সিলেট ২২শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৯ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২৩শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ৪:৪৮ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২, ২০১৯
রংপুর বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় বাল্যবিয়ের কারণে বিয়ের বিষয়টি বুঝে ওঠার আগেই বালিকা বধূদের ঘর ভেঙেছে। এমন ভাগ্যবিড়ম্বনার শিকার মাজেদা, সুচিত্রা, বুলবুলি, মুনমুন আদরী, ফেরদৌসির মতো অসংখ্য মেয়ে।
নুতন করে বাঁচার শিক্ষা নিতে এখন তারা ‘আলোর ভুবনের’ বাসিন্দা। এমন ২১ বালিকা বধূর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প যেন এক অন্যজীবনের কাহিনী।
অদম্য এই ২১ কিশোরী আলোকিত ভুবনের সন্ধানে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবল চেষ্টায় শুরু করেছেন পথচলা। তাদের পথ দেখাচ্ছেন রংপুর নগরীতে আলোর ভুবন নামে একটি সেল্টার হোমের কর্মীরা।
গত ১০ বছরে এ পর্যন্ত মোট ৩২৬ জন কিশোরী এখান থেকে আলোর পথে ফিরে গেছেন। তারা এখন জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়ে সমাজের মূল স্রোতে ফিরেছেন। এদের সবার বাড়ি রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, রংপুর ও ময়মনসিংহের জামালপুর জেলার বিভিন্ন গ্রামে।
মাজেদা বেগম
একজন বালিকা বধূ মাজেদা বেগম (১৪)। চার ভাই-বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। তার বাড়ি লালমনিরহাট সদরে মোঘলহাট দুরাকুঠি কলমীপাড়া গ্রামে।
বাবা মানিক মিয়া ঢাকায় জাহাজে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। মা জামিরন বেগমও থাকেন ঢাকায়। ভাইবোনেরা থাকেন গ্রামে এক চাচার বাড়িতে। তার যখন বিয়ে, ঘর সংসার, স্বামী-স্ত্রী এসব বোঝার বয়স হয়নি, তখনি স্থানীয় দুরাকুঠি উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় প্রতিবেশী এক চাচার মাধ্যমে বিয়ে ঠিক হয়, লালমনিরহাট শহরের ডালপট্রি গ্রামের ভাংড়ি ব্যবসায়ী মোস্তফা মিয়া মিলন (১৮) নামের এক কিশোরের সঙ্গে।
প্রথমে বাবা-মা রাজি না থাকলেও প্রতিবেশী ওই চাচা বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে তাদের রাজি করেন। ২০১৮ সালে ওই ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিবাহিত জীবন সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিল না।
বিয়ের সময় নগদ ৭০ হাজার টাকাসহ আসবাবপত্র দেয়া হয়। বিয়ে ঠিকভাবে হলেও বিয়ের পরের দিনই শুরু হয় ঝামেলা। স্বামী মিলন বিয়ের পরের দিনই তাকে বাড়িতে রেখে ঢাকায় চলে যায়।
এ প্রসঙ্গে মাজেদা বেগম জানান, একমাস পর তার কাছে আসে। তখন প্রতিনিয়তই কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে চলত ঝগড়া। কারণ ছোট থেকেই তার স্বামী নেশায় আসক্ত ছিল।
শুধু স্বামী নন পুরো পরিবারই নেশাদ্রব্য বিক্রি ও সেবনের সঙ্গে জড়িত। এক সময় গাঁজার ব্যবসা করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরাও পড়ে। পরে কিশোর হওয়াতে তাকে যশোর কিশোর কারাগারে পাঠান হয়। বেশ কিছুদিন সেখানেই ছিলেন। পরে ছাড়া পেয়ে আবারও নেশা সেবন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
এতে বাধা দিতে গেলেই শুরু হয় তার ওপর মারধর-নির্যাতন। একপর্যায়ে স্বামীর নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে বাবার বাড়িতে চলে আসেন। বিয়ের নয় মাসের মাথায় পরিবারের সম্মতিতে কাজীর মাধ্যমে স্বামীকে তালাক দেন। চলতি বছরের জুলাই মাসে মাজেদা বেগম রংপুরে আলোর ভুবনে আসেন নতুন করে বাঁচতে শিখতে।
