সিলেট ২১শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৮ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২২শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ৬:২৯ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৭, ২০১৯
ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : কেন্দ্রের নির্দেশনা অমান্য করেই সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হল দুর্নীতির মামলায় পলাতক আসামি রাজাকারপুত্র লিয়াকত আলীকে। ৩ ডিসেম্বর পূর্বের কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কামাল আহমদকে সভাপতি ও লিয়াকতকে সম্পাদক করে ৭১ সদস্যের কমিটি অনুমোদন দেয়া হলেও এতদিন তা গোপন রাখা হয়।
শুক্রবার গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে সস্পাদক হিসেবে লিয়াকতের নাম দেখে তৃণমূল আ’লীগে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। তারা বলছেন, লিয়াকতকে সম্পাদকের পদ দেয়ার মধ্যদিয়ে কেন্দ্রের নির্দেশনা লঙ্ঘন করা হয়েছে। এর আগে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক চিঠিতে বলেছেন, নতুন কমিটিতে যেন দুর্নীতিবাজ, অনুপ্রবেশকারী, বিতর্কিত ও রাজাকার পরিবারের কোনো সদস্যকে না রাখা হয়।
৩ ডিসেম্বর গোপনে এ নতুন কমিটি অনুমোদন দেন সিলেট জেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। ৫ ডিসেম্বর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের আগের রাতেও তারা বলেছিলেন, জৈন্তাপুর নিয়ে কেন্দ্রের নির্দেশের অপেক্ষায় আমরা। তবে শুক্রবার গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায় ৩ ডিসেম্বরই জেলা আওয়ামী লীগ কমিটি অনুমোদন দিয়েছেন। তবে সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেছেন, বিতর্কিত কাউকে উপজেলায় পদ দেয়া হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে নবগঠিত জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, পূর্বের কমিটি যে সব কমিটি অনুমোদন দিয়েছে সেখানে নতুন কমিটির কিছু করার নেই। তবে কেন্দ্রের নির্দেশনা পেলে অবশ্যই বিতর্কিতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
লিয়াকত আলীকে নিয়ে নতুন কমিটির বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী যুগান্তরকে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতিবাজ, বিতর্কিতদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন তাতে দেশের মানুষের মনে আশার সঞ্চার হয়েছে। কিন্তু সেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দুর্নীতিবাজ, খুনের মামলার আসামিদের দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ যারা দিয়েছেন তারা দলীয় প্রধানের ইচ্ছার সঙ্গে বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। অবশ্যই বিতর্কিত নেতাদের অপসরান করা উচিত। তা না হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে না।
এ ব্যাপারে জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ কমিটির গঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট শাহ ফরিদ যুগান্তরকে জানান, আমাকে কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু জননেত্রী শেখ হাসিনার দলকে দুর্নীতিমুক্ত ও কুলষমুক্ত করার যে নির্দেশনা রয়েছে তা লঙ্ঘন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই অন্যান্য নেতাদের চাপ থাকলেও রাজাকারপুত্র ও দুর্নীতি মামলার আসামি লিয়াকত আলীর নাম আমি নিজের হাতে না লিখে জেলার সভাপতি ও সম্পাদকের ওপর ছেড়ে দেই। সাধারণ সম্পাদকের স্থানটি ফাঁকা রেখেই স্বাক্ষর করেছি। এ বিষয়ে একটি নোটও দেয়া আছে।
এ বিষয়ে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, রাজাকারপুত্র লিয়াকতকে আওয়ামী লীগে এনেছে কে? আমিতো আনিনি। সে তো ২০১৫ সালেই সাধারণ সম্পাদক হয়েছে।
তবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কেন্দ্রের নির্দেশনা এলে তাকে অপসারণ করা হবে। একই কথা বললেন জেলা আওয়ামী লীগের নতুন সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান। তিনি বলেছেন, উপজেলাগুলোতে বিতর্কিতদের নিয়ে কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত পেলেই ব্যবস্থা নেবেন তারা। এ বিষয়ে সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ যুগান্তরকে জানান, বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখব। অভিযোগ সত্য হলে অবশ্যই তাকে অপসারণ করা হবে।
কে এ লিয়াকত আলী : জৈন্তাপুর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের মতে লিয়াকত আলীর বাবা ওয়াজিদ আলী টেনাই ছিলেন রাজাকার। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়েও কোনোরকম দিনাতিপাত করত তার পরিবার। প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকায় লিয়াকত স্থানীয় একটি বিলের পাহারাদার হিসেবে কাজ করতেন। ১৯৯২ সালে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা তাকে তৎকালীন এমপি বর্তমানে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদের হাতে তুলে দেন।
লিয়াকতকে তখন বাসার কাজ দেয়া হয়। পরে তিনি ইমরান আহমেদের গাড়িচালকের দায়িত্ব পান। ১৯৯৬ সালে ইমরান আহমেদের কৃপায় জৈন্তাপুর আওয়ামী লীগের কমিটিতে প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পান তিনি। সেই থেকে আওয়ামী লীগে যাত্রা শুরু তার।
২০০৩ সালে তিনি ইমরান আহমেদের পিএসের দায়িত্ব পান। এরপর থেকেই তার নেতৃত্বে জাফলং পাথর কোয়ারিতে চলে ধ্বংসযজ্ঞ। ২০১৫ সালে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান লিয়াকত আলী। এরপর আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন লিয়াকত। ২০১৭ সালে শ্রীপুর পাথর কোয়ারি দখলে নিয়ে প্রবাসী খুনের মামলায় প্রধান আসামি করা হয় তাকে। এ বছরই তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক। ওই মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিলেও নিু আদালতে হাজির না হওয়ায় ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত তার জামিন বাতিল করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। পলাতক হিসেবেই বৃহস্পতিবার জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে কাউন্সিলর হিসেবেও দাওয়াত পান তিনি।
জেলার সব উপজেলার নেতারাই মঞ্চে ছিলেন। এমনকি জৈন্তাপুর উপজেলা আ’লীগের সভাপতিকে মঞ্চে দেখা গেলেও দেখা যায়নি লিয়াকতকে। জৈন্তাপুর আওয়ামী লীগের খসড়া কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক পদে লিয়াকত ছাড়াও মুহিবুর রহমান মেমের নাম ছিল। মেমের চাচা ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি, তার বাবাসহ পরিবারের সবাই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের লোক। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল তাদের বাড়ি।
তাদের বাড়িতে গিয়ে পরিবারের খোঁজ নিয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। তিনি ১৯৮৪ সালে জৈন্তাপুরে যুবলীগের রাজনীতি দিয়ে শুরু করেন। জৈন্তাপুর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিন বার। মুহিবুর রহমান ক্লিনম্যান হিসেবে পরিচিত। তাকে নতুন কমিটিতে রাখা হয়েছে প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। মুহিবুর রহমান মেম বলেন, রাজাকার পরিবারের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের পরিবারের পরাজয় হয়েছে এটাই বড় কষ্ট। জাতির পিতার কন্য জননেত্রী শেখ হাসিনা সারা দেশে বিতর্কিতদের অপসারণ করছেন। কিন্তু জৈন্তাপুরে তার প্রভাব পড়ল না। ত্যাগের বিপরীতে আর্থিক প্রভাবকে মূল্যায়ন করা হয়েছে। জননেত্রী বিষয়টি জানলে নিশ্চয়ই এর প্রতিকার হবে।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd