সিলেট ৩০শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৭শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ১:৪৬ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২৩, ২০২৩
মুহাম্মদ লুৎফুর রহমান : জাতীয় সংসদের দ্বাদশ নির্বাচন অত্যাসন্ন। ২০০৮ সালে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারের লাগাতার শাসনামলের তৃতীয় মেয়াদের শেষ মুহূর্তে বাংলাদেশ রেলওয়ে দেশের বিভিন্ন রেলপথে কয়েকটি আন্তনগর ট্রেন উপহার দিচ্ছে। রেলওয়ের নতুন চমক হলো, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন স্থাপন এবং ঢাকা-কক্সবাজার ও সিলেট-কক্সবাজার সরাসরি আন্তনগর ট্রেন চালুকরণ। কক্সবাজার হচ্ছে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি শহর, মৎস্য বন্দর এবং পর্যটন কেন্দ্র। এটি চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলার সদর দপ্তর। কক্সবাজার তার নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যরে জন্য বিখ্যাত। এখানে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক বালুময় সমুদ্রসৈকত, যা ১২০ কি.মি. পর্যন্ত বিস্তত। এখানে রয়েছে বাংলাদেশের বৃহত্তম সামুদ্রিক মৎস্য বন্দর এবং সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশন।
বাংলাদেশের পর্যটনপিপাসু মানুষদের প্রথম পছন্দ কক্সবাজার। তাই এই দুই রেলপথে আন্তনগর ট্রেন চালুকরণ এবং দৃষ্টিনন্দন কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশন স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করায় পর্যটকরা দারুণ উদ্বেলিত, আনন্দিত। সিলেট বিভাগবাসী আরও বেশি আনন্দিত এজন্য যে, প্রকৃতিকন্যা সিলেট এর সঙ্গে সমুদ্রকন্যা কক্সবাজারের যোগাযোগ হবে আরও সুখময়, আরও নিরাপদ এবং আরও আনন্দদায়ক। ঢাকা-কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনটি আগামী ১ ডিসেম্বর চালু হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে সিলেট-কক্সবাজার ট্রেন চালুর দিনক্ষণ এখনও নির্ধারিত হয়নি। ঢাকা থেকে কক্সবাজারগামী আন্তনগর ট্রেনের নাম দেয়া হয়েছে “কক্সবাজার এক্সপ্রেস”। এটা অত্যন্ত যৌক্তিক, বস্তুনিষ্ঠ এবং সার্থক নামকরণ।
ঢাকা-সিলেট এবং চট্টগ্রাম সিলেট রুটে যাত্রী চাহিদার তুলনায় ট্রেন কম থাকায় বাংলাদেশ রেলওয়ে ঢাকা-সিলেট রুটে নতুন একটি ট্রেন চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে- এতে সিলেটবাসী অত্যন্ত আনন্দিত। এ ট্রেনটির নামকরণ নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা, সমীকরণ চলছে। এ বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে রেলওয়ের ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে হয়। বিশেষ করে বৃহত্তর সিলেট এর যে সকল ঐতিহাসিক স্থান, ওলিআউলিয়া এবং নদ-নদীর নামে ট্রেনের নাম ছিল তা হলো-শাহজালাল এক্সপ্রেস (বিলুপ্ত), কুশিয়ারা এক্সপ্রেস (বিলুপ্ত), জালালাবাদ এক্সপ্রেস (বিলুপ্ত), সুরমা মেইল (ডাকবাহি গাড়ি-চালু আছে তবে নয়টার গাড়ি কয়টায় আসে)। এগুলোর কোনওটিই আন্তনগর ট্রেন নয় এবং সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের কোনও ঐতিহ্যিক বা ঐতিহাসিক নামে কোনও আন্তনগর ট্রেনের নামকরণ হয়নি।
২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ১১ নভেম্বর রেলমন্ত্রী নিযুক্ত হলেন সিলেট বিভাগের তুখোড় রাজনীতিবিদ বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপি। সিলেট অঞ্চলের রেল পরিষেবা গ্রহণকারী যাত্রীগণ আহ্লাদে আটখানা। মন্ত্রীত্ব গ্রহণের অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ঢাকা-সিলেট রুটে একটি আন্তনগর ট্রেন উপহার দিলেন। নাম দিলেন নিজ জেলার একটি নদীর নামে ‘কালনী এক্সপ্রেস’। নামকরণ নিয়ে সিলেট বিভাগের কোনও মানুষ প্রশ্ন তুলেনি। আহ্লাদি ভাবখানা এমন- প্রথম ফসলটাতো গেরস্থই খাবে। ক্রমবর্ধমান ট্রেন চাহিদার কারণে সিলেট অঞ্চলের মানুষের আশা ছিলো, ডাবল রেললাইন হবে, আরও আরও আন্তনগর ট্রেন চালু হবে, সিলেট ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারকসমূহের নামে হবে নতুন নতুন ট্রেনের নামকরণ। আশায় গুড়েবালি, মাত্র দেড়শো দিনের মধ্যে শেষ হয়ে গেলো রেলমন্ত্রিত্ব, দপ্তরবিহীন মন্ত্রীর তকমা লাগিয়ে দিনাতিপাত করতে হলো তাঁকে।
এবার নতুন দুটি ট্রেনের নামকরণ নিয়ে চলছে নানা সমীকরণ। সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলায় কোনও আন্তনগর রেললাইন নেই। সিলেট রেলওয়ে স্টেশন থেকে ছাতক শিল্প এলাকা পর্যন্ত একটি আঞ্চলিক সংযোগ রেললাইন আছে, যা পরিত্যক্ত। ট্রেনের নামকরণের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহ্য চালু আছে- তা হলো প্রান্তিক অঞ্চলের বিখ্যাত স্থানিক নামে রেলওয়ে স্টেশনের নাম হয়। যেমন-কক্সবাজার এক্সপ্রেস (নতুন), বনলতা এক্সপ্রেস (নতুন-রাহশাহী), পঞ্চগড় এক্সপ্রেস, বেনাপুল এক্সপ্রেস, কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস, মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস, সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস, হাওর এক্সপ্রেস, কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস, জামালপুর এক্সপ্রেস, চট্টলা এক্সপ্রেস ইত্যাদি ইত্যাদি। পরিতাপের বিষয় ‘হাকালুকি এক্সপ্রেস’ ‘সিলেট এক্সপ্রেস’ বা ‘পুণ্যভূমি এক্সপ্রেস’ নামে কোনও ট্রেন নেই’।
ঢাকা-সিলেট রুটে প্রত্যাশিত ননস্টপ (স্বল্প বিরতি) ট্রেনের নামের তালিকায় “টাঙ্গুয়ার এক্সপ্রেস” সন্নিবেশিত হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয়-সুনামগঞ্জে কোনও রেললাইন নেই, অথচ দুই দুইটি ট্রেনের নাম সুনামগঞ্জের একটি নদী এবং অন্যটি একটি হাওরের নামে কী করে হলো। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ক্ষমতার কুটচালে পক্ষপাতমূলক নাঙা অঞ্চলপ্রীতির বলি সিলেট এবং মৌলভীবাজারবাসী। বিবেকে দাগকাটা উচিত- মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রী কোনও অঞ্চলের জন্য নিযুক্ত হন না (পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ব্যতীত), নিযুক্ত হন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের আওতায় সারাদেশের মানুষের সেবা দেয়ার জন্য।
এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশের সাবেক সফল অর্থমন্ত্রী মৌলভিবাজারের কৃতী সন্তান এম. সাইফুর রহমানের কথা। তিনি একইসঙ্গে মৌলভিবাজার এবং সিলেট-১ আসনে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন সিলেট-১ আসনের জনগণের জন্য। উন্নয়নও বেশি করেছেন সিলেটে। পক্ষপাতদোষ তাঁকে স্পর্শ করতে পারে নি।
এ প্রসঙ্গে সিলেট রেলওয়ে স্টেশন পুননির্মাণের বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। বর্তমান সিলেট রেলওয়ে স্টেশনটি দেশের পঞ্চম বৃহৎ রেলওয়ে স্টেশন।
ঝরাজীর্ণ স্টেশন থেকে দৃষ্টিনন্দন এ স্টেশনে রূপান্তরের প্রজেক্ট হাতে নেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমান। কিন্তু সরকারের মেয়াদকালে স্টেশনটির কাজ সম্পন্ন হয়নি। পরবর্তীতে জাতীয় সংসদের সফল স্পীকার, সিলেটের জননন্দিত কুটনীতিক, মাটি ও মানুষের নেতা মরহুম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর চ্যালেঞ্জিং বদান্যতায় সিলেট রেলওয়ে স্টেশনটি পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে। স্পীকার যেদিন স্টেশনটির অসমাপ্ত কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে আসেন, সেদিনের কথা সিলেটবাসীর মনে আছে। সুনামগঞ্জের তৎকালীন এক প্রভাবশালী মন্ত্রী স্পীকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর সরকারি প্রটোকল এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উপস্থিতি চরমভাবে রুদ্ধ করেছিলেন। তেমন উল্লেখযোগ্য কেউ সেদিন স্টেশনে উপস্থিত হন নি। কেমন যেন প্রশ্ন উঁকিঝুকি দেয়, নতুন ট্রেনের “টাঙ্গুয়ার এক্সপ্রেস” নামকরণ সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি নয়তো?
‘হাকালুকি হাওর’ এশিয়ার বৃহত্তম জীব-বৈচিত্রে ভরপুর সৌন্দর্যের আধার। এখানে ঝাঁকে ঝাঁকে সুদূর সাইপ্রাস আগত শীতের অতিথি পাখি, নানা প্রজাতির সাধুপানির মাছ, হিজল-তমালের সমারোহে বর্ষায় অগাধ থৈ থৈ জলরাশি- পর্যটকদের মন জোড়ায় শীত-বর্ষা হেমন্তে।
মৌলভিবাজার জেলার ওপর দিয়েই ঢাকা-সিলেট এবং সিলেট-চট্টগ্রামের সকল ট্রেন যাতায়াত করে, অথচ এ জেলার বিখ্যাত কোনও স্থানের নামে কোনও ট্রেনের নাম নেই। “হাকালুকি” এশিয়ার বৃহত্তম হাওর, মৌলভিবাজার এবং সিলেট জেলার বিশাল অংশজুড়ে অবস্থিত। মোদ্দাকথা, বাংলাদেশের হাওরঐতিহ্যের স্মারকশীর্ষ নাম “হাকালুকি”। ঢাকা-সিলেট রুটে প্রস্তাবিত নতুন ট্রেনটি ঢাকায় প্রবেশের পূর্বে বিমানবন্দর স্টেশনে এবং সিলেটে প্রবেশের পূর্বে শ্রীমঙ্গলে ট্রেনটির বিরতি আছে। অতএব ঢাকা-সিলেট রুটে চালুর অপেক্ষারত ট্রেনটির নাম ”হাকালুকি এক্সপ্রেস” করা হোক। এতদসঙ্গে সিলেট-কক্সবাজার রুটের প্রস্তাবিত ট্রেনটির নামকরণ হোক- “সিলেট এক্সপ্রেস” অথবা “পুণ্যভূমি এক্সপ্রেস” নামে।
“হাকালুকি এক্সপ্রেস” নামকরণ অত্যন্ত যৌক্তিক এবং সিলেট-মৌলভিবাজারবাসীর প্রাণের দাবি। এ দাবি বাস্তবায়নে মৌলভীবাজারের কৃতীসন্তান বন পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী জনাব শাহাব উদ্দিন আহমদ এমপি এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন এমপি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীসহ রাজনৈতিক নেতৃত্বের সুদৃষ্টি অত্যন্ত জরুরি।
লেখক : সভাপতি, ভাটেরিয়ান সিলেট
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd