সিলেটে শুল্ক ফাঁকির শতাধিক বিলাসবহুল গাড়ি!

প্রকাশিত: ১২:৫৮ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৮, ২০২৩

সিলেটে শুল্ক ফাঁকির শতাধিক বিলাসবহুল গাড়ি!

নিজস্ব প্রতিবেদক:
সিলেট কোতোয়ালি থানা কম্পাউন্ডে ধুলার স্তরে ঢাকা পড়ে আছে বিলাসবহুল দুটি গাড়ি। মিতসুবিসি কোম্পানির এই পাজেরো জিপ দুটি থানা প্রাঙ্গণে খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে ৯ বছরের বেশি সময় ধরে।

শুল্ক ফাঁকি দিতে ভারত হয়ে চোরাই পথে দেশে আনা গাড়ি দুটি ধরা পড়ার পর থেকে এভাবে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। গাড়ি দুটির একেকটির দাম চার থেকে পাঁচ কোটি টাকা।

তথ্য রয়েছে, সিলেটে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা বিদেশি শতাধিক বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে। বিশেষত যুক্তরাজ্যপ্রবাসীরা কারনেট সুবিধার আওতায় এসব গাড়ি ভ্রমণের সময়ে ব্যবহারের কথা বলে দেশে নিয়ে এসেছেন। আর বিআরটিএর কিছু কর্মকর্তা আর্থিক সুবিধা নিয়ে এগুলোর রেজিস্ট্রেশন দিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৩ সালের ৩১ অক্টোবর সকালে সিলেটের বিয়ানীবাজারের শেওলা শুল্ক স্টেশন দিয়ে বিজিবির বাধা উপেক্ষা করে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এই দুটি জিপ গাড়ি। বিজিবির টহল চৌকি ভেঙে জিপ দুটি দেশে প্রবেশের খবর ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় তোলপাড়।

এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীও ফোনে কথা বলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে নড়েচড়ে ওঠে সিলেটের প্রশাসন। বিশেষ অভিযান চালিয়ে ৩১ অক্টোবর রাতেই গাড়ি দুটি উদ্ধার করা হয়।

গাড়ি উদ্ধার হলেও এগুলো যারা নিয়ে এসেছিলেন তাদের সন্ধান তখনও পায়নি পুলিশ। ভারতীয় ইমিগ্রেশনের কাছ থেকে পুলিশ জানতে পারে, সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার বাসিন্দা ব্রিটিশ নাগরিক কাবুল মিয়া, আসকির আলী ও অন্তর আলী শুল্ক ফাঁকি দিয়ে গাড়িগুলো দেশে নিয়ে আসেন। তাদের মধ্যে কাবুলের পাসপোর্ট নম্বর ৪৫৪৭৯৩৩৫৬, আসকির আলীর পাসপোর্ট নম্বর ৫০৮৮৯৮৫৫৮ ও অন্তর আলীর পাসপোর্ট নম্বর ৬৫২৪৯১৪৮৭। গাড়ি উদ্ধারের দিনই তারা দেশ ছেড়ে চলে যান বলে জানায় পুলিশ।

এ ঘটনায় সিলেট কোতোয়ালি থানা পুলিশ ও শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর দুটি মামলা করে।

পুলিশের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন কোতোয়ালি থানার তৎকালীন পরিদর্শক (তদন্ত) মোশাররফ হোসেন। তিনি বর্তমানে সিলেটের জকিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) দায়িত্বে আছেন।

মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘গাড়ি দুটি যুক্তরাজ্য থেকে আনা হয়েছিল। সে সময় ইন্টারপোলের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের কারনেট কোম্পানির কাছে গাড়ি দুটির ব্যাপারে তথ্য চাওয়া হয়। কিন্তু তারা কোনো তথ্য দেয়নি। আসামি ও সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া না যাওয়ায় ২০১৭ সালে আদালতে এই মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয়।

বিআরটিএ-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সিলেটে বিভিন্ন দেশ থেকে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা শতাধিক বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে। প্রবাসীরা নিজে ব্যবহারের কথা বলে ও কারনেট সুবিধা নিয়ে গাড়িগুলো দেশে নিয়ে আসেন। পরে চুরি হয়ে গেছে বা দুর্ঘটনায় নষ্ট হয়ে পড়েছে অজুহাত দিয়ে এগুলো আর ফিরিয়ে নেয়া হয় না। এভাবেই ২০১৩ সালে শেওলা শুল্ক স্টেশন দিয়ে আনা হয়েছিল গাড়ি দুটি।

মিতসুবিসি কোম্পানির বিলাসবহুল পাজেরো জিপ দুটির একেকটির দাম চার থেকে পাঁচ কোটি টাকা বলে জানিয়েছে কোতোয়ালি থানা পুলিশ।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের সিলেট কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, আটককালে গাড়ি দুটি নতুন ছিল। নতুন গাড়ি আনতে গেলে আমাদের এখানে ৩০০ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হয়। সেটা ফাঁকি দিতেই এভাবে নিয়ম ভেঙে ইমিগ্রেশন ফাঁকি দিয়ে গাড়ি নিয়ে আসা হয়েছে।

সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) সুদীপ দাস বলেন, ‘গাড়িগুলো নিলামে তোলার জন্য আদালতে আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু আদালত থেকে এখনও অনুমোদন মেলেনি। আবেদনটি সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিবেচনাধীন। আদালতের নির্দেশ ছাড়া এগুলো সরানোর এখতিয়ার নেই।’

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্রে জানা যায়, সিলেটে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা শতাধিক বিদেশি বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে। বিআরটিএর কিছু কর্মকর্তা আর্থিক সুবিধা নিয়ে এ রকম অনেক গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

এমন অভিযোগের প্রমাণ পেয়ে বিআরটিএ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে একটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদকা। তাতে অভিযোগ করা হয়, কারনেট সুবিধায় যুক্তরাজ্য থেকে কর ফাঁকি দিয়ে দেশে আনা একটি লেক্সাস গাড়ি ১৭ লাখ টাকার বিনিময়ে জাল কাগজ দিয়ে রেজিস্ট্রেশন দেন বিআরটিএ কর্মকর্তারা। এতে দুই কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ এনে সিলেট বিআরটিএর সহকারী পরিচালক এনায়েত হোসেন মন্টুসহ সাতজনের বিরুদ্ধে সিলেট কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন দুদক প্রধান কার্যালয়ের সহকারী উপপরিচালক (অনুসন্ধান ও তদন্ত) ফরিদুর রহমান।

তবে এখন এমন অনিয়ম হয় না বলে দাবি করেন বিআরটিএ সিলেট কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজুল ইসলাম। তিনি বলেন, শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা গাড়িগুলো ধরতে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর নিয়মিত অভিযান চালায়। আমরাও তাদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করি। এসব গাড়িকে রেজিস্ট্রেশন দেয়ার সুযোগ নেই।

প্রসঙ্গত, যুক্তরাজ্যে কারনেট নামে একটি আন্তর্জাতিক অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। যুক্তরাজ্যের কোনো নাগরিক পর্যটক হিসেবে তার গাড়ি নিয়ে অন্য কোনো দেশে যেতে চাইলে ব্যবস্থা করে দেয় ওই অ্যাসোসিয়েশন।

কারনেটের নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি পাসপোর্টের বিপরীতে একটি গাড়ি দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। তবে তা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। বিদেশ থেকে বাংলাদেশে গাড়ি প্রবেশে তিন শ ভাগ সরকারি শুল্ক নির্ধারণ রয়েছে। তবে কারনেটের গাড়ি প্রবেশে পোর্ট ফি ছাড়া কোনো সরকারি শুল্ক দিতে হয় না। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত অনেক সিলেটি দেশে নিয়ে আসেন এসব দামি গাড়ি।

কারনেটের নিয়ম অনুযায়ী পর্যটক হিসেবে আনা এসব গাড়ি ২৪ মাসের মধ্যে নিজ দেশে ফেরত নেয়ার কথা। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় চলে গেলেও এসব গাড়ি থেকে যাচ্ছে বাংলাদেশে।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

January 2023
S S M T W T F
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031  

সর্বশেষ খবর

………………………..