সিলেট ৩০শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৭শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ৮:৫৬ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৮, ২০২৩
মতিন আব্দুল্লাহ :: আদ্যিকাল থেকেই নারী-পুরুষের মতো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরাও ছিল এবং আছে। অভিধানে তাদের বিবিধ অভিধায় উল্লেখ করা হয়েছেশ্ব কিন্নর-কিন্নরী, কিম্পুরুষ, বৃহন্নলা বা হিজড়া এবং অতি সম্প্রতি তৃতীয় লিঙ্গ বা থার্ড জেন্ডার বা ট্রান্সজেন্ডার।
যতদূর জানা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশে ‘হিজড়া প্রথা’র প্রচলন হয় মোগল আমলে অর্থাৎ ষোড়শ শতকের শুরুতে। নবজাতক শিশুকে আশীর্বাদ করা, বাজারে বা পথেঘাটে মানুষের কাছ থেকে অর্থ নেওয়া তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের পুরনো পেশা। তবে একসময় তারা মন্দিরে, ধর্মালয়ে দেবচরিত্র হিসেবে দেবমহিমায় পূজিত ছিলেন। পরে তাদের অভিশপ্ত মানুষ ভাবা হতে থাকে। তাদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ অভিহিত করার পরও ভারতীয় সমাজে বা বাংলাদেশের সমাজে তাদের বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি খুব একটা বদলায়নি।
জীবিকার প্রয়োজনে কখনো কখনো তারা বিভিন্ন অসামাজিক কার্যক্রমেও যুক্ত হয়ে পড়েন। পরিবারবিচ্ছিন্ন এসব মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছাতে দেশ জুড়ে প্রায় অর্ধশত মাদ্রাসা গড়ে তুলেছেন মুফতি আব্দুর রহমান আজাদ। এসব মাদ্রাসা এখন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জ্ঞানার্জনের বাতিঘর।
রাজধানী ঢাকার কামরাঙ্গীরচর থেকে ‘বাতিঘরের’ যাত্রা শুরু। ২০২০ সালে করোনাকালে সেখানে গড়ে তোলা হয় প্রথম মাদ্রাসা। এখন ঢাকায় ১৫টি মাদ্রাসা। ঢাকার বাইরে বরগুনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, রাজবাড়ী, পাবনা, চাঁদপুর, মাদারীপুর, সুনামগঞ্জ, সিলেটসহ আরও কয়েক জেলায় গড়ে উঠেছে মাদ্রাসা।
মুফতি আজাদ বলেন, ‘মাদ্রাসায় তারা দৈনিক দুই ঘণ্টা পড়েন, পড়াশোনা ফ্রি। তিনটি ভাড়া বাসায় মাদ্রাসা চলে। বাকি হিজড়াদের গুরুর বাসায় বা অফিসে পড়ানো হয়। শিক্ষকদের সম্মানী, বাসা ভাড়া ও অন্যান্য খরচ বহন করে মরহুম আহমেদ ফেরদৌস বারী চৌধুরী ফাউন্ডেশন। সবসময় ফাউন্ডেশন সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে পারে না, তখন আমি খরচ চালাই।’ তিনি বলেন, ‘২০২০ সালের নভেম্বরে হিজড়াদের মাদ্রাসার যাত্রা শুরু। আহমেদ ফেরদৌস বারী চৌধুরী ফাউন্ডেশনের সঙ্গে আলোচনা করলে তারা সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। এরপর মাদ্রাসার কাজ শুরু হয়।’
মুফতি আজাদ বলেন, ‘কামরাঙ্গীরচরে আমি যে মসজিদের খতিব ওই মসজিদসংলগ্ন একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। পাশের বাসায় পাঁচজন হিজড়া ভাড়া থাকতেন। প্রায় প্রতিদিন রাতে তাদের সঙ্গে দেখা হতো। যখন বাসায় ঢুকতাম তখন হিজড়ারাও বাসায় ঢুকতেন। করোনা মহামারীর সময় সবাই ঘরবন্দি; হিজড়ারাও বাইরে যেতে পারতেন না। ওই সময় আমার কর্মব্যস্ততা কম ছিল। তখন আমার মনে হতো এ সময়ে হিজড়ারা কী করছেন। তাদের বাসার নিচের দোকানদারের সহায়তা চাইলাম। ওই দোকানের মাধ্যমেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ। আমি তাদের ইসলাম ও কোরআন শেখানোর প্রস্তাব দিই। একদিন তারা আমাকে তাদের গুরুর বাসায় নিয়ে যান। গুরুকে কোরআন শেখানোর প্রস্তাব দিলে তিনি কিছুক্ষণ চুপ হয়ে থাকেন। এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, আপনি আমার ঘরে এসে কোরআন শেখানোর প্রস্তাব দিচ্ছেন! অথচ আমি প্রায় পাঁচ বছর এলাকার মাদ্রাসা ও মসজিদের ইমামদের কাছে গিয়ে কোরআন শিক্ষার জন্য বলেছি; তারা আমার প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। টাকার বিনিময়েও কেউ ইসলাম ও কোরআন শিক্ষা দিতে চাননি। কথা বলার সময় গুরুমা কেঁদে ফেলেন।’
মুফতি আজাদ জানান, আলোচনার কয়েক দিন পর মিষ্টি খেয়ে উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে হিজড়াদের মাদ্রাসার পথচলা শুরু হয়। কয়েক মাস আগে তাদের ঘরে পড়ানো শুরু হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডে কামরাঙ্গীরচরে হিজড়াদের প্রথম মাদ্রাসা। মাদ্রাসা সম্পর্কে ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজি মো. সাইদুল মাদবর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘হিজড়াদের মাদ্রাসার উদ্যোগ খুবই ভালো উদ্যোগ। মুফতি আজাদ সাহেব অনেক পরিশ্রম করে তার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। তিনি মাঝেমধ্যে দাওয়াত দেন। সবসময় যদিও যেতে পারি না। তবে খোঁজখবর রাখি। হিজড়ারা নিয়মিত কোরআন শিখছেন। সেখানে তাদের মানসিকতার উন্নয়নের জন্যও কাজ হচ্ছে।’
মানবাধিকার সংস্থা ব্লাস্টের অ্যাডভোকেসি উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তাজুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ব্লাস্টও হিজড়াদের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। যারা হিজড়াদের নিয়ে কাজ করে, ব্লাস্ট তাদের নানাভাবে সহযোগিতা করছে। হিজড়াদের নিয়ে কাজে যুক্ত থাকার কারণে বেশ আগেই মুফতি আজাদের কথা শুনেছি। তার কাজের প্রশংসা করে সবাই।’ তিনি বলেন, ‘হিজড়াদের শিক্ষার পাশাপাশি জীবিকাভিত্তিক প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে তাদের রাস্তা থেকে উঠিয়ে আনা সম্ভব হবে। তাদের উপার্জনক্ষম করার বিষয়টি মাথায় থাকতে হবে। আমরা ব্লাস্টের পক্ষ থেকে মুফতি আজাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব। তার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ রয়েছে।’
মুফতি আজাদের মাদ্রাসার ছাত্রী কাজল হিজড়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মুফতি আজাদের প্রতি আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা। তিনি আমাদের ইসলামের বিষয়গুলো জানার ও বোঝার সুযোগ করে দিয়েছেন।’
মুফতি আবদুর রহমান আজাদ বাগেরহাটের মোল্লাহাটের কাহালপুর গ্রামে ১৯৮০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৫ সালে কোরআনের হাফেজ হন। এরপর কওমি মাদ্রাসা থেকে ২০০৪ সালে দাওরায়ে হাদিস ও ২০০৬ সালে ফিকহ শাস্ত্রের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। রোজগার শুরুর আগেই বিয়ে করেন। ২০০৮ সাল পর্যন্ত আয়ের চিন্তা মাথায় ছিল না। বাড়ি থেকে দেওয়া স্বল্প টাকায় নিজের খরচ চালাতেন এবং ধূপখোলায় শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। সে সময় তার দৃষ্টি কাড়ে জুরাইন রেললাইনের দুপাশের বস্তিবাসীদের অমানবিক জীবন। তখনই তাদের জন্য কিছু করার কথা ভাবেন। জুরাইন রেললাইন বস্তিতে ৬০০ টাকায় একটি ঘর ভাড়া নিয়ে তাদের ইসলামের প্রাথমিক বিষয়গুলো শিক্ষা দিতে শুরু করেন।
২০০৯ সালে কামরাঙ্গীরচর মসজিদে ইমাম ও খতিব পদের দায়িত্ব নেন। ৪ হাজার টাকা সম্মানী। পরে ধাপে ধাপে সম্মানী বেড়েছে। এখন সম্মানী, নিজের লেখা বই বিক্রির টাকা ও নিজের মাদ্রাসার আয়ে চার ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে কামরাঙ্গীরচরে থাকেন। মুফতি আজাদ কোরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা ও ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে ৪০টি বই লিখেছেন। বই থেকে বছরে আয় হয় ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে মুফতি আজাদ বলেন, ‘সংসার চালানোর পর অবশিষ্ট টাকা ইসলামের প্রচার ও প্রসারে খরচ করি। পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করেছি, পরিবার ও সন্তানদের জন্য কোনো সম্পদ রেখে যাব না। সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে যাব। পরিবারের সহযোগিতা ছাড়া চলেছি, আমার সন্তানরাও পারবে বলে বিশ্বাস। হিজড়া ছাড়াও বেদে, রিকশাচালক ও বস্তিবাসীদের ইসলাম শিক্ষা ও তাদের সচেতনতার জন্য আমার যা আছে তা খরচ করছি।’
তিনি বলেন, ‘হিজড়ারা নিজেদের খুব হীন মনে করেন। তাদের মতে হিজড়াদের দিয়ে কিছুই হবে না। সেখান থেকে বের করে আনতে হলে তাদের শিক্ষার আলো দিতে হবে। তাহলেই তারা আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন।’
উত্তরাধিকার সম্পর্কে ইসলামের বিধান বিষয়ে মুফতি আজাদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ইসলামে পুরুষ ও নারী ছাড়া আর কোনো লিঙ্গের বিষয়ে কিছু বলা নেই। এজন্য শরিয়তের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, হিজড়াদের ভেতর যাদের পুরুষের বৈশিষ্ট্য বেশি, তারা পুরুষ হিসেবে আর যাদের নারীর বৈশিষ্ট্য বেশি, তারা নারী হিসেবে উত্তরাধিকার প্রাপ্য হবে।’
তিনি বলেন, হিজড়াদের স্বাস্থ্যসেবা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সেলাই মেশিনের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তার। হিজড়াদের জন্য জীবিকা নির্বাহের পথ বের করতে হবে। তাদের বাচ্চাদের মাদ্রাসা বা স্কুলে ভর্তি করে দিলে তারা চাকরি বা কর্ম করে খেতে পারবে। জনসচেতনতা সৃষ্টিতে মসজিদে মসজিদে ইমামদের মধ্যে প্রচারণা চালাতে হবে।
হিজড়াদের মূলধারায় নিয়ে আসার চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে মুফতি আজাদ বলেন, ময়মনসিংহের সদর উপজেলার মানবপল্লীতে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণপল্লীতে ৩৫টি ঘর পেয়েছেন হিজড়ারা। পাশের মহল্লার লোকেরা তাদের সেখানে বাস করতে দেবে না। জেলা প্রশাসনের কাছে ওই এলাকার মানুষ আবেদন করেছে, তাদের উঠিয়ে দিতে। সেখানে মুসলমানদের বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের পাশের মসজিদে হিজড়ারা নামাজ পড়তেন, তাদের নামাজ পড়া বন্ধ করে দিয়েছে এলাকাবাসী। হিজড়াদের পক্ষে কথা বলায় হুজুরকে মসজিদের দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। ওই হুজুর এখন সরকারের আশ্রয়ণপল্লীতে থাকেন। এলাকাবাসী তাদের ওপর হামলাও করেছে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে হিজড়াদের চলতে হচ্ছে।
জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ অনুযায়ী বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যা ১২ হাজার ৬২৯। যদিও বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা এক লাখের বেশি বলা হচ্ছে। ২০০৮ সালে হিজড়ারা ভোটাধিকার পেলেও তাদের সমস্যাগুলোর টেকসই সমাধানের উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd