সিলেট ৩০শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৭শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ৮:২৩ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৫, ২০২২
মোঃ রায়হান হোসেন : দেশে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। এছাড়া বাল্যবিবাহমুক্ত রাষ্ট্র গড়তে বেসরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা ও সামাজিক সংগঠন জনসাধারণ বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে সম্পৃক্ত করে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দেশের মানুষের মাঝে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে অনেকটা সচেতনতা গড়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে সরকার দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলাকে বাল্যবিবাহ মুক্ত ঘোষণা করেছে। তথাপিও বাল্যবিবাহের পরিমাণ আশাতীত হ্রাস করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পরিবার বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সম্মক জ্ঞান রাখে। কিন্তু এ জ্ঞানের বহিপ্রকাশ ঘটায় বা জ্ঞানটি সম্পর্কে মূল্যায়ন করে এমন পরিবারের সংখ্যা এখনো আশাপ্রদ নয়। সরকারিভাবে প্রতিনিয়তই বাল্যবিবাহ বন্ধে অভিভাবকদের আহবান, শাস্তির ব্যবস্থাসহ সচেতনতার জন্য নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। বেসরকারিভাবেও বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবুও কোনভাবেই পুরোপুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না বাল্যবিবাহ।
ঠিক তেমনি এমন একটি অভিযোগ পাওয়া গেছে ঐতিহ্যবাহী ৪নং খাদিমপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সুনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জহিরিয়া এম.ইউ.উচ্চ বিদ্যালের দশম শ্রণীর বিজ্ঞান বিভাগের রোল নং-০১ নামক এক মেধাবী ছাত্রীর। সে একই ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত উত্তর মোকামেরগুল এলাকার বাসিন্দা জানা গেছে।
জানা গেছে- দশম শ্রেণীর ওই ছাত্রীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার বাবা তাদের ফুফুতো ভাইয়ের সাথে আসছে আগামী (১৯ই জানুয়ারি) বাল্যবিবাহের আয়োজনের দিন তারিখ ধার্য্য করেছেম। এমন খবর শুনে ওই ছাত্রীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। পরে ওই স্কুল পড়ুয়া ছাত্রী নিজেকে বাল্যবিবাহের হাত থেকে রক্ষা করতে তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জহিরিয়া এম.ইউ.উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা সিতারা বেগমের নিকট আকুতি-মিনতি করে বিষয়টি জানিয়ে থাকে বাল্যবিবাহের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য অনুরোধ জানায়।
এ ব্যাপারে জহিরিয়া এম.ইউ.উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা সিতারা বেগমের সাথে সৌজন্যে সাক্ষাতে আলাপকালে তিনি বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে জানান- এই ঘটনা সত্য, তবে আমি এই বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য প্রাথমিকভাবে ওই শিক্ষার্থীর ওয়ার্ডের ইউ,পি সদস্যকে বিষয়টি অবগত করেছি। আর ওই শিক্ষার্থীর মুখ থেকে শুনেছি তার বিয়ে আগামী (১৯ই জানুয়ারি) নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে সে আমাদের বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর খুব মেধাবী একজন ছাত্রী।
তিনি প্রতিষ্ঠানের নথিপত্র দেখিয়ে ওই ছাত্রীর চলমান বয়স ১৬ বছর নিশ্চিত করে আরো জানান- আমাদের বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রণীতে থাকে ভর্তি করার সময় তার পরিবারের নিকট হইতে আমাদের নিকট যে জন্মসনদ জমা দেয়া হয়েছিলো তাতে পর্যালোচনা করে আপনারাই দেখুন। ওই জন্মসনদ অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ (১৬ জানুয়ারি ২০০৬) ইংরেজি সনে অর্থাৎ সে অনুপাতে তার চলমান বয়স ১৬ বছর। যাইহোক তার ওয়ার্ডের মেম্বার সাহেবকে বিষয়টি অবগত করার পর গত বৃহস্পতিবার (১৩ই জানুয়ারি) ওই ছাত্রী আবার একটি ছেলেকে সাথে নিয়ে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলো এমনকি সে আমাকে জানিয়েছে তার এই সমস্যা সমাধান হয়েছে। তবে তার কথাবার্তায় আমার কাছে মনে হচ্ছে সে পরিবারের চাপে পরে বা তার পরিবারের লোকজন থাকে যেকোন উপায়ে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে এই বিবাহে রাজি করিয়েছেন। যাইহোক তার কিন্তু আইন অনুসারে বিবাহের উপযুক্ত বয়স হয় নি সে দিকটা আপনাদের বিবেচনা করা উচিত। সর্বশেষে এই বাল্যবিবাহ বন্ধ করে ওই ছাত্রীকে বিবাহ নামক মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রশাসনের নিকট আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
এ ব্যাপারে ওই ছাত্রীর বাবার সাথে সরাসরি সাক্ষাতে আলাপকালে তিনি জানান- আপনারা যা শুনেছেন তা সত্য তবে তবে আমার মেয়ের জন্য ভালো একটি প্রবাসী পাত্র পেয়েছি তাই আমি বিয়ে দিতে ইচ্ছুক। তার তো বিয়ের উপযুক্ত বয়স হয় নি? প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- তা ঠিক তবে এরকম সুযোগ তো সবসময় আসে না। আর এ বয়সে শত শত মেয়ের বিবাহ হচ্ছে তাহলে সমস্যা কোথায়? বলে তিনি প্রতিবেদককে উল্টো প্রশ্ন করে বসেন। তাহলে বিয়ে কি আগামী (১৯ই জানুয়ারি) হচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- হক সেন্টারে বুকিং দেয়া শেষ তবে একটু এদিক-সেদিক হতে পারে পরিস্থিতি বুঝে তা নির্ধারণ করবেন। যাই হোক তার তো ১৬ বছর বয়স তাহলে আইন অনুযায়ী তো এখন তার বিবাহের কাবিননামা হবে না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- তা আমিও জানি তবে আমরা উভয় পক্ষের সম্মতিতে আপাতত ৩শ” টাকার স্ট্যাম্পে হলফনামা করবো আর ১৮ বছর হলে কাবিননামা রেজিস্ট্রার করবো বলে তিনি জানান।
এরপর ঘটে অবাক করা আরেক কান্ড যার জন্য হয়তো মুটেও প্রস্তুত ছিলেন না প্রতিবেদক। শনিবার (১৫ই জানুয়ারি) সন্ধান ৬ ঘটিকার সময় প্রতিবেদকের ব্যবহৃত মোবাইল নাম্বারে ০১৭৮৭-১১৭৪৫৩ নাম্বার হইতে একটি ফোন আসলে প্রতিবেদক ফোন রিসিভ করা মাত্রই অপরপ্রান্ত থেকে অজ্ঞাত ওই ব্যক্তি জানান তার নাম জুনেদ। তিনি সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে প্রতিবদেকে প্রশ্ন করেন আপনি কি কোন বিয়ের বিষয় নিয়ে কারো সাথে কোন ধরণের আলাপ করেছেন আর কেনই বা আলাপ করেছেন? প্রতিবেদক ওই ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ বিষয়টি জানানোর পর তিনি বলেন বিয়ে হলে আপনাদের করণীয় কি আছে ? বলে আবার উল্টো প্রশ্ন করেন। সাংবাদিক হয়ে এই বিষয়ে একজন প্রতিবেদকে এমন উল্টো-পাল্টা প্রশ্ন এক ধরনের শাঁক দিয়ে মাছ ঢাকার মতোই মনে হচ্ছে প্রতিবেদকের কাছে।
এ ব্যাপারে ৮নং ওয়ার্ডের বর্তমান মেম্বার আব্দুল মছব্বিরের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান- আমাকে এই বিষয়টি জহিরিয়া এম.ইউ.উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা সিতারা বেগম অবগত করেন। তারপরই আমি তাৎক্ষণিকভাবে ওই ছাত্রীর বাবার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান- তাদের আত্মীয় ফ্রান্স প্রবাসী একজন ভালো ছেলে পেয়েছেন। তবে মেয়ের বিবাহের বয়স হয় নি তা সত্য। আমি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনসমন্ধে ওই ছাত্রীর বাবাকে অবগত করি। পরবর্তীতে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে এ বিষয়ে তাকে আলাপ করার জন্য বলি এবং বাল্যবিবাহ থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ জানাই।
এ ব্যাপারে শাহপরান (রহ.) থানার অফিসার ইনচার্জ সৈয়দ আনিসুর রহমান বলেন- বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান সর্বদা কঠোর। আমাদের থানায় কোনভাবেই বাল্যবিবাহ হতে দেয়া যাবে না। অবিলম্বে এই বিষয়ে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণের পদক্ষেপ নিচ্ছেন বলে আশ্বাস প্রদান করেন তিনি।
এ ব্যাপারে সিলেট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এর ব্যবহৃত সরকারি নাম্বারে ফোন দিলেও ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
আসলেই কি তাই? মেয়েকে অপরিণত বয়সে বিয়ে দিয়ে পরিবারের কর্তা কি বাঁচলেন? অনেক ক্ষেত্রে এমন ধারণা ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। পরিবারের কর্তা নিজ হাতে তার কন্যার একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ নষ্ট করলেন। তিনি নিজেও ডুব দিলেন অমানিষার কালো অন্ধকারে। অপরিণত বয়সের মেয়েদের বিয়ে দেবার পর অধিকাংশ সময়ই প্রথম যে জিনিসটি সামনে আসে তা হলো-বিয়ের কিছুদিন পর স্বামীর বাড়ি থেকে মেয়েটি এসে আর স্বামীর বাড়ি ফিরতে চায় না-এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে আমাদের সমাজে। যখন তাঁর পুতুল খেলার বয়স তখনই যদি থাকে সংসার নামক শৃঙ্খলে বন্দি করা হয় তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণই বেশি হয়ে থাকে। যখন অভিভাবকরা কোন মতেই বুঝিয়ে-সুজিয়েও মেয়েকে আর স্বামীর বাড়ি পাঠাতে পারেন না তখন সমাজপতিরা এ নিয়ে বিচার-শালিসে বসেন। অথবা মামলা, থানা, আদালত করে সময় কাটাতে হয় অভিভাবকদের। বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই তালাকের মাধ্যমে বিয়ের কবর রচিত হয়। আজকাল আমাদের সমাজে এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে।
অল্প বয়সে বেশিরভাগ মাতৃমৃত্যু প্রধান কারণ বাল্যবিবাহ। দেশে মা ও শিশুমৃত্যুর মূল কারণ কিশোরী বয়সীদের মা হওয়া। কিশোরী মায়ের মৃত্যুঝুঁকি প্রাপ্তবয়স্ক মায়ের তুলনায় অন্তত চারগুণ বেশি বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। বাল্যবিবাহের কারণে মাতৃমৃত্যু কিংবা শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি হয়ে থাকে। অনেকক্ষেত্রে নাবালিকা মেয়ে মা হওয়ায় কিভাবে শিশুকে পরিচর্যা করবে সে সম্পর্কে সম্মক জ্ঞান থাকে না। এর ফলে মা ও শিশুর মৃত্যু ঘটতে পারে। বাল্যবিবাহের কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা, মাতৃমৃত্যুও ঝুঁকি, অপরিণত গর্ভধারণ, প্রসবকালীন শিশুর মৃত্যুঝুঁকি, প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা, নারীশিক্ষার হার হ্রাস, স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি, নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষমতা ও সুযোগ কমে যাওয়াসহ নানা রকম নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকে। এ কারণে বাল্যবিয়ের অভিশাপ থেকে রক্ষা পেতে সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার পাশাপাশি বাল্যবিবাহ বিরোধী পদক্ষেপের সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে মা ও শিশুর মৃত্যুহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd