সিলেট ৩০শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৭শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ১:২২ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৮, ২০১৯
স্টাফ রিপোর্টার :: চলতি বছরের গত ২৭ সেপ্টেম্বর সিলেটে সড়ক জোন অফিস ভবণের নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন শেষে বক্তব্যে নম্বরবিহীন সিএনজি চালিত অটোরিকশা চলাচল বন্ধে প্রশাসনকে নির্দেশনা দিয়ে গেছেন সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এসব যানবাহন আমদানি বন্ধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কেও চিঠি দেয়া হয়েছে বলেও ওই সময় জানান মন্ত্রী।
কিন্তু সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর নির্দেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে সিলেট জেলার জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কানাইঘাট সড়কে প্রায় আড়াই হাজার অবৈধ রেজিস্ট্রেশনবিহীন (নম্বরবিহীন) সিএনজি চালিত অটোরিক্সা বিশেষ টোকেনের মাধ্যমে দেদারছে চলাচল করছে। মাঝেমধ্যে প্রশাসনের অভিযানে দু’চারটি নম্বরবিহীন অটোরিক্সা আটক হলেও অদৃশ্য কারণে অভিযানগুলো থেমে যায়! ফলে এই তিন সড়কে নম্বরবিহীন অটোরিক্সা চলাচলে বাধা থাকছে না কোথাও।
সরেজমিন অনুসন্ধান নামে টিম। উটে আসে সিলেটের জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কানাইঘাট উপজেলার তিন সড়কের টোকেন বাণিজ্যের প্রদানসহ সিন্ডিকেটের কয়েকজনের নাম।
জানা গেছে, এই তিন সড়কে রেজিস্ট্রেশনবিহীন সিএনজি অটোরিক্সার সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজারেরও বেশী। আর অবৈধ গাড়িগুলো চলছে বিশেষ টোকেন’র মাধ্যমে। টোকেন বাণিজ্য করে মাসে লাখ লাখ ও বছরে কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নিচ্ছে এই সিন্ডিকেট। অবৈধ এই কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে এ্যাকশন নিতে সাহস যেন কারই নেই!
টোকেন সিন্ডিকেট প্রদানের নাম নুরুল হক উরফে টোকেন নুরুল। সে জৈন্তাপুর উপজেলার ৫নং ফতেহপুর ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের বালিপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুল মনাফের পুত্র। এই প্রদানের ইশারায় এই তিন সড়কে দীর্ঘদিন দিন থেকে চলছে নম্বরবিহীন অটোরিক্সা। পরিচিতি শুধু টোকেন। তবে, টোকেন নুরুল বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, সদর উপজেলার একটি ইউনিয়ন পরিষদের এক চেয়ারম্যানের নাম।
জানা যায়, এই সড়কগুলোতে রেজিস্টেশনবিহীন অটোরিক্সা চলতে প্রতিটি সিএনজি অটোরিক্সাকে প্রতি মাসে কিনতে হয় ৫শ’ থেকে ১৫শ’ টাকার টোকেন। আদায়কৃত এই চাঁদা থেকে নম্বর ও রেজিষ্ট্রেশনবিহীন অবৈধ সিএনজি অটোরিক্সা চলাচলের জন্য বিআরটিএ এবং প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করা হয়ে থাকে বলে বিশ্বস্থ একটি সূত্র তা নিশ্চিত করেছে।
সরেজমিন অনুসন্ধান ও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টোকেন বাণিজ্যের মূলহোতা নুরুল হক ও তার গড়ে তোলা সিন্ডিকেটের কয়েকজন মিলে তাদের বড় একটি সিন্ডিকেট। এই তিন উপজেলার সব ক’টি সড়কের নিয়ন্ত্রকরা রেজিস্টেশনবিহীন সিএনজি অটোরিক্সা (অনটেষ্ট) গাড়িতে টোকেন লাগিয়ে দিলে সেটি চলাচলের জন্য বৈধ হয়ে যায়! সিএনজি অটোরিক্সা তাদের মাধ্যমে চলাচলে প্রথমে এককালীন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা চাঁদা নেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট প্রতিটি সিএনজি অটোরিক্সার জন্য একটি টোকেন বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই টোকেন অটোরিক্সার সামনের গ্লাসে লাগিয়ে দিলে গাড়িগুলো সড়কে চলতে আর কোনো অসুবিধা থাকেনা।
এই উপজেলাগুলোতে এমন অটোরিক্সার সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার যা অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, বিআরটিএ’র পক্ষ থেকে নতুন সিএনজি চালিত অটোরিক্সার নিবন্ধন বন্ধ থাকায় তিন উপজেলার সব সড়কের নম্বরবিহীন অটোরিক্সা চলাচলের জন্য টোকেন বাণিজ্য গড়ে তুলেন নুরুল হক ও তার বাহিনী।
শুধু তাই নয় নূরুল হক দাবী করেন সিলেটের প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ থানা পুলিশের সব সেক্টরে টোকেন বাণিজ্য করে আদায়কৃত টাকার ভাগ দিয়েই টুকেন ব্যবসার অনুমতি নিয়েছে। তাই তার দেয়া পরিচিতি টোকেন নিতে পারলেই জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কানাইঘাট রোডে অবৈধ নম্বরবিহীন অটোরিক্সা চলতে বাধা থাকেনা। অন্যথায় কেউই রেজিস্ট্রেশনবিহীন সিএনজি অটোরিক্সা চালাতে পারেবে না বলে জানায় কয়েকজন চালক।
তবে, থানা পুলিশের সাথে এব্যাপারে কথা হলে তারা টোকেন বাণিজ্যের বিষয়টি জানেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তারা।
গত শুক্রবার (২৪ অক্টোবর) সন্ধ্যায় দেখা গেলো নুরুল’র টোকেনের বাস্তব শক্তি। অনুসন্ধান থেকে ফেরার পথে শাহপরান (রহ.) থানাধীন সদর-জৈন্তিয়া সীমান্তে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড স্কুলের সামনে পুলিশ সিগনাল দেখে এখানে ঘন্টা খানেক থেমে যায় অনুসন্ধানি টিম।
ঘন্টাব্যাপী দেখা যায়, একের পর এক নম্বরবিহীন সিএনজি চালিত অটোরিক্সা সিলেট সদর উপজেলাধীন ‘পীরের বাজার ও সুরমা গেইট’ সিএনজি স্টেশনে গ্যাস নিতে আসা অটোরিক্সাগুলো পুলিশ সিগনালে পড়ে। কিন্তু সিএনজিতে থাকা যাত্রীদের তল্লাসী করে অবৈধ গাড়িগুলোর বৈধ কাগজপত্র যাচাই করা তো দুরের কথা চালককে একবার জিজ্ঞাসাও করছেন না পুলিশ সদস্যরা। শুধু সাইড করে যাচাই করা হচ্ছে বৈধ গাড়ির কাগজপত্র! ছাড় পাচ্ছে নুরুল টোকেন’র গাড়িগুলো!
এব্যাপারে কথা বলতে এগিয়ে যাওয়ার আগেই পুলিশ চলে যায়।
এদিকে, বৈধ সিএনজি চালক সমিতির নেতৃবৃন্দরা জানান, বিআরটিএ ও প্রসাশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের সাথে সক্ষতা থাকায় এই টোকেন বাণিজ্যের হোতাদের অবৈধ এ বাণিজ্য আজো বন্ধ হচ্ছে না। এদিকে এই সব রেজিস্ট্রেশনবিহীন (অনটেস্ট) সিএনজি অটোরিক্সার টোকেন ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য করে নিজেরা কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। অন্যদিকে এই টাকা টোকেন ব্যবসায়ীরা আত্মসাৎ করে প্রতিবছর সরকারের বিপুল অংকের কর ফাঁকি দিচ্ছে বলে মনে করছেন নেতৃবৃন্দরা।
সিলেট সদর উপজেলাধীন ‘পিরের বাজার ও সুরমা গেইট’ সিএনজি স্টেশনে গ্যাস নিতে আসা নম্বরবিহীন সিএনজি চালকদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলে প্রথমে অনেকে মূখ খুলতে রাজি হননি। পরে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা হয় বেশ কয়েকজন চালকের সাথে।
তারা জানান, বর্তমানে এই অটোরিক্সাগুলো বৈধ কাগজপত্র করার কোনো অনুমোধন নেই। তাই আমরা বাধ্য হয়েই নুরুল হকের কাছ থেকে টোকেন সংগ্রহ করে গাড়ির গ্লাসে লাগিয়ে চলছি। ফলে পুলিশ আমাদের ধরে না। প্রতি মাসে টোকেন বাদ কত টাকায় কিনতে হয় জানতে চাইলে তারা বলেন, প্রতি মাসে টোকেন বাবদ ১ হাজার থেকে ১৫ টাকা দিতে হয় নুরুলকে। কোনো কোনো চালকদের কাছ থেকে ৬-৮শ’ টাকা করে নেন।
এব্যাপারে জানতে টোকেন সিন্ডিকেট প্রদান নুরুল হকের মুটো ফোনে কয়েক দফা যোগাযোগ করা হলে সাংবাদিক নাম শোনার সাথে সাথে তিনি উত্তেজিত হয়ে এ প্রতিবেদককে হুমকি দিয়ে বলেন, আপনি কোন পত্রিকার সাংবাদিক। আমার টাকায় সিলেটের কয়েকটা পত্রিকা চলে। পরে ফোন কেটে দেন।
ফোন কেটে দিলে আবারও কল দেওয়া হয় নুরুলের মুটো ফোনে টোকেন বাণিজ্য ব্যাপারে আলাপকালে তিনি বলেন, এক সময় টোকেন বাণিজ্যের সাথে জড়িত ছিলাম, এখন আর নেই। এখন টোকেন বাণিজ্য করছেন সদর উপজেলাধীন এক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান।
তবে, এ বিষয়ে সরাসরি কথা হয় নুরুলের ছোট ভাই বাবুলের সাথে। টোকেন বাণিজ্যের কথা স্বীকার করে বাবুল জানায়, নুরুল ভাই টোকেন বাণিজ্য নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকেন। সিএনজি চালকরা টোকেন’র জন্য একের পর এক ফোন দিতেই থাকে। সেই ফোনের যন্ত্রণায় আপনাদের সাথে হয়ত কথা বলতে রাজি হননি।
কথার ফাঁকে বাবুল বলেন, নুরুল ভাইয়ের সাথে প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিকরা দেখা করেন আপনারও একদিন চলে আসুন। ব্যবস্থা একটা হবে!
কি ব্যবস্থা জানতে চাইলে কোনো সদোত্তর না দিয়ে ব্যস্ততা দেখিয়ে চলে যান বাবুল।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd