সিলেট ১লা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৮শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ১০:৪৪ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৮, ২০২২
সৈয়দ হেলাল আহমদ বাদশা, গোয়াইনঘাট :: নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি গোয়াইনঘাট উপজেলার নাব্যতা হারানো জাফলং পিয়াইন নদী ফসলহানি সহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ বলে মনে করেন উপজেলাবাসী। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষকের ফসল হানি ঝড়-ঝাপটা সহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় এড়াতে সেই পিয়াইন নদী খনন করা অতীব জরুরী এখন সময়ের দাবি। প্রয়োজন সুদুরপ্রসারী দীর্ঘমেয়াদি স্হায়ী পরিকল্পনা।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলোর পাশাপাশি গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং পিয়াইন নদী দিনদিন হারাচ্ছে তার চিরচেনা রুপ যৌবন জৌলুশের পাশাপাশি নাব্যতা। ফলে নদীমাতৃক বাংলাদেশ হারাচ্ছে তার গৌরবদীপ্ত নামটি। মানুষ হারাচ্ছে নদীর জল। পরিবেশ হারাচ্ছে ভারসাম্য। কৃষি-অর্থনীতি হারাচ্ছে মাছ ও অন্যান্য সম্পদ। কৃষি হারাচ্ছে ফসল। উৎপাদক হারাচ্ছে বিভিন্ন রকম উৎপাদন। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় নদীতীরে ও আশপাশে বসবাসকারী মানুষজন।
দেশ- বিদেশী প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে জাফলং পিয়াইন নদীর আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। প্রকৃতি কন্যা, বিউটি স্পট, পিকনিক স্পট ও সৌন্দর্যের রাণী খ্যাত জাফলংকে কেন্দ্র করে এ নদীর নাম পর্যটকদের কাছে অনেক পরিচিত।
পিয়াইন নদীতে বিছানো সারি সারি পাথরের স্তূপ জাফলংকে আরও আকর্ষণীয় করেছে। পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ শীতল পানি, উঁচু পাহাড়ে গহিন অরণ্য ও শুনশান নিরবতার কারণে এলাকাটি পর্যটকদের দারুণভাবে নজর কাড়ে। কিন্তু উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানির সাথে পলি মাটি আসায় নদীটি এখন ভরাট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। স্বাধীনতার আগে এমনকি পরেও পিয়াইন নদী নিয়ে নানা পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন পরিকল্পনা ও প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি।সড়কপথের ব্যাপক উন্নতির ফলে নৌপথের প্রয়োজনীয়তা দিন দিন কমে আসছে এবং নদীর তলদেশ স্থানে স্থানে ভরাট হওয়ায় নৌচলাচলও কষ্টকর হয়ে পড়েছে। শুধু কি তাই নদীর নাব্যতা কমার সঙ্গে সঙ্গে খনন না করায় দখলদাররা সুযোগ পাচ্ছে। এভাবে একটু একটু করে পিয়াইন নদী চলে যাচ্ছে দখলদারদের কব্জায়।
বছর বছর মেঘালয় থেকে তেড়ে আসা পাহাড়ি ঢল পিয়াইন নদীর দুকূল প্লাবিত করে। নদী তীরবর্তী গ্রাম গুলো নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে বাড়ি ঘর বিলীন হয়ে যাচ্ছে নদী গর্ভে। পাহাড়ি ঢলের সাথে পলি, বালু,কাঁকর এসে নদীর নাব্যতা হ্রাস করে প্রতি বছর।
এক কালের খরস্রোতা ৩০,৪০ ফুট গভীর পিয়াইন নদী জাফলং থেকে পান্তুমাই হয়ে, মনাইকান্দি, গোরা গ্রাম, হাদার পার, গুজার কান্দি, কোম্পানিগন্জ কাটা গাং হয়ে সুরমায় মিলিত হয়েছে কিন্তু আজ নাব্যতা সংকটে শুকনা মৌসুমে নদী শুকিয়ে যায় আর এ নদীর বুকে রবি শষ্য ফলানো হয়।
অথচ এক সময় সারা বছর নদী পথে একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম ছিল এই স্রোতস্বিনী পিয়াইন নদী । এই সমস্যার স্হায়ী সমাধানের জন্য ঐতিহাসিক “পিয়াইন নদী খনন প্রকল্প ” বাস্তবায়ন একান্ত জরুরী ও জনগুরুত্বপূর্ণ। কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের প্রায়ত চেয়ারম্যান মরহুম এম. তৈয়বুর রহমান ছাত্রাবস্হায় প্রথম ১৯৭৫ সালে তৎকালীন নৌ পরিবহনমন্ত্রী’র নিকট দরখাস্ত প্রদান করেন।
পরবর্তীতে তিনি সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে বার বার আবেদন নিবেদন করেন।উনার আবেদন নিবেদনের প্রেক্ষিতে জাইকার মাধ্যমে সমীক্ষা হয়।পরবর্তীতে মরহুম এম তৈয়বুর রহমান মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট দফতরে আবেদন নিবেদন, অনুনয়, বিনয় করে গেছেন।কিন্তু পরিতাপের বিষয় ২০১৩ সালের ১০ই মার্চ উপজেলা চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় বৃহত্তর জৈন্তিয়া বাসীকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে চিরতরে না ফেরার দেশে চলে যান।
তিনি আমৃত্যু পিয়াইন নদী খনন প্রকল্প বাস্তবায়নের আকুতি জানিয়ে গেছেন, এতদঞ্চলের মানুষকে বন্যার প্রাকৃতিক দূর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে গেছেন।তাই মরহুমের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে “পিয়াইন নদী খনন প্রকল্প ” টি বাস্তবায়ন করার জোর দাবি তুলেছেন বৃহত্তর জৈন্তাবাসী।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়, ফসলহানি, খাদ্য সংকট কৃষিতে অনীহা এসবের জন্য জাফলং পিয়াইন নদীর নাব্যতা হারিয়ে যাওয়া কে প্রাধান্য দিচ্ছেন উপজেলায় বসবাসকারী মানুষজন। তারা মনে করেন এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় এড়াতে কৃষিতে উৎপাদন বাড়াতে উপজেলার মানুষের স্বাচ্ছ্যন্দে বসবাসের জন্য জাফলং পিয়াইন নদী খনন অতীব জরুরি এখন সময়ের দাবি। তার জন্য প্রয়োজন সুদুরপ্রসারী স্থায়ী কর্মপরিকল্পনা। তাতে করে উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নের মানুষের নৌপথ ও সড়ক পথে পর্যটন স্পট জাফলংয়ে যাতায়াতে যোগাযোগের পথ সুগম হবে। নদীর দুই ধারে গড়ে উঠবে গ্রাম। বাস্তু ভিটাহারা হাজার হাজার মানুষজন বসবাস করতে পারবে। বাড়বে কৃষিতে উৎপাদন, হবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। অনিশ্চয়তায় ভোগে কৃষকরা আর কৃষি কাজে অনীহা প্রকাশ করবেনা। এক ফসলা জমি হবে তিন ফসলা। পাশাপাশি রবি শস্য উৎপাদনের মাধ্যমে পারিবারিক খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে অর্থনৈতিক যোগান দেবে। দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত মানুষজন কর্মের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে নিজেকে সামাজিকভাবে দাঁড় করাতে পারবে। পর্যটন বিমুখ পর্যটকরা হবে পর্যটনমুখি। উপজেলার সুনামের পাশাপাশি বেকার মানুষের বিভিন্ন ধরনের কর্মসংস্থান হবে। স্বরূপে ফিরবে জাফলং পিয়াইন নদী। অবারিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি জাফলং ও বিছনাকান্দিসহ বিভিন্ন পর্যটন স্পট পর্যটকে মুখরিত হবে।
সম্প্রতি গোয়াইনঘাট উপজেলায় পাহাড়ি ঢলের আগাম বন্যায় তলিয়ে গেছে বোরো ফসল। কৃষকের মাথায় হাত হাহাকার বিরাজ করছে।দেখা দিয়েছে নদী ভাঙ্গন রাস্তাঘাটের করুন অবস্থা। নষ্ট হয়েছে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আসবাবপত্র। এটা নতুন কিছু নয় প্রতিবছরই উপজেলাবাসীকে এই ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ধকল সইতে হয়। চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় উপজেলায় বসবাসকারী মানুষজন কে। শুধু কি এখানেই শেষ। এখানেই শেষ না, এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কবলে পড়ে সরকারের দেওয়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও প্রজেক্টের কোটি কোটি টাকা নষ্ট হয়। পুনরায় সরকারকে এইসব উন্নয়ন প্রকল্প ও প্রজেক্টে বরাদ্দের মাধ্যমে টাকা দিয়ে দ্বিতীয়বার ভূর্তকি গুনতে হয়। প্রতিবছর বৃহত্তর জৈন্তাবাসীর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দুই চার লাইনে বর্ণনা দেওয়া এমনকি তুলে ধরা সম্ভব নয়। প্রতিবারের মতো এবারও বৃহত্তর জৈন্তাবাসী নাব্যতা হারানো জাফলং পিয়াইন নদী খননের দাবীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ঝড় তুলেছেন। তাদের দাবি শুধু উপজেলায় বসবাসকারী মানুষজন নয়। নাব্যতা হারানো পিয়াইন নদীর খনন হলে সরকার ও প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ থেকে রক্ষা পাবে। এমনকি পিয়াইন নদী খনন রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd