সিলেট ২রা এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৯শে চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ৩রা শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ৮:০০ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৮, ২০২০
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি :: সুনামগঞ্জের ছাতকে ইসলামপুর ইউনিয়নের হাঁদা টিলা পাথর খেকোদের আগ্রাসনে ধবংস স্তুপে পরিনণত হয়েছে। স্থানীয় একটি পাথর খেকো ও বৃক্ষ নিধনকারী চক্র এবং কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা মিলে টিলা কেটে পাথর উত্তোলন ও বাগানের গাছ কেঁটে উজার করে ফেলছে। ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে বন্ধ হচ্ছেনা এসব পাথর খেকো ও বৃক্ষ নিধনকারী চক্রের আগ্রাসন। ফলে সরকারি বনায়ন প্রকল্প, টিলা ও পরিবেশ ধবংস হচ্ছে।
ছাতক-দোয়ারাবাজার বন-বিট অফিস ও স্থানীয় সুত্রে জানা যায়, ২০০৬-২০০৭ সালে পরিবেশ ও দরিদ্র কৃষকদের আত্নকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের হাঁদা টিলাসহ কয়েকটি মৌজায় ও দোয়ারাবাজার উপজেলার নাছিমপুর মৌজায় ১৬.২০ হেক্টর ভূমিতে রীডল্যান্ড সমন্নিত সামাজিক বনায়ন প্রকল্প গ্রহন করা হয়। বনবিভাগ ৫০ ভাগ ও স্থানীয় উপকারভোগীদের ৫০ ভাগ অংশীদারের ভিত্তিতে ইউক্লিপটার্স, বেলজিয়াম, আকাশীসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ৩৩ হাজার বৃক্ষ রোপন করা হয়। কিন্ত কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা, বৃক্ষ নিধনকারী ও পাথর খেকো চক্র মিলে সৃজিত বাগানের গাছ কেঁটে উজাড় করে ফেলেছে। যার ফলে এ প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি। ৭৬০ একর ভূমি নিয়ে বিশাল এই হাঁদা টিলার অবস্থান। পুরো টিলা জুড়েই রয়েছে সরকারী বনায়ন। দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী পাথর খেকো চক্র টিলা কেটে পাথর উত্তোল করছে। সরকারী কয়েক হাজার মুল্যবান গাছ প্রতিনিয়ত চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে চোরেরা। শতাধিক শ্রমিক টিলা কেটে পাথর উত্তোলন করে বারকি নৌকা, বাল্কহেড ও ট্রলিগাড়ি পরিমাপে প্রতিদিনই বিক্রি করছে। সম্প্রতি ভ্রাম্যমান আদালত বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে ট্রলি জব্দসহ জরিমানা আদায় করা হলেও রাতের অন্ধকারে পাথর উত্তোল করা হচ্ছে। এসব জরিমানা শ্রমিকরদের নিকট থেকে আদায় করা হলেও পাথর খেকো মুলহোতারা থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। তবে স্থানীয়রা এসব পাথর খেকো ও বৃক্ষ নিধনকারী চক্রের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে নারাজ। হাঁদা টিলার সরকারী বনায়ন প্রকল্প ও পরিবেশ রক্ষায় আইনী পদক্ষেপ হিসেবে ২০১৭ সালে ২২ আগষ্ট তৎকালীন ছাতক উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাবিনা ইয়াছমিনকে আহবায়ক, বিট-বন কর্মকর্তা সালাহউদ্দিন ও ইসলামপুর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল হেকিমকে সদস্য করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। অভিযোগ উঠেছে এ কমিটি কেবল নামেই সীমা বদ্ধ ছিল। হাঁদা টিলায় এরই মধ্যে গড়ে উঠেছে কাচা আধাপাক প্রায় ৬৭টি অবৈধ স্থাপনা। এসব বসত বাড়ি থেকে পাথর খেকো চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা।
এদিকে ব্যক্তি মালিকানাধীন টিলা ক্রয় করে বৃক্ষ নিধন ও টিলা কেটে অবৈধ ভাবে পাথর উত্তোলন করে পরিবশে ধবংস করার অভিযোগ উঠেছে। জানা যায়, সম্প্রতি ছাতক পৌরসভার বাগবাড়ি গ্রামের মৃত. আব্দুস ছোবহানের ছেলে আব্দুস সহিদ মনার ব্যক্তি মালিকানাধীন উপজেলার রাজ গাঁও মৌজার জেএল নং-৭২, দাগ নং- ২২২২ এতে ১৭ একর বাগান রকম ভূমির মধ্যে ১ একর ৮২ শতক ভূমি (ছোবহান টিলা) ৬০ লাখ টাকায বিক্রির রফাদফা করেন। তার নিকট থেকে বাগান করার জন্য এই টিলা ক্রয় করেন উপজেলার কালারুকা ইউনিয়নের কালারুকা গ্রামের মৃত. ছদরুনুর তালুকদারের ছেলে রুহুল আমিন তালুকদার, কুমারদানী গ্রামের কুটি মিয়ার ছেলে রোপন মিয়া ও মানিকগঞ্জ জেলার মানিকগঞ্জ থানার ভাড়ারিয়া গ্রামের মৃত. হাসান আলীর ছেলে আক্তার হোসেন। গত ২০.০৫.২০১৯ ং তারিখে আব্দুস সহিদ মনাকে ৩০ লাখ টাকা প্রদান করেন রুহুল আমিন তালুকদার। গত ১৯.১১.২০১৯ ইং তারিখের মধ্যে অবশিষ্ট টাকা পরিশোধ করে ভূমি রেজিষ্টারী সম্পাদন করার কথা হয়। কিন্ত এরই মধ্যে রুহুল আমিন তালুকদার, রোপন মিয়া ও আক্তার হোসেন টিলার গাছ কাটা ও মাটি কুড়ে পাথর উত্তোলন করতে শুরু করেন। এ বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করেন আব্দুস সহিদ মনা। যার প্রেক্ষিতে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে জরিমানাও আদায় করা হয়। এর পর রুহুল আমিন তালুকদার আরো ১৫ লাখ টাকা প্রদান করেছেন জানান আব্দুস সহিদ মনা।
তিনি আরো বলেন, এ বিষয়ে গত ২০ জানুয়ারী ছাতক থানায় একটি লিখিত অভিযোগও দায়ের করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রুহুল আমিন তালুকদার এ প্রতিবেদকের সাথে অসৌজন্যমুলক আচরন করে বলেন, মুনাফা ছাড়া এত বিশাল অংকের টাকা আমি বিনিয়োগ কররো কেন ? তার (আব্দুস সহিদ মনা) নিকট থেকে শর্ত সাপেক্ষে জায়গাটা ক্রয় করেছি। এক শর্ত যে এই জায়গা আমি কাটা-ছিড়া করবো। তিনি আরো বলেন, আব্দুস সহিদ মনার এই জায়গাটা ব্যাংকে দায়বদ্ধ ছিল। তিনি দেউলিয়া হতে চলেছিলেন। ব্যাংক জায়গাটা নিয়ে যায়। আমার সাথে আনয়-বিনয় করে রোপন মিয়ার মাধ্যমে আমাকে ঢাকা থেকে নিয়ে যান। প্রথমে ৩০ লাখ টাকা দিয়ে বায়না পত্র করার পর দখল বুঝিয়ে দেওয়া হয়। পরে আরো ১৫ লাখ টাকা দিয়েছি। কিন্ত রেজিষ্টারী করে দিতে না চাওয়ায় ও পাথর উত্তোলনে বাঁধা দিলে ছাতক থানায় একটি জিডি করি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, টিলা কেটে পাথর উত্তোলন ও গাছ কাঁটার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের কোন অনুমতি নেই।
রোপন মিয়া ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে জরিমানা বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, গত ২০ জানুয়ারী ছাতক থানার এস আই পিপিএম হাবিব ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। আব্দুস সহিদ মনার নামে জায়গা নামজারি হয়েছে কিন্ত তিনি খরিদ সুত্রে মালিক। ওই দলিলটি তার কাছে চেয়ে না পাওয়াতে তল্লাশিতে দিয়েছি। দলিল পাওয়ার পর রেজিষ্টারী করা হবে।
গতকাল ২৫ জানুয়ারী ২০২০ ইং শনিবার সরেজমিনে হাঁদা টিলা এলাকা ঘুরে দেখা য়ায়, টিলায়-টিলায় গড়ে উঠেছে কাঁচা ও আধ-পাকা অবৈধ স্থাপনা। পাথর বহনকারী ট্রলি পরিবহনের জন্য বিভিন্ন টিলা কেটে করা হয়েছে সরু রাস্তা। অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করার পর সৃষ্ট বড় বড় গর্ত। বন-প্রহরীর ঘরের সামনে ও বারান্দায় ঝড়ে পড়া অসংখ্য গাছ পড়ে আছে। অবৈধ স্থাপনা নির্মান করে যারা রয়েছেন তাদের অনেকেই নাম পরিচয় বলতে নারাজ। কেউ কেউ বলেছেন বেড়াতে এসেছি। ঘরের মালিক বাহির আছেন। আমি কিছু জানিনা।
বাগান টহল ও অপরাদ দমন তার দায়িত্ব জানিয়ে বন-প্রহরী আবুল কাশেম বলেন, আমার দুজন এখানে আছি। আবু তালিব নামে অপরজন মামলায় সাক্ষ্য দিতে চট্রগ্রাম রয়েছেন। সমস্যাগুলো কতৃপক্ষকে অবগত করেছি। এত বিশাল এলাকা আমরা দুজন মাত্র প্রহরী অসহায়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হাঁদা টিলা গ্রামের নেছার আলীর ছেলে জয়নাল, মৃত. তোরাব উল্লাহর ছেলে দেলোয়ার হোসেন, কুমারদানী গ্রামের মৃত. হরমুজ আলীর ছেলে আকবর ও মাহমুদের নেতৃত্বে চলে আসছে অবৈধ ভাবে বৃক্ষ নিধন ও পাথর উত্তোলন কার্যক্রম। প্রতিবাদ করলে তার(বনপ্রহরী) উপরও হামলা করা হয়। এতে তিনি ছাতক থানায় লিখিত অভিযোগও দায়ের করেন। তিনি আরো বলেন, এখন আমি নিজেই নিরাপত্তা হীনতায় ভোগছি।
ছাতক উপজেলা বন-বিট কর্মকর্তা নিতেশ চক্রবর্তী বলেন, ২০০৬-২০০৭ সালে পরিবেশ ও দরিদ্র কৃষকদের আত্নকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে রীডল্যান্ড সমন্নিত সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের কার্যক্রম এখন নেই। জয়নাল, দেলোয়ার হোসেন, আকবর ও মাহমুদের বিরুদ্ধে ছাতক থানা ও সুনামগঞ্জ বন-আদালতে মামলা রয়েছে নিশ্চিত করে বন-বিট কর্মকর্তা নিতেশ চক্রবর্তী আরো বলেন, বন-বিট অফিসে জনবল সংকট রয়েছে। অবৈধ ভাবে স্থাপনা নির্মান করা ৬৭ টি পরিবারের তালিকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উর্ধতম কতৃপক্ষকে দেওয়া আছে।
এ বিষয়ে জানতে ইসলামপুর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল হেকিমের মোঠোফোনে একাধিক বার যোগাযোগ করা হলে তিনি রিসিব না করায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
ছাতক থানার এস আই হাবিবুর রহমান পিপিএম বলেন, আব্দুস সহিদ মনা কতৃক অভিযোগ প্রাপ্তির পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। যেহেতু অভিযোক্ত রুহুল আমিন তালুকদার ঢাকায় থাকেন তাই নিজ নিজ কাগজ পত্র দেখাতে আসতে বলা হয়েছে। এর আগ পর্যন্ত যেনো বাগানে কেউ কোন কার্যক্রম পরিচালনা না করেন বলা হয়েছে। ছাতক থানার ওসি মোস্তফা কামাল বলেন, অভিযোগের বিষয়টি জেনে নিশ্চিত হয়ে বলছি।
ছাতক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের ফোন নম্বরে যোযোগাযোগ করা হলে অফিস সহকারী জয় দেব নাম পরিচয় দিয়ে বলেন চলতি দায়িতে রয়েছেন দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুনিয়া সুলতানা। তিনি এখন অফিসে নেই। এ সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুনিয়া সুলতানা (চলতি দায়িত্ব) মোঠো ফোন নম্বর চাইলে জয় দেব বলেন তার হাতে এখন নম্বর নেই।
ছাতক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিভিন্ন সময় ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান পরিচালনা করে জরিমানা আদায় করছেন। বিষয়টি আগামী সমন্নয় সভায় আলোচনা করবো।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd