কাটা হচ্ছে যাদুকাটার পাড়, গ্রামগুলো হুমকিতে

প্রকাশিত: ১২:০৭ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১৩, ২০২৩

কাটা হচ্ছে যাদুকাটার পাড়, গ্রামগুলো হুমকিতে

ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার সীমান্ত নদী যাদুকাটায় ইজারাদাররা নিয়ম না মেনে পাড় কেটে বালু তোলায় অন্তত ২৫ গ্রামের মানুষ বসতবাড়ি হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছেন।

‘যাদুকাটা-১’ এবং ‘যাদুকাটা-২’ বালুমহাল হিসেবে প্রায় ৫০০ একর জায়গা জেলা প্রশাসন থেকে ইজারা নিয়ে অন্তত কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বালু তোলা চলছে।

সনাতন পদ্ধতিতে হাত, বালতি, বেলচা দিয়ে বালু উত্তোলনের কথা থাকলেও সেখানে অবাধেই ব্যবহার হচ্ছে ড্রেজার; যা সেখানকার জীব-বৈচিত্র্য ও নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ও গতিকে বাধাগ্রস্ত করে গোটা এলাকার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে বলে পরিবেশবাদীদের অভিমত।

বালুমহাল হিসেবে ইজারা নিয়ে বালুর পাশাপাশি সিঙ্গেল, নুড়ি ও ভুতু পাথর উত্তোলন করার প্রতিবাদ করছেন স্থানীয়রা। তবে ইজারাদাররা রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ায় তাতে কোনো ফল পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। উল্টো প্রতিবাদী গ্রামবাসী প্রতিনিয়ত হামলা, নির্যাতন, হুমকি আর মামলার শিকার হচ্ছেন।

কখনও কখনও উপজেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত সেখানে গিয়ে অভিযান চালিয়ে কিছু জরিমানা করে এবং মালামাল জব্দ করে নিয়ে আসে। তবে ভুক্তভোগীরা বলছেন, ক্ষতির তুলনায় এটা ‘লোক দেখানো’।

কাটা হচ্ছে যাদুকাটার পাড়, গ্রামগুলো হুমকিতে তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন, “যাদুকাটা নদী ইজারার নামে ধ্বংস করা হচ্ছে। নদীর পাড় কাটা বন্ধ না হলে তীরবর্তী অন্তত ২০ গ্রাম বিলীন হয়ে যাবে।

“এসব গ্রামের অনেকে ভিটেমাটি হারিয়েছেন। এ রকম চলতে থাকলে তাহিরপুর উপজেলাসহ পুরো হাওর অঞ্চলে প্রভাব পড়বে। প্রকৃতিবিনাশী কার্যক্রমে এ অঞ্চলের পরিবেশ-প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে।”

এলাকার কয়েকজন জনপ্রতিনিধি ও গ্রামের মানুষ যথেচ্ছভাবে বালু উত্তোলনের পেছনে সুনমাগঞ্জ-১ (তাহিরপুর-ধর্মপাশা-মধ্যনগর-জামালগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতনকে দায়ী করলেও তিনি তা অস্বীকার করেছেন। তার ভাষ্য, নির্বাচন সমানে রেখে একটি মহল তার বিরুদ্ধে ‘অপপ্রচার’ চালাচ্ছে।

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া পাহাড় থেকে যাদুকাটা নদীর উৎপত্তি। তাহিরপুর উপজেলার উত্তর-পূর্ব প্রান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে এই নদী। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এই নদী সম্পদের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।

কাটা হচ্ছে যাদুকাটার পাড়, গ্রামগুলো হুমকিতে মেঘালয় থেকেই পাহাড়ি ঢল ও প্রবল স্রোতে বালু, নুড়ি ও পাথর ভেসে এসে জমা হয় পাহাড়ের পাদদেশের এই নদীতে। সেই বালু ও পাথর উত্তোলনের জন্য গত শতকের আশির দশক থেকে জেলা প্রশাসন দুটি জায়গা ইজারা দিচ্ছে। চৈত্র মাসে এক বছরের জন্য এই ইজারা ডাকা হয়।

এ বছর ‘যাদুকাটা-১’ বালুমহাল ২৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকায় রতন মিয়ার মালিকানাধীন সোহাগ এন্টারপ্রাইজ এবং ‘যাদুকাটা-২’ বালুমহাল ৪২ কোটি ৯০ লাখ ৫০ হাজার টাকায় খন্দকার মঞ্জুরের প্রতিষ্ঠান আরাফ ট্রেড করপোরেশন লিমিটেড ইজারা নিয়েছে। মোট ৬৮ কোটি ৬৫ লাখ ৫০ হাজার টাকায় এ দুটি বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয়েছে।

তবে ২০০৯ সালে পরিবেশের ক্ষতির কথা চিন্তা করে সরকার পাথর উত্তোলন বন্ধ করে দেয়। কারণ, ফাজিলপুরের যে জায়গা থেকে পাথর ও নুড়ি উত্তোলন করা হত, ক্রমান্বয়ে সেই জায়গাটিই বিলীন হয়ে যায়। যদিও এখন আরেকটু সামনে পাথরমহাল রয়েছে; সেটিও ফাজিলপুর নামেই পরিচিত।

জেলা প্রশাসন পাথর উত্তোলনের জন্য কোনো জায়গা ইজারা না নিলেও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন সেখানকার ১৭৭ একর জায়গা থেকে অবাধেই তিন ধরনের পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানান।

ইজারার সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী (ধারা-১৪), নদীর মাঝ বরাবর বা প্রবাহিত স্থান থেকে বালু উত্তোলনের শর্ত দেওয়া হয়। কোনো অবস্থাতেই পাড় ভাঙা যাবে না বা পরিবেশ বিধ্বংসী কোনো যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না।

তাহলে পাড় কেন কাটা হচ্ছে- জানতে চাইলে যাদুকাটা নদী তীরবর্তী ঘাগটিয়া আদর্শ গ্রামের সাহারুল ইসলাম বলেন, “নদীতে পানি বেশি থাকায় নদীর মাঝখান থেকে বালু উত্তোলনে বেশি সময় লাগে। সেখান থেকে সনাতন পদ্ধতিতে বালু তোলাও কষ্টকর। এ ছাড়া নদীর মধ্যখানের বালুর দাম কম। তাই নদীতে পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় নদীর পাড় কেটে বালু তোলা।”

ঘাগটিয়া আদর্শ গ্রামের সামনের অংশটিকে খাল কেটে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “তারপর সেই খাল দিয়ে ছোট ছোট নৌকা ঢুকিয়ে দিনরাতে বালু-পাথর তোলা হচ্ছে। এখন তো বসতভিটে নিয়ে চিন্তায় আছি। যে কোনো সময় আমাদের গ্রামের ১০০ পরিবার নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে।”

সাহারুল বলেন, গ্রামের কেউ প্রতিবাদ করলে তাদের উপর চলে নির্যাতন, দেওয়া হয় হুমকিও। গ্রামবাসী প্রতিবাদ করায় এখন তাদের নদীতে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। ফলে অনেকে অভাব-অনটনে দিন কাটাচ্ছেন।

সোমবার সরেজমিনে ঘাগটিয়া আদর্শ গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, এই গ্রামের সামনে থাকা পুকুরপাড় এলাকায় কয়েক কিলোমিটার নদীর পাড় কাটা হচ্ছে শত শত ছোট-বড় নৌকা দিয়ে। বালু ও পাথর তুলতে তুলতে অনেকের বাড়ির কাছে চলে এসেছে নদী। প্রসিদ্ধ পর্যটন কেন্দ্র শিমুলবাগানের পাশেও নদীর পাড় কেটে বালু তুলতে দেখা গেছে।

গ্রামবাসী জানালেন, লাউড়েরগর, ঘাগটিয়া, বড়টেক, আদর্শগ্রাম, গড়কাটি, ঘাগড়া, রাজারগাঁও, সোহালা, পাঠানপাড়া, কুনাটছড়া, মোদেরগাঁও, মাহারাম, মানিগাঁও, বিন্নাকুলি, মিয়ারচর, পিরিজিপুর, দক্ষিণকূল, আনোয়ারপুর, নোয়াহাট, পাতারী, তিওরজালাল, বালিজুরী, মাহমুদপুর, বারুঙ্কাসহ আশপাশের এলাকা ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে।

এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে লাউড়েরগড়ের একটি বিশাল গোচারণ ভূমি, কবরস্থান, নোয়াহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, অদ্বৈত মহাপ্রভুর আশ্রম, আনোয়ারপুর বাজার, বিন্নাকুলি বাজার ও ফাজিলপুর। উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে উত্তর বড়দল, বাদাঘাট ও বালিজুরি ইউনিয়নের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

যাদুকাটা নদীতে যেতে যেতে কথা হয় মোটরসাইকেল আরোহী রফিকুল ইসলাম উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি নদী তীরবর্তী বিন্নাকুলি গ্রামের বাসিন্দা। তার ভাষ্য, “বালুখেকোদের কাছে গ্রামবাসী অসহায়। আমাদের গ্রামের অনেকের বাড়িঘর বিলীন হয়ে গেছে, আরও হবে।”

ওই এলাকার বাসিন্দা মো. সাজ্জাদুল ইসলাম বলেন, “নদীটা আগে এক কিলোমিটার ছিল। আর এখন নদী হয়েছে ৩ কিলোমিটারের। এটা শুধু নদীর পাড় কেটে কেটে করা হয়েছে। এখানে আমরা হাজার হাজার গরু-ছাগলকে ঘাস খাওয়ানো হত। এখন এই জায়গা কাটতে কাটতে নিজেদের বসত ভিটায় চলে আসছে। আমরা নদীর পাড় কাটা বন্ধে প্রতিবাদ করায় আমাদের নদীতে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না।” একই ধরনের অভিযোগ করেন মো. আকাশ মিয়া (৬৫), মনির উদ্দিন (৫০)সহ অন্তত ২০ জন।

তাদের ভাষ্য, অনেক সময় তারা নির্যাতনের শিকার হয়ে পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ আসেও। কিন্তু পুলিশ আসার আগেই তারা খবর পেয়ে নৌকা নিয়ে সরে যায়। পরে পুলিশ এসে আর নৌকা পায় না। তখন উল্টো গ্রামবাসী মিথ্যা তথ্য দিয়েছে এই বলে চাপ দেওয়া হয়।

লামাশ্রম গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, “বড় বড় লোকেরা নদীতে ড্রেজার মেশিন চালাচ্ছে দিনেরাতে। কয়েকদিন বন্ধ ছিল; তবে পাড় কাটা চলছে। কেউ বাধা দিলে হুমকি, মামলা ও ঘর থেকে ধরে নিয়ে যায়। বুধবার থেকে আবার চলছে ড্রেজার মেশিন।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সনাতন পদ্ধতির এক শ্রমিক বলেন, “ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন বন্ধ না হলে, যাদুকাটার শ্রমিকরা না খেয়ে থাকবে, নদীর পাড়ের গ্রামগুলোও বিলীন হবে অচিরেই।”

লাউড়েরগর, ঘাগটিয়া ও বড়টেক এলাকার কয়েকজন যুবক অভিযোগ করেন, তারা শুনেছেন, এখানে নৌকায় যে বালু তোলা হয়; প্রতি ঘনফুট হিসাবে পুলিশ এক টাকা করে নেয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুপ্রভাত চাকমা বলেন, “অবৈধভাবে নদীর তীর কেটে বালু উত্তোলন বন্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। যাদুকাটা নদীর পাড় কাটা বন্ধে সবাইকে সচেতন ও এগিয়ে আসতে হবে ওই দুষ্ট চক্রের বিরুদ্ধে।”

তাহিরপুর থানার ওসি সৈয়দ ইফতেখার হোসেন বলেন, “আমরা খবর পাওয়া মাত্রই অভিযান করছি। নদীর পাড়া কাটাকে কেন্দ্র করে যে মামলাগুলো হয়েছে, সেগুলোর তদন্ত চলছে।” আর প্রতি বর্গফুটে পুলিশ প্রশাসন এক টাকা করে নিচ্ছে- এমন অভিযোগে বিষয়ে তিনি কেনো মন্তব্য করতে চাননি।

এ বিষয়ে মঙ্গলবার সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী বলেন, “এসব নিষিদ্ধ কাজ; এগুলো করা যাবে না।”

যাদুকাটা তীরের বালু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে নদীতে বালু শ্রমিকরা সনাতন পদ্ধতিতে অর্থাৎ বেলচা-বালতি দিয়ে ছোট ছোট নৌকা নিয়ে বালু তুলতেন। কিন্তু সম্প্রতি এক শ্রেণির ব্যবসায়ী বেশি লাভের আশায় ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তুলছে। বালুমহাল ইজারা নিয়ে শর্ত ভঙ্গ করে তারা প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ হাজার ঘনফুট পাথর তুলছে।

বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, “গ্রামবাসীর আন্দোলনের মুখে ড্রেজার তাণ্ডব দু-তিনদিন বন্ধ থাকে, দুয়েকদিন গেলে আবারও শুরু হয়।

“নদী থেকে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ হাজার ঘনফুট পাথর তোলা হচ্ছে। অথচ পাথর তোলার কোনো অনুমতি নেই। এখানে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।”

শ্রমিকরা জানান, এখানে তিন ধরনের পাথর সংগ্রহ করা হয়। একপ্রকার সিঙ্গেল; যা বালুর দানার চেয়ে একটু বড়। দ্বিতীয় নুড়ি; যা ছোট পাথর। আর ভুতু পাথর মূলত বড় ধরনের পাথর। এসব পাথর নির্মাণকাজের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।

বাদাঘাট ইউনিয়নের যাদুকাটা নদী সংলগ্ন আদর্শ গ্রাম থেকে বালু উত্তোলন বাধা দেন আকাশ মিয়ার স্ত্রী রাজিয়া বেগম (৫০)। এ সময় ইউপি সদস্য মশায়িদ আলম ওরফে রানু মিয়া ও তার সহযোগীরা তাকে বেধড়ক পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। একপর্যায়ে তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়। আহত ওই নারী তাহিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।

পরে তিনি এ ঘটনায় তাহিরপুর থানায় রানু মিয়াসহ তিনজনকে আসামি করে মামলা করেন। এই মামলার তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছেন তাহিরপুর থানা কর্তৃপক্ষ। সোমবার সকালে নদীর পাড় কাটতে নিষেধ করে মারধরের শিকার হন এই গ্রামের মো. সফর আলী (৬৫)।

তার ভাষ্য, “আমার বাড়ির সামনে নৌকা লাগিয়ে নদীর পাড় কাটা হচ্ছিল; তখন আমি এসে নিষেধ করে বলি, পশ্চিম পাড় থেকে নৌকা পূর্বপাড়ে নেন। এখান থেকে বালু তুললে আমাদের বাড়িঘরের অসুবিধা হবে।

“পরে নৌকাটি চলে যায়। তখন একজন রাগে এসে জানতে চায়, কে নৌকা তুলে দিয়েছে? নৌকায় থাকা লোকজন আমার নাম বলে। তখন ওই ব্যক্তির সঙ্গে এ নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। তার কিছুক্ষণ পর চারটি নৌকা লাগে ওইখানে।”

সফর আলী বলেন, “পরে আবার আমি নৌকাকে চলে যেতে বলি, তখন আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। পায়ে আঘাত পেয়েছি। এই হচ্ছে আমাদের অবস্থা।”

একই গ্রামের মো. আক্কাছ মিয়া (৪১) বলেন, “আমরা নদীর পাড় কাটতে না করেছি। তারপরও তিন মাস ধরে নদীর পাড় কাটা চলছে। আমার স্ত্রী বাধা দিলে তাকে তারা মেরেছে। চাকু, গাদা নিয়ে হামলা করে। নিষেধ দিলে আমাদের ছেলেদের ঘর থেকে রশি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যায়। তারা কোনো নিষেধ মানে না। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছি।”

৩০ জুলাই হামলার শিকার হওয়া গৃহিণী রাজিনা বেগম (৪১) বলেন, “পাড় কাটতে কাটতে তারা আমার বাড়ির উঠান কাটা শুরু করে; আমার ঘরের বেড়ার কাছে চলে আসে। তখন আমি বাধা দিলে আমার উপর হামলা করে। আমাকে চাকু দিয়ে আঘাত করে ও আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।

“আমি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছি। এখনও তাদের পাড় কাটা চলছেই। যে কোনো মুহূর্তে আমার বাড়িটা নদীগর্ভে চলে যাবে।”

সোমবার প্রতিবেদক যখন আদর্শ গ্রামে যান, তখন তার সঙ্গী ছিলেন স্থানীয় এক যুবক। তখন সেখানে ইউপি সদস্য রানু মিয়ার সহযোগী হিসেবে পরিচিত আহাদ নূর উপস্থিত ছিলেন। নদীর পাড় কাটা নিয়ে কথা বলার প্রসঙ্গ এলে তিনি ওই যুবককে শাসান এবং একপর্যায়ে তার মোবাইল কেড়ে নেন।

এ নিয়ে কথা কাটাকাটি শুরু হলে আশপাশ থেকে লোকজন ছুটে আসে। তখন অবশ্য আহাদ নূর মোবাইল ফেলে রেখে দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে যান।

পরে আহাদ নূরকে ফোন করা হলে তিনি সবকিছু অস্বীকার করে বলেন, “আমি তো নদীর পাড়েই ছিলাম না। আমি নদীর পাড় কাটার সঙ্গেও জড়িত না।”

এর আগে ২০২১ সালে অবৈধভাবে বালু ও পাথর তোলার সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন স্থানীয় সাংবাদিক কামাল হোসেন। তার ভাষ্য, “সংবাদ সংগ্রহে গেলে আমাকে আটক করে মারধর করা হয়; তারপর গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখে। পরে এলাকাবাসী ও পুলিশ গিয়ে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়।

“আমি জেলা সদর হাপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছি। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করি; মামলাটি আদালতে চলমান রয়েছে।”

যাদুকাটা নদী তীরবর্তী করিমপুর গ্রামের কয়েকজন জানান, এখানকার ইজারাদারদের একজন খন্দকার মঞ্জুর। আরেকজন রতন মিয়া, তিনি ঢাকায় থাকেন। মূলত খন্দকার মঞ্জুরই সবকিছু চালান।

ইজারাদারের হয়ে নদীর পাড় কাটা চক্রের প্রধান হচ্ছেন বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও ঘাগটিয়া গ্রামের বাসিন্দা রানু মিয়া। তার সঙ্গে গ্রামের প্রতাপশালী একাধিক পরিবার জড়িত। তবে মামলা হওয়ার পর রানু মিয়া এলাকা ছেড়েছেন।

যাদুকাটা নদীর দুই তীর পড়েছে বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদ। ইউপি চেয়ারম্যান মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, “এসব কাজের মূলহোতা হচ্ছেন, যাকে আমরা এই এলাকার মানুষ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছি। যিনি ভোট পেয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন, তিনি। উনার সঙ্গে স্থানীয় কয়েকজন নেতা ও ইজারাদার জড়িত এসবে।”

যাদুকাটা আদর্শ গ্রামের আক্কাস মিয়া বলেন, “রানু মেম্বার, মুছা, রুবেল আমার বাড়িঘর কেটে নিতে চেয়েছিল। তাদের এলাকার আরও কয়েকজন সহযোগিতা করে।”

ভুক্তভোগী কয়েকজন অভিযোগ করে বলেন, বালু ব্যবসায়ীদের অনেকেই ক্ষমতাসীন দলে যুক্ত, এলাকায় প্রভাবশালী। যে কারণে ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে চান না।

উপজেলা প্রশাসন ও থানা পুলিশ জানায়, ৪ অগাস্ট যাদুকাটা নদীর তীর কেটে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের অভিযোগে চার ব্যক্তিকে ৪ লাখ টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযান চালিয়ে চারটি নৌকা আটক করা হয়।

মঙ্গলবার তাহিরপুরের ইউএনও সুপ্রভাত চাকমা জানান, এ ছাড়া দুদিন আগে অভিযান চালিয়ে আরও দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

১৬ জুলাই রাতে তাহিরপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আসাদুজ্জামান রনি পাড় কেটে বালু উত্তোলনের দায়ে পাঁচজনকে সাত দিনের জেল ও এক লাখ টাকা জরিমানা করেন।

২০ জুলাই বৃহস্পতিবার রাতভর যাদুকাটা নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের অপরাধে ৪২ জনকে আটক করেছে পুলিশ। পরে তাদের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। এ সময় বালু উত্তোলনে ব্যবহার করা ১০টি ড্রেজার মেশিন বসানো নৌকা ও তিনটি স্টিল বডি নৌকা জব্দ করা হয়।

যাদুকাটার পাড় কেটে বালু তোলার বিষয়ে জানতে চাইলে সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সামনে আমার নির্বাচন (জাতীয় নির্বাচন), কেউ কি নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারে? আসলে আমার প্রতিপক্ষরা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর জন্য, টাকা-পয়সা দিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিউজ করাচ্ছে।

“এখানে আপনারা ইউএনওকে জিজ্ঞাসা করেন, প্রশাসনকে জিজ্ঞাসা করেন, তারা বলবেন। এখানে বালু যারা কাটছে তাদের আমি চিনিও না। আর বাধা দেওয়ার কাজ তো প্রশাসনের, কেউ বাধা দিতে এলে আমি তাদের কিছু বলি কি-না জিজ্ঞেস করেন। আমার লোকজন কিছু বলে কি-না সেটা দেখেন।”

তিনি আরও বলেন, “আসলে তো এখানে আমার কোনো লোক নাই। প্রশাসন কেন বাধা দেয় না, সেটা তাদের জিজ্ঞাসা করেন। তাদের কাজে আমার কোনো হস্তক্ষেপ আছে কি না, দেখেন।”

ইজারাদার খন্দকার মঞ্জুর বলেন, “পাড় কাটার সঙ্গে ইজারাদার কোনোভাবে জড়িত না। তিন থেকে চার দিন আগে আমরা কয়েকটা নৌকা ধরে পুলিশে দিয়েছি; এই নৌকাগুলো সাবেক ইজারাদারদের ছিল।

“ইজারাদার শ্রমিকদের সীমানার বাইরে যেতে নিষেধ দিয়েছেন। যারা বাইরে গিয়ে নদীর পাড় কাটছে, তাদের ব্যাপারে তো পুলিশ দেখার কথা। সেটা আমাদের বিষয় না।”

বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য রানু মিয়া বলেন, “আমি নদীর পাড় কাটার সঙ্গে জড়িত না। এ ছাড়া আমি কোনো নারীকে মারধরও করিনি।”

পাড়কাটা ও ড্রেজার আগ্রাসন থেকে বসতভিটা রক্ষার টানা আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন নদী তীরবর্তী ২০ গ্রামের বাসিন্দারা। ১২ জুলাই তারা স্থানীয়ভাবে সমাবেশ করে বালুখেকোদের প্রতিহতের ডাক দিয়েছেন।

এরপর ১৭ জুলাই বাদাঘাট ইউনিয়নের বড়টেক এলাকায় আরেকটি সভা হয়। সেখানে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য শামীমা আক্তার খানম উপস্থিত হয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, “এসব গ্রামের নারীরা রাত-বিরাতে আমাকে টেলিফোন করে ড্রেজার তাণ্ডব থেকে তাদের বসতভিটা রক্ষার আকুতি জানান। আজ এসে সেই তাণ্ডব দেখে গেলাম।”

সবশেষ ৪ অগাস্ট বিকালে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়; সেখানে যোগ দেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) নেতারা। এর মধ্যে ছিলেন সংগঠনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, সম্পাদক এম এ ওয়াহেদ, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাহেদ কায়েস, বাংলাদেশ নিরাপদ পানি আন্দোলনের সভাপতি মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, আতিকুর রহমান খান পূর্ণিয়া।

পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের বলেন, “নদীর পাড় কাটায় এই এলাকার পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এ অন্যায় কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।”

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আব্দুল করিম কিম বলেন, “শুনেছি যাদুকাটা নদীর পাড় কাটা প্রতি ঘনফুট বালু-পাথর থেকে পুলিশ, উপজেলা ও জেলা প্রশাসন ভাগ পাচ্ছেন। প্রতি ঘনফুটে এক টাকা করে; তাই লোক দেখানো অভিযান চলে। তা না হলে জেলা প্রশাসনের খাস জায়গা এভাবে কেউ কেটে নিতে পারত না।”

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক শাহ শাহেদা আক্তার বলেন, “নদীতে ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে পাড় কাটা ও ড্রেজার চলে। কিন্তু জেলা প্রশাসন এ বিষয়ে কোনো মনিটরিং করছে না। জেলা প্রশাসনের এই নিরবতা আদালত অবমাননার সামিল। আমরা এই বিষয়টি দ্রুতই আদালতের নজরে আনব।” সূত্র- বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..