এবার সিলেটে হোটেলে কোয়ারেন্টিনে যুক্তরাজ্য প্রবাসীর বিয়ে, তথ্য গোপনের চেষ্টা

প্রকাশিত: ১:১৮ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ২৩, ২০২১

এবার সিলেটে হোটেলে কোয়ারেন্টিনে যুক্তরাজ্য প্রবাসীর বিয়ে, তথ্য গোপনের চেষ্টা

ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : সিলেট নগরের হোটেল ব্রিটানিয়ায় কোয়ারেন্টিনে থাকা ৯ প্রবাসী উধাও হওয়ার ঘটনায় যখন তোলাপড় চলছে তখন নগরের আরেক হোটেলে কোয়ারিন্টেন থাকা অবস্থায় এক প্রবাসী বিয়ে করছেন বলে জানা গেছে।

যুক্তরাজ্য ফেরত ওই প্রবাসী নগরের লামাবাজার এলাকার ‘হোটেল লাভিস্তা’তে কোয়ারেন্টিনে ছিলেন। সেই হোটেলেই বিয়ের আয়োজন করা হয়। এতে কনে ছাড়াও বাইরে থাকা আসা অনেক অতিথিরা অংশ নেন। গত ২০ মার্চ রাতে ঘটা করে এ বিয়ের আয়োজন হয়। চলে খানাপিনা।

জানা যায়, গত ১৮ মার্চ যুক্তরাজ্য থেকে সিলেটে আসা যাত্রীদের মধ্যে ১১ জনকে হোটেল লাভিস্তায় প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। এদের মধ্যে দুজন সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার জাঙ্গাইল এলাকার এক নারী (৪৮) ও তার ছেলে (২৮)। মা অবস্থান করেন ৪০১ নম্বর কক্ষে আর তার ছেলে অবস্থান করেন ৪০৬ নম্বর কক্ষে।

নিয়ম অনুযায়ী তারা সব ধরণের জনসমাগম এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে নির্ধারিত নিয়ম মেনে চলার কথা থাকলেও লাভিস্তা হোটেলে স্টেজ সাজিয়ে অনুষ্ঠান করে বিয়ে করলেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী ওই যুবক (২৮)। আর এ বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেন বাইরে থেকে আসা প্রায় ৫০ জন অতিথি। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ভূরিভোজও হয় হোটেলের রেস্টুরেন্টে। এরআগে গত ১৮ মার্চ বিকেলে একই হোটেলেই ‘এঙ্গেজমেন্ট’ অনুষ্ঠান হয়।

সূত্র জানায়, ছেলের বিয়ে উপলক্ষে বাইরে বের হয়ে নগরীর বিভিন্ন বিপনিবিতান থেকে কেনাকাটাও করেছেন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকা যুক্তরাজ্য প্রবাসী যুবকের মা। যার পুরোটাই হয়েছে হোটেল কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে। যার বিনিময় হোটেল কর্তৃপক্ষ আদায় করেছেন মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা।

ধামাচাপা দেয় হোটেল কর্তৃপক্ষ

এমন তথ্যের ভিত্তিতে সরেজমিনে সোমবার (২২ মার্চ) বিকাল ৪ টার দিকে হোটেল লাভিস্তায় গেলে কর্তৃপক্ষ তথ্য গোপনের চেষ্টা করেন। প্রথমে পুরো ঘটনা অস্বীকার করে ধামাচাপা দেওয়া শুরু করলেও পরে বেরিয়ে আসে আসল তথ্য।

প্রথমে হোটেল অভ্যর্থনার দায়িত্বে থাকা ব্যবস্থাপক তারেক আহমদ পুরো ঘটনা অস্বীকার করে বলেন, ‘এমন কোন ঘটনাই হয়নি। এমনকি এসব কক্ষে কোন প্রবাসীয় অবস্থান করছেন না।’

একই সাথে গত ১৫ এবং ২২ মার্চের হোটেলের বুকিং খাতার দুইটি তালিকা দেখিয়ে আর কোন প্রবাসী অবস্থা করছেন না বলে জানান তিনি। পরে অন্য একটি সূত্র থেকে ১৮ তারিখে হোটেল লাভিস্তায় আসা ১১ জনের তালিকা সংগ্রহ করে নাম এবং কক্ষ নম্বর মিলে যাচাই করা হলে দেখা যায় ৪০১ এবং ৪০৬ নম্বর কক্ষ্যে অবস্থান করছেন মা-ছেলে।