এখানে সেলাই, নকশিকাঁথা, মোমবাতি তৈরিসহ হাতের কাজের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এখন থেকে ফিরে সে নিজে এসব কাজ করে আর্থিক উপার্জন করবে। ভবিষ্যতে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে আবারও পড়াশোনা করার ইচ্ছা রয়েছে তার।
সুচিত্রা রানী রায়
সুচিত্রা রানী রায় (১৯), তার বাড়ি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলার চন্দ্রখানা গ্রামে। বাবা যোগেন চন্দ্র রায় পেশায় কৃষক। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়ে এক বিয়ে বাড়িতে একই উপজেলার রাবাইটারি গ্রামের দুলাল চন্দ্র রায় নামের এক ছেলের সঙ্গে তার পরিচয়।
সেই পরিচয়ের সূত্র ধরে গড়ে উঠে প্রেমের সর্ম্পক। তাদের সম্পর্ক বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়। দুই পরিবারের সম্মতিতে এসএসসি পাস করে ২০১৬ সালে তাদের বিয়ে হয়। স্বামী পেশায় একটি কসমেটিকস্ কোম্পানির সেলসম্যান। বিয়ের পর কিছুদিন সংসার জীবন ভালো চলছিল।
ও ফুলবাড়ি ডিগ্রি কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হয়। সংসার ও পড়াশোনা দুটোই চলতে থাকে। এরই মধ্যে সংসার জীবনে শুরু হয় নানা সংকট। নেশা করে স্বামী তাকে মারধর করত। নেশা সেবনে বাধা দিলেই নেমে আসত তার ওপর নির্যাতন। দিন দিন নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়।
সুচিত্রা রানী রায়ের মতে, বিষয়টি পরিবারকে জানালে ঘটে আরও বিপত্তি। তার যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয় পরিবারের সঙ্গে। এরই মধ্যে এক ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। স্বামীর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এ বছরই বাবার বাড়িতে ফিরে আসে।
পরে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের মাধ্যমে বিষয়টি সামাধান করা হয়। এইচএসসি পাস করে। কিন্তু নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে কুড়িগ্রাম আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করে।
মামলা চলমান রয়েছে। আলোর ভুবনের সংবাদ জেনে এখানে সেলাই, হাতের কাজ, পুঁতি, মোমবাতি বানানোসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে।
শারমিন আক্তার
এদিকে দিনাজপুরের বিরল উপজেলার মাধববাটি গ্রামের দরিদ্র কৃষক আজিজুল হকের মেয়ে শারমিন আক্তার। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট। বর্তমানে তার বয়স ১৯ বছর। ২০১৪ সালে বুনিয়াতপুর সিনিয়র আলিম মাদ্রাসায় সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয় একই উপজেলার বিষুপুর গ্রামের হোটেল ব্যবসায়ী রেজাউল ইসলামের সঙ্গে।
পারিবারিক অভাবের কারণে তার এই বিয়ে হয়। বিয়ের সময় নগদ দেড় লাখ টাকাসহ স্বর্ণালংকার, আসবাবপত্র ও একটি গরু দেয়া হয়। বিয়ের পর কিছুদিন ভালো চললেও পরে শুরু হয় ঝগড়া-বিবাদ। বিয়ের পূর্বেই স্বামী নেশায় আসক্ত থাকার কারণে এই ঝগড়া-বিবাদ বাধে। শুরু হয় নানা ধরনের নির্যাতন।
এরই মধ্যে তাদের সংসারে আসে নতুন অতিথি। জন্ম নেয় এক ছেলে সন্তান। নাম রাখা হয় সিহাব বাবু। ছেলের বয়স এখন ৩ বছর। এরই মধ্যে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেলে বাবার বাড়িতে চলে আসেন শারমিন। ২০১৮ সালে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে তালাক হয় তার। দুই লাখ টাকা দেন মোহর হলেও স্বামীর পরিবার তাকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দেয়।
শারমিন আক্তার বলেন, মামলা করতে চাইলেও দারিদ্র্যতার কারণে মামলা করতে পারেননি। বর্তমানে সেল্টার হোমে প্রশিক্ষণ নিয়ে হাউস কিপিং পদে কর্মরত রয়েছি। প্রতি মাসে ৪ হাজার ৫০০ টাকা বেতন পাই। গ্রামে গিয়ে অন্য মেয়েদেরও প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করে তুলব।
বুলবুলি আক্তার
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলার বুলবুলি আক্তার (১৯)। দুই ভাই-বোনের মধ্যে বড়। ২০১৬ সালে স্থানীয় অনন্তপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তার বিয়ে হয় তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বয়সে বড় আলমগীর হোসেনের সঙ্গে। তার বাড়ি পার্শ্ববর্তী নাগেশ্বরী উপজেলার নাখারগঞ্জ গ্রামে। পেশায় একজন মুদি ব্যবসায়ী।
বিয়েতে বুলবুলি রাজি না থাকলেও পরিবারের চাপে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। এক বছর যেতে না যেতেই যৌতুকের জন্য শুরু হয় তার ওপর নির্যাতন। পরে ঢাকায় গিয়ে স্বামী-স্ত্রী মিলে চাকরি করেন। সেখানেও নির্যাতনে শিকার হন। কারণ স্বামী মাদক সেবক ও অন্য এক নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে। বু
লবুলি আক্তারের মতে, এর প্রতিবাদ করায় তাকে মারধর করাসহ নানাভাবে নির্যাতন করত। এরই মধ্যে গত কোরবানির ঈদে তিনি বাবার বাড়িতে এলে তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায়। ২০১৮ সালে তাদের তালাক হয়। এখানে সেলাই, হাতের কাজ, মোমবাতি, ঠোঙা, শোপিজসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নেন।
নবম শ্রেণিতে ছিলাখানা ভোকেশনাল উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে ভর্তি হয়েছেন। পরিকল্পনা রয়েছে আগামীতে লেখাপড়ার পাশাপাশি হাতের কাজ করে স্বাবলম্বী হবেন। অন্যদেরও প্রশিক্ষণ দেবেন।
শুধু মাজেদা, বুলবুলি, শারমিন, সুচিত্রা নয়, আরও অনেকেই। তাদের মতো আরপিনা বেগম, তাছলিমা খাতুন, মৌসুমী আক্তার, বিলকিস খাতুন, আম্বিয়া খাতুন, তাছলিমা খাতুন, মোসলেমা খাতুন, মালা খাতুন, ফেরদৌসী বেগম, মুনমুন আক্তার, খালেদা আক্তার, আদুরী আক্তার, শেফালী বেগম, স্বপ্না খাতুন ও জোসনা খাতুন একই রকম ভাগ্যবিড়ম্বনার শিকার। যে সময় তাদের লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা সেই কিশোরী বয়সে তাদের বিয়ে হয়।
বিয়ের পর সংসার টেকেনি। স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ির অত্যাচার আর যৌতুকের টাকা পরিশোধ না করতে পেরে শেষ পর্যন্ত ফিরে এসেছেন বাবার বাড়িতে। স্বামী পরিত্যক্তা এসব কিশোরী-তরুণীকে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন ও আলোর পথ দেখাচ্ছে রংপুরের আরডিআরএস পরিচালিত আলোর ভুবন।
আলোর ভুবনের জীবন দক্ষতা প্রশিক্ষণ শাকিলা বেগম জানান, সংস্থাটি তাদের নিজস্ব কর্মী বাহিনীর মাধ্যমে গ্রাম থেকে এসব কিশোরী-তরুণী স্বামী পরিত্যক্তা নারীদের এনে বিভিন্ন মেয়াদে ব্লক বাটিক, হস্ত কুটির শিল্প, মোমবাতি বানানো, সেলাইসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছেন।
তাদের উদ্বুদ্ধ করছেন নিজের পায়ে কীভাবে দাঁড়ান যায়। যদি কেউ লেখাপড়া করতে আগ্রহ দেখায় সে ক্ষেত্রে লেখাপড়ার সার্বিক সহযোগিতাও করা হচ্ছে। চাকরির ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd