সিলেটে ৬শ’ অবৈধ পরিবেশ বিধ্বংসী ক্রাশার মেশিন

প্রকাশিত: ৭:১৫ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৩০, ২০১৯

সিলেটে ৬শ’ অবৈধ পরিবেশ বিধ্বংসী ক্রাশার মেশিন

ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : সিলেটের বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় ৬০৬টি অবৈধ পরিবেশ বিধ্বংসী ক্রাশার মেশিন চলছে। যা মোট বৈধ ক্রাশার মেশিনের প্রায় ৩ গুণ। এসব ক্রাশার মেশিন দিব্যি বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে প্রকাশ্যে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এতে পরিবেশ ধ্বংসের পাশাপাশি বাতাসে পাথর কণা ছড়ানো ও শব্দ দূষণে স্থানীয় মানুষের স্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হচ্ছে।

গত সোমবার বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) উদ্যোগে ‘স্টোন ক্রাশার মেশিনের অবৈধ ব্যবহার; জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের বিপর্যয় রোধে করণী’য় শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। বেলা আড়াইটায় নগরীর একটি অভিজাত হোটেলের হল রুমে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

এতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম বলেন, সিলেট পাথরের রাজ্য নয়, সিলেট প্রকৃতির লীলাভূমি। সিলেটের প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্য অনন্য। সেজন্য সিলেটকে ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে ‘প্রকৃতিকন্যা’ হিসেবে। তিনি বলেন, এই দেশ আমাদের। এই দেশ ও প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হবে। কিছু কিছু ব্যবসায়ী দেশ ও জনগণের কথা না ভেবে সিলেটের প্রকৃতিকে ধ্বংস করে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও ক্রাশার মেশিন চালাচ্ছে। যারা ভালো চাচ্ছে না তাদের বয়কট করতে হবে। তিনি অবৈধ পাথর উত্তোলন ও ক্রাশার মেশিন ব্যবহার বন্ধে প্রশাসনের সর্বাতœক কার্যক্রম অব্যাহত রাখার এবং এক্ষেত্রে সিলেট চেম্বারসহ সকলকে এগিয়ে আসার আহবান জানান।

সভাপতির বক্তব্যে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে পরিবেশ নোবেল খ্যাত গোল্ডম্যান এনভায়রনমেন্টাল প্রাইজ” ও ‎রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার‎প্রাপ্ত বেলার প্রধান নির্বাহী এডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সারাদেশের পাথর উত্তোলন থেকে সরকারের রাজস্ব আয় মাত্র ৩৬ কোটি টাকা। এই টাকার জন্য পরিবেশের এতো বড় ক্ষতি মেনে নেয়া যায় না। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বেলার সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক শাহ সাহেদা আখতার।
প্রবন্ধে বলা হয়, ক্রাশার মেশিন স্থাপন বন্ধের কথা বলা হলেও দিন দিন ক্রাশার মেশিনের সংখ্যা বাড়ছে। সিলেটের ৫টি উপজেলা সিলেট সদর, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কানাইঘাটে ২০১৩ সালে বৈধ ক্রাশার মেশিনের সংখ্যা ছিল মাত্র ৫২টি এবং অবৈধ ক্রাশার মেশিনের সংখ্যা ছিল ৬শ ৫৫টি। ২০১৪ সালে বৈধ ছিল ৪১টি এবং অবৈধ ছিল ৫শ ১১টি। ২০১৫ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় বৈধ ২শ ১৩টি ও অবৈধ ৬শ ৬টিতে। এছাড়া, দক্ষিণ সুরমায়ও কিছু ক্রাশার মেশিন রয়েছে বলে পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, এসব ক্রাশার মেশিন জনবসতি, বসতঘর, বিদ্যালয়, মসজিদ, বাজারসহ জনসমাগম স্থানে স্থাপিত। ফলে এগুলো থেকে উৎপন্ন বিপুল পরিমাণ পাথর কণা বাতাসে ছড়াচ্ছে এবং মেশিনের অবিরাম বিকট শব্দে স্থানীয়দের স্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে চলেছে। স্থানীয়রা বিভিন্ন রোগে ভুগছেন এবং শিশুরা শ্বাসকষ্ট, বধির ও মস্তিষ্কের নানা সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন।

সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এডভোকেট ইইউ শহীদুল ইসলাম সভা শেষে ধন্যবাদ বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে সিলেটের সকল স্তরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। প্রশাসনিক কর্মকর্তা, বিদ্যুৎ বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, সমাজকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেন। তবে, পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন শেষে উন্মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় জনসমাগম স্থানে ক্রাশার মেশিন স্থাপন, অবৈধ ক্রাশার মেশিনে বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গা ঘেঁষে মেশিন স্থাপন, মেশিনের বিকট শব্দ ও পাথর কণায় ধূসর বাতাসে স্থানীয়দের স্বাস্থ্যহানি, পাথর উত্তোলন করে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত স্থানগুলো ধ্বংস করা, প্রশাসনের মাধ্যমে মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন।

জবাবে প্রধান অতিথি জেলা প্রশাসক অভিযান পরিচালনায় বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতে মামলা থাকায় পাথর উত্তোলন একবারে বন্ধ করা যায় না। যখনই অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও ক্রাশার মেশিন চালানো হয় তখনই অভিযান চালিয়ে সেগুলো ধ্বংস করা হয়। কিন্তু, একেবারে বন্ধ করা যায় না। তিনি বলেন, পাথর উত্তোলন ও আমদানীর কোন সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের মোট চাহিদার প্রায় ৮০ ভাগ পাথরই আমদানী করা হয়। মাত্র ২০ ভাগ পাথর উত্তোলন করা হয়। এর জন্য পরিবেশ ও মানুষের ক্ষতি না করে সেই ২০ ভাগ পাথর আমদানী করলে ভালো হয়।

‘সিলেট থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি রয়েছে’-উল্লেখ করে তিনি বলেন, গত ডিসি সম্মেলনের সময় তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে এ ব্যাপারে কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী প্রয়োজনে সেসব বন্ধ করার পক্ষে মত দেন। শিগগিরই ক্রাশার মেশিন বিক্ষিপ্ত স্থান থেকে এক জায়গায় নিয়ে আসা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ক্রাশার মেশিন জোন স্থাপনের পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের। এরই মধ্যে গোয়াইনঘাটে ১৩৩ একর জমি ক্রাশার মেশিন জোন স্থাপনের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে। অনুমতি পেলেই বরাদ্দ দেয়া হবে। তখন সবগুলো ক্রাশার মেশিন জোনের ভিতরে নিয়ে আসা হবে। তিনি পাথর উত্তোলন বন্ধের পক্ষে মত দিয়ে বলেন, পাথর উত্তোলন পুরোপুরি বন্ধ করা না গেলে পাথরখেকোদের থামানো কঠিন। যখনই তাদের বাধা দেয়া হয় তখনই তারা হাইকোর্টে মামলা করে দেয়। সিলেট পর্যটনের উর্বরক্ষেত্রে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পাথর উত্তোলন এলাকাগুলো পর্যটনের দর্শনীয় স্থান। পাথর উত্তোলন বন্ধ করা গেলে এবং পর্যটন সুবিধা বৃদ্ধি করা গেলে পর্যটন সমাগম বাড়বে। এতে স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পাথরখেকোরা জাফলং ধ্বংস করে দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নব্বই সালের দিকে প্রথম তিনি যখন জাফলং গিয়ে ছিলেন তখন অপূর্ব জাফলং দেখে বিমোহিত হয়েছিলেন। কিন্তু, দ্বিতীয়বার যাওয়ার পর মনে হয়েছে আর কোনদিন তিনি জাফলং যাবেন না। অবৈধ ক্রাশার মেশিনে বিদ্যুৎ সংযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, জেলা প্রশাসনের মাসিক সমন্বয় সভায় এ ব্যাপারে বার বার বিদ্যুৎ বিভাগকে তাগাদা দেয়া হচ্ছে। অনেক সময় অভিযানে গিয়ে দেখা যায় সবগুলোতেই বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। এব্যাপারে তিনি আবারো পল্লী বিদ্যুৎ ও পিডিবির সাথে কথা বলবেন বলে জানান।

সিলেটে পাথর উত্তোলন বন্ধ সম্ভব উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক বলেন, এখানকার শ্রমিকদের মধ্যে ২০ ভাগ শিশু। তাদের অবশ্যই সরিয়ে আনতে হবে। বাকিদের মধ্যে ৫০/৬০ ভাগ অন্য জেলা থেকে এখানে এসেছে। তাই পরিবেশ রক্ষায় ও জনগণের কল্যাণে দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হলে পুরো এলাকার চেহারাই বদলে দেয়া সম্ভব।

সভাপতির বক্তব্যে বেলার প্রধান নির্বাহী এডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জাফলংকে ‘পরিবেশগত সংকটাপন্ন’ এলাকা ঘোষণার দাবি জানিয়ে বলেন, প্রকৃতি একবার ধ্বংস হলে তাকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। নগণ্য সুবিধার জন্য এতবড় ক্ষতি ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাস্তবতার মধ্যে পড়ে না। তিনি বলেন, জাফলংকে যে ভাবে ধ্বংস করা হয়েছে তাকে আবার ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব। যদি ফিরিয়ে আনতেও হয় তবেও দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হবে।

তিনি বলেন, পরিবেশ রক্ষায় তিনি মামলা করেছিলেন। পরে তার বিরুদ্ধে তারা হাইকোর্টে ৬টি মামলা করে। এ ব্যাপারে অভিযান চালাতে গেলে তারা তখন দেখায় হাইকোর্টের পৃথক নির্দেশনা আছে। তিনি এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে আবেদন করে এটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে সবগুলো মামলা একত্রে এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন।

কর্মশালায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ^জিৎ কুমার পাল, সিলেট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহুয়া মমতাজ, সিলেট প্রেসক্লাব সভাপতি ইকরামুল কবির, ইঞ্জিনিয়ার ফজলুল করিম, মোঃ নাসিম হোসাইন, শাবি শিক্ষক আবুল কাশেম উজ্জল, এডভোকেট ইরফানুজ্জামান চৌধুরী, এডভোকেট কামাল হোসেন, এডভোকেট মোহিত লাল ধর, কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের প্রফেসর মোতাহার হোসেন, এডভোকেট ফারহানা রব ও শাবি শিক্ষক ড. ফারজানা, ফয়েজ আহমদ প্রমুখ।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..