এমন তথ্য জানানোর পর হোটেল ব্যবস্থাপক তারেক আহমদ নানা টালবাহানা শুরু করেন। এক পর্যায়ে লাপাত্তা হয়ে যান তিনি। পরে প্রায় ঘন্টাখানেক পর আবার ফিরেন তিনি। এসময় তিনি বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার কথা অস্বীকার করলেও আকদ (বিবাহ রেজিস্ট্রি) হয়েছে বলে জানান।

বিয়ের পর কনে ৪০৬ নম্বর কক্ষেই বরের সাথে অবস্থান করছেন এমন তথ্য জানিয়ে হোটেলের সিসি ক্যামেরা ফুটেজ দেখতে চাইলে অপরগতা প্রকাশ করেন ব্যবস্থাপক।

লাভিস্তা হোটেলের ব্যবস্থাপক তারেক আহমদ বলেন, ‘বিয়ের অনুষ্ঠানের তথ্য ভুল। তবে আকদ হয়েছে (বিবাহ রেজিস্ট্রি)। এজন্য কাজিসহ ৪ থেকে ৫ জন মানুষ এসে তারা কেবল স্বাক্ষর নিয়েছেন। মূলত মানবিক দিক বিবেচনায় সম্পূর্ন স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাদেরকে এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে।’

কত তারিখ এবং কখন হয়েছে তা জানতে চাইলে ব্যবস্থাপক প্রতিবেদকের মোবাইল নম্বর রেখে পরবর্তী আধা ঘণ্টার মধ্যে জানাবেন বলে জানালেও পরে তিনি তা জানাননি। সন্ধ্যা ৭ টার ভেতর একাধিকবার ব্যবস্থাপকের মোবাইল নম্বরে কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

এ ব্যাপারে বর যুক্তরাজ্য প্রবাসী আব্দুল মুহি উদ্দিন ও তার মা ফাতেমা খাতুনের সাথে কথা বলতে চাইলে তাৎক্ষণিক সুযোগ না দিয়ে ফোনে কথা বলিয়ে দিবেন বলেও জানান হোটেল লাভিস্তার ব্যবস্থাপক তারেক আহমদ।

অনিয়মের তথ্য আছে গোয়েন্দা সংস্থার কাছে

প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের এমন আজব খবর কেবল এখানেই সীমাবদ্ধ না। অভিযোগ আছে নগরীর অধিকাংশ হোটেলের বিরুদ্ধে। এসব হোটেলে অবস্থানরত প্রবাসীরা হোটেল কর্তৃপক্ষকে ‘ম্যানেজ’ করে বের হন বাইরে। ঘুরেন, প্রয়োজনে স্বজনদের সাথে দেখা করেন। কেনাকাটাও করেন। যার পুরোটাই হয় হোটেল কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে।

এমন কর্মকাণ্ডের একাধিক অভিযোগ গোয়েন্দা সংস্থার কাছে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। সূত্র জানায় সম্প্রতি এমন অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২১ মার্চ প্রথমে আম্বরখানার ব্রিটানিয়া হোটেলে পরিদর্শনে যান গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই’র দুই কর্মকর্তা। দুপুর ২ টা ৩০ মিনিটের দিকে তারা হোটেলে গেলে হোটেলের ২০৩, ৬০৩ নম্বর কক্ষের দরজা বন্ধ দেখতে পান। তখন হোটেল কর্তৃপক্ষ জানান, ওই দুই কক্ষের লোকজন ঘুমিয়ে আছেন। পরবর্তিতে এনএসআইর পক্ষ থেকে তাদের ডাকার জন্য বলা হলে কথা পরিবর্তন করেন কর্তৃপক্ষ। এর পর থেকেই শুরু হয় টালবাহানা।

এসময় ফোনে কল দেওয়া হলে এসব কক্ষে অবস্থানকরা প্রবাসীরা জানান, তারা জকিগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছেন এবং সন্ধ্যায় ফিরবেন। এমন অবস্থায় সিলেটে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা নিয়ে চলছে সমালোচনা।

এ ব্যাপারে ব্রিটানিয়া হোটেলের ব্যবস্থাপক কাওসার খান বলেন, ‘সকালে একবার এবং রাতে একবার আমরা রুটিন চেক করি। ওইদিন সকালেও এসব প্রবাসীরা রেস্টুরেন্ট থেকে সকালের নাস্তা গ্রহণ করেছেন তাই আমরা ধরেই নিয়েছি তারা আছেন। কিন্তু দুপুরে হঠাৎ করে মনে হলো তারা হোটেলে নেই। তখন তাদের খোঁজ করা শুরু করলে এমন সময় এনএসআই এর এক সদস্য এসে উপস্থিত হন। তবে আমরাই প্রথমে তাদের অনুস্থিতি বুঝে খোঁজ করা শুরু করি।’

সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা গেলেন কি করে এমন প্রশ্নে ব্যবস্থাপক কাওসার খান বলেন, ‘সকাল তখন সাড়ে ৭ টা। হয়তো রিসিপশনে যিনি ছিলেন তিনি কোন কারণে একটু সরেছেন। আর তখন পুলিশ ছিলো না। এ সুযোগেই তারা চলে গেছে।’

অনিয়ম আছে অন্য হোটেলগুলোতেও

করোনার নতুন ধরণ ছড়িয়ে পড়ার শংকা থাকার কারণে বাধ্যতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা করা হলেও সিভিল সার্জনের অনুমতিতে মিলে বাইরে বের হওয়ায় সুযোগ। লিখিত আবেদনের মাধ্যমে এ সুযোগ নিয়ে কোয়ারেন্টিনে থাকা প্রবাসীরা ঘুরেন অনায়াসে। সে ক্ষেত্রে করোনা ছড়ানোর শংকা থাকে কি না তা নিয়েও আছে প্রশ্ন।

একটি সূত্রে জানা যায়, ২১ মার্চ সোমবার ব্রিটানিয়া হোটেলে পরিদর্শন শেষে বিকাল সাড়ে ৩ টার দিকে দর্গাগেট ‘হোটেল হলি গেট’ পরিদর্শনে যান এনএসআইর ওই দুই কর্মকর্তা। সেখানে গিয়ে লিমু মিয়া (৬০), মনু মিয়া (৫২), রওশন আরা সাথী (৪৯), সজেদা বেগম (৪১) কে অনুপস্থিত পান। পরে হোটেল কর্তৃপক্ষ তাদের চার জনের বাইরে বের হওয়ায় জন্য সিভিল সার্জনের অনুমতিপত্র দেখান। তবে সে অনুমতির সময়েও আছে প্রশ্ন। ওই ছাড়পত্রে বাইরে অবস্থান করার জন্য এ চারজনকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত অনুমতি প্রদান করা হলেও বিকাল সাড়ে ৩ টায়ও তারা উপস্থিত ছিলেন না হোটেলে। সে ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।

কঠোর হচ্ছে প্রশাসন

তবে এসবের বিরুদ্ধে এবার কিছুটা পদক্ষেপও নিচ্ছে প্রশাসন। হোটেল ব্রিটানিয়া থেকে ৯ প্রবাসী উধাও হওয়ায় ঘটনার পর পর শিশু ছাড়া ৬ জনকে ৩ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন সিলেট জেলা প্রশাসনের নির্বাহি ম্যাজিস্ট্রেট মেজবাহ উদ্দিন আহমদ। আর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ ব্রিটানিয়া হোটেলের সাথে চুক্তি বাতিল করা হয়েছে।

তবে হোটেল কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে এমন ঘটনা ঘটলেও দোষ পুলিশ প্রশাসনের উপর চাপানো হয় বলে মন্তব্য করেছেন সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) বিএম আশরাফ উল্যাহ তাহের। তিনি বলেন, ‘পুলিশের কাজ হচ্ছে নিরাপত্তা দেওয়া। হটেল কর্তৃপক্ষ কোন সমস্যা অনুভব করলে পুলিশকে জানাবেন। কিন্তু তারা পুলিশের অগোচরে অন্যান্য বোর্ডারের মতো প্রবাসীদের বিয়ে করায়, বাইরে বের হওয়ার সুযোগ দিয়ে দোষ চাপায় পুলিশের উপর।

অপরদিকে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ( সার্বিক, অতিরিক্ত দায়িত্ব) আ.ন.ম. বদরুদ্দোজা বলেন, আমরা এসব বিষয়ে কঠোর হচ্ছি। কিন্তু সকল কিছুর উর্ধ্বে সচেতনতা। চাইলেই কারো সাথে আসামির মত আচরণ সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে প্রবাসীদের সহযোগিতা করতে হবে। আর হোটেল কর্তৃপক্ষের ব্যাপারে ইতোমধ্যে দেখেছেন আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি। লাভিস্তার বিয়ের বিষয়টি আমি এখন অবগত হলাম। খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..