা মামলার আসামী হওয়ার ভয়ে কেউই মুখ খোলার সাহস পায়নি।

থানায় যোগদানের পর সাধারণ মানুষকে অযথা ধরে এনে বিভিন্ন মামলার হুমকি দিয়ে মোটা অংকের অর্থ আদায়সহ নির্যাতন ও দুর্ব্যবহারের অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। প্রবাসী সাংবাদিকসহ কেউই তার হাত থেকে রেহাই পায়নি। তবে ওই ওসির হয়রানির শিকার হয়ে উপজেলার অনেক অসহায় লোকজন বিভিন্ন সময়ে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েছেন।

চলতি মাসের সিলেটের একটি স্থানীয় পত্রিকা- ‘সিলেটের দিনকাল’ ও ৩টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‌‌’ক্রাইম সিলেট ‘নিউজ মিরর ও সিলনিউজ বিডি’ একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর টনক নড়ে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের।

সেই প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘গোলাপগঞ্জের ওসি শিবলীকে নিয়ে নানা বিতর্ক’ ‘আট পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে প্রবাসীর মামলা’। ওই সংবাদের কয়েকটি বিষয় উপজেলার সাধারণ মানুষকে ভাবিয়ে তুলে।

বিশেষ করে, ২০১৭ সালের ৪ই এপ্রিল খাদিজা বেগম (১০) নামে এক কাজের মেয়েকে ধর্ষণের পর তাকে হত্যা করা হয়। সে সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর থানার ভাটি তাহিরপুর গ্রামের দিনমজুর আলী নূরের মেয়ে। ঘটনার প্রায় ৫ মাস পূর্বে গোলাপগঞ্জ উপজেলার বুধবারী বাজার ইউপির বণগ্রাম গ্রামের লন্ডন প্রবাসী মৃত মতিউর রহমানের স্ত্রী বেদেনা বেগমকে দেখা শোনা করার জন্য দেন নিহতের মা কুলছুমা বেগম। ঘটনার দিন রাত ৯টায় লন্ডন প্রবাসী পরিবারের একমাত্র ছেলে কামরুল ইসলাম (২৫) ঘরে একা থাকায় কাজের মেয়ে খাদিজাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে। ঘটনার দিন রাতেই গোপনে স্থানীয় প্রতিনিধিদের মেনেজ করে লাশ দাফনের চেষ্টা করলে এলাকার কিছু লোকের সন্দেহ হলে পুলিশকে খবর দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ নিহতের লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্ত শেষে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে। এসময় ওই হত্যাকান্ডের প্রমাণ পাওয়ায় মৃত মতিউর রহমানের ছেলে কামরুলকে আটক করা হয়। ঘটনার পরের দিন নিহতের মা বাদী হয়ে আটক কামরুলকে একমাত্র আসামী করে মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় পুলিশ কামরুলকে আটকের পর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর (অপারেশন) দেলোয়ার হোসেন সে খুন করেছে বলেও সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেন। মামলা দায়েরের পর শুরু হয় লন্ডনী পরিবারের টাকার খেলা। বিভিন্ন কৌশলে মামলার বাদীর কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে খুনি পরিবারের স্বজনরা জিম্মি করে রাখেন। এমনটাই জানা যায়, ২০১৮ সালে নিহত খাদিজার মায়ের সাথে আলাপ করে। ২০১৮ সালের ১১ই মেয়ের খুনি কামরুল ইসলাম (২৫)কে নির্দোশ বলে চূড়ান্ত রিপোর্ট আদালতে দাখিল করা হয়। পুলিশ ওই চূড়ান্ত রিপোর্টে পরবর্তীতে আর কোনো আসামীর নামও দেয়নি। আজ কেমন আছে সেই কাজের মেয়ে খাদিজার মা-বাবা। কেউ জানে না।

২০১৭ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর গোলাপগঞ্জ কৈলাশটিলার এলপি গ্যাস ফিল্ডের সরকারি কর্মচারী এমাদ উদ্দিন (৪৪)-এর বাড়ী থেকে বোতলজাত গ্যাস সিলিন্ডার জালিয়াতি করার সময় জালিয়াতির সরঞ্জামসহ তানভীর আহমদ (৩০) নামে এক শ্রমিককে আটক করে। এসময় ২৮০ (দুইশত আশি) টি গ্যাস সিলিন্ডার উদ্ধার করে পুলিশ। ওই শ্রমিক বরিশাল জেলার হিজলা থানার গুয়াবাড়ীয়া গ্রামের মৃত মোহাম্মদ আলী কাজির ছেলে। এলপি গ্যাস ফিল্ডের কর্মচারী এমাদ আটক শ্রমিক তানভীরসহ তার চাচাতো ভাইদের নিয়ে নিজ বাড়ীতে এক সিলিন্ডারের গ্যাস দিয়ে দুই সিলিন্ডার বানিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রতারণা করে আসছিলেন। ঘটনার দিন শুক্রবার বিকাল ৫টায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ সরকারি ওই প্লান্টের কর্মচারী এমাদের বাড়ী থেকে হাতে নাতে আটক করে। এমাদের ঘর থেকে এসব উদ্ধার হওয়ার বিষয়টিও সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেন ওসি শিবলী। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে সরকারি কর্মচারী এমাদসহ ৪ জনকে অভিযুক্ত করে জালিয়াতি ও প্রতারণা মামলা দায়ের করে। পরে ২৩ নভেম্বর ২০১৭ইং পুলিশ এলপি গ্যাস ফিল্ডের সরকারী কর্মচারী এমাদ উদ্দিন ওই ঘটনার সাথে জড়িত ছিলেন না বলে মিথ্যা চূড়ান্ত রিপোর্ট আদালতে দাখিল করা হয়। ওই এমাদ গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ী ইউপির কিছমত মাইজভাগ গ্রামের রফিক উদ্দিনের ছেলে। এরআগে এলপি প্লান্টে বিভিন্ন দুর্নীতির কারণে আলোচনা সমালোনায় আসেন এমাদ। বিগত সময়ে সিলিন্ডার জালিয়াতি করার সময় উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ৫ জনের প্রাণহানি ঘটে।

২০১৫ সালের ৫ডিসেম্বর জকিগঞ্জে মাদক সেবনের সময় ফিরোজ নামে গোলাপগঞ্জ থানার এক এসআইসহ ৩ জনকে আটক করে স্থানীয় জনতা। ঘটনার দিন রাতে গোলাপগঞ্জ থানার ওই দারোগা তার সহযোগীদের নেশা করে মাতলামি করছিল। এসময় জকিগঞ্জ উপজেলার বড়পাথর মাদ্রাসা বাজার এলাকার লোকজন তাদের ফেন্সিডিলসহ আটক করেন। পরে জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ডেকে ওই এসআইসহ তাদের ৩ জনকে থানায় সোপর্দ করা হয়। ওই ওসির দায়িত্ব পালনকালে গোলাপগঞ্জ থানার এসআই ফিরোজ, এসআই মশিয়ুর, এসআই আশরাফ বিভিন্ন পুলিশ অফিসার মাদক সেবন ও দুর্নীতিসহ বিভিন্ন কারণে মিডিয়ায় আলোচনায় আসেন। অবশ্য এনিয়ে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাদের শাস্তিমূলক বদলীও করেছেন।

চলতি বছরের ১২ মার্চ গোলাপগঞ্জে পুলিশকে চাঁদা না দেয়ায় দুই পিকআপ শ্রমিকের হাতে হাতকড়া লাগিয়ে লাঠিপেটা করে গোলাপগঞ্জ থানা পুলিশ। এ ঘটনায় উত্তেজিত শ্রমিকরা সিলেট-জকিগঞ্জ সড়ক প্রায় ৪ ঘন্টা অবরোধ করে রাখে। পরে ওসি শিবলী ও গোলাপগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শ্রমিকদের সর্বোচ্চ বিচার পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিলে শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ তুলে নেয়। এ ঘটনার অভিযুক্তরা ওই থানায় এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছেন।

২০১৮ সালের ২৭শে নভেম্বর দুপুরে অজানা মামলায় ফলিক উদ্দিন (৪৫) নামে এক আমেরিকা প্রবাসীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তিনি গোলাপগঞ্জ উপজেলার বুধবারীবাজার ইউনিয়নের লামা চন্দরপুর গ্রামের মৃত আলতাব আলীর পুত্র। মিথ্যা এ মামলায় একমাস কারাভোগের পর তিনি জামিনে মুক্ত হন। বর্তমানে মামলাটি বিচারাধিন রয়েছে।

এ ঘটনায় ফলিক খাঁন বাদী হয়ে চলতি বছরের (১০/০২-২০১৯ইং) ওসি শিবলীকে প্রধান আসামী ও অন্যান্য পুলিসহ ১০ জনকে আসামী করে আদালতে মামলা করেন। আদালত মামলাটি তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সিলেট দুর্নীতি দমন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছেন। ওই মামলায় বাদী উল্লেখ করেন তাঁর প্রাইভেট কারসহ তাকে আটক করার পর সাথে থাকা প্রায় ২লক্ষ টাকা থানা পুলিশ নিয়ে যায়। নিজের ব্যক্তিগত বিশেষ কাজে তিনি প্রাইভেট কারযোগে গোলাপগঞ্জে আসেন।

চলতি সপ্তাহের গত ১এপ্রিল দিবাগত রাত আড়াইটায় গোলাপগঞ্জ ভাদেশ্বর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি লুৎফুর রহমান বাড়ীতে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ১০/১২ জনের মুখোশ পরা ডাকাতদল বাড়ীতে একা থাকা ওই আওয়ামী লীগ নেতাকে বাথরুমে আটকিয়ে ২৫ ভরি স্বর্ণলংঙ্কা ও নগদ টাকাসহ ১৫ লাখ টাকার মালামাল লুট করে। এ ঘটনার খবর পেয়ে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপি আইন-শৃঙ্খলা অবনতির জন্য ক্ষোভ ঝাড়েন।

গেল মাসের ৩০মার্চ গোলাপগঞ্জ পৌরসভার কদমতলী বাজার এলাকায় ৩টি দোকান চুরি হয়। চোরচক্রের সদস্যরা দোকানের সামনের তালা ভেঙে নগদ টাকাসহ প্রায় ৪লাখ টাকার মালামাল চুরি করে।

চলতি বছরের ২২মার্চ নিখোঁজের ৩দিন পর আব্দুস শহীদ (৪৫) নামে এক দিনমজুরের গলাকাটা ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সে উপজেলার লক্ষিপাশা ইউপির নিমাদল পূর্বপাড়া গ্রামের মৃত দাইমুল্লাহ আলীর ছেলে। এ ঘটনা নিহতের পরিবার মামলা করলেও আসামীরা প্রভাবশালী হওয়ায় সু-বিচার পাওয়া নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছে।

বিগত ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারী গোলাপগঞ্জ পৌর চৌমুহনীতে ব্যবসায়ী ও সিএনজি শ্রমিকদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে এ ঘটনায় তিনটি মামলা হয়। শ্রমিক বাদী মামলায় কাওছার নামে স্থানীয় এক সাংবাদিককে আসামী করা হয়। তিনি ওই মামলায় এখনও আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন বলে মহাপুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি)’র কাছে দেওয়া একটি অভিযোগ সূত্রে জানা যায়। ওই মিথ্যা মামলার সু-বিচার পাওয়ার আশায় সিলেট পুলিশ সুপার ও ডি.আইজি বরাবর একটি অভিযোগও দিয়েছেন।

২০১৮সালে প্রায় ৮টি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। এই বছরটি ছিল উপজেলাবাসীর কাছে আলোচিত-সমালোচিত। অনেক হত্যাকান্ডে ছিল রহস্যে ঘেরা। সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রত্যাশি আমির হত্যাকান্ড ও মুহিবুর হত্যাকান্ডের ঘটনা। রহস্যঘেরা ছিল অজ্ঞাত যুবতির গলা কাটা লাশে। এ ঘটনার এখনও কোন ক্লু উদঘাটন হয়নি। ওই আলোচিত বছরে যারা খুন হলেন, দিনমজুর আছবার, গৃহবধূ শাম্পু, পরীক্ষার ফল প্রত্যাশি আমির, কৃষক আতিকুর, মাদক ব্যবসায়ী লিপন, ব্যবসায়ী মুহিবুর, দিনমজুর আজমল আলী ও অজ্ঞাত মহিলা।

২০১৭ সালের বছর জুড়ে ঘটেছে ১৩টি হত্যাকন্ড। ৫টি আত্মহত্যা ও ২টি রহস্যজনক মৃত্যু ও ২টি বড় ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা। তাছাড়া ২০১৪, ২০১৫, ২০১৬ সালে ওই ওসির আমলে হত্যাকান্ড, আত্মহত্যা, রহস্যজনক মৃত্যুসহ আরো প্রায় ৫০টি প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। ৫ বছরে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ অপরাধমূলক কর্মকান্ড ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।

এ ব্যাপারে সিলেট জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) মাহবুবুল আলমের সাথে আলাপ করা হলে তিনি বদলীর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

এদিকে ওসি শিবলীর বদলীর খবর শুনে উপজেলার ভুক্তভোগীদের মধ্যে স্বস্তি নেমে এসেছে। অনেকে তার বদলীর খবর শুনে একে অপরকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন। সব মিলিয়ে তার বদলীতে গোটা উপজেলায় স্বস্তি নেমে এসছে। শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) সকাল থেকে গোলাপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত ওসির দায়িত্ব পালন করছেন তদন্ত ওসি দিলীপ কান্ত নাথ।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

April 2019
S S M T W T F
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930  

সর্বশেষ খবর

………………………..