সিলেট ৩০শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৭শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ২:৩৭ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ১৯, ২০২৪
ক্রাইম প্রতিবেদক: সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার- মোকামপুঞ্জি, আলু বাগান, শ্রীপুর, মিনার টিলা, ডিবির হাওড় ও মুক্তাপুরসহ বেশ কয়েকটি সীমান্তের অবৈধ পশু ‘চোরাচালান’ সাম্রাজ্যের কিং হচ্ছেন দুই ওসির দুই লাইনম্যান। এই সীমান্ত গুলোর চোরাচালান নিয়ে অনুসন্ধান করলেই দফায় দফায় উঠে আসে সিলেট জেলা ডিবি পুলিশের (উত্তর) জোনের লাইনম্যান খ্যাত নজরুল ও জৈন্তাপুর থানা পুলিশের লাইনম্যান খ্যাত মুজিবের নাম।
মোকামপুঞ্জি, আলু বাগান, শ্রীপুর, মিনার টিলা, ডিবির হাওড় ও মুক্তাপুরসহ বেশ কয়েকটি সীমান্ত দিয়ে প্রতি রাতেই চোরাই পথে আসছে অসংখ্য অবৈধ পশুর চালান। এ সুযোগ-কে কাজে লাগিয়ে গত কয়েক বছর ধরে সীমান্ত এলাকায় জমজমাট হয়ে উঠছে অবৈধ পশুর ব্যবসা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশীয় খামারীরা। কিন্তু লাভবান হচ্ছেন প্রশাসনের কতিপয় কিছু কর্মকর্তারা।
স্থানীয়দের অভিযোগ- এসব অবৈধ গরু-মহিষের পেঠে করে দেশে আনা হচ্ছে ইয়াবার বেশ বড় বড় চালান। এ কারণে ফের সক্রিয় হয়ে উঠছে স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীরা। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাতের অন্ধকারে চোরাই পথে আসা এসব অবৈধ গরু-মহিষের চালান থেকে সিলেট জেলা ডিবি পুলিশের (উত্তর) জোনের ওসি মোঃ ইকবাল হোসেনের নামে তার লাইনম্যান পরিচয়ে উপজেলার বাওন হাওড় গ্রামের সাঈদ আলীর ছেলে মোঃ নজরুল ইসলাম ও জৈন্তাপুর থানা পুলিশের ওসি মোঃ তাজুল ইসলাম-পিপিএমের নামে তার লাইনম্যান পরিচয়ে একই গ্রামের মৃত ফরিদ মিয়া ওরফে গুইল্লা ফরিদ’র ছেলে মোঃ মুজিবুর রহমান মুজিব ভারত থেকে চোরাই পথে আনা অবৈধ গরু-মহিষ থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করছে। ভাষ্যমতে জৈন্তাপুর সীমান্তে দুই ওসির দুই লাইনম্যানের নিয়ন্ত্রণে এই অবৈধ পশু চোরাচালান বলে এমন অভিযোগ তাদের।
এ বিষয়ে স্থানীয় শেওলারটুক এলাকার আব্দুল বাছেদ মিয়া জানান- লাইনম্যান মুজিব ভারত থেকে চোরাই পথে আসা অবৈধ গরু-মহিষ, চিনি-চাপাতা, কসমেট্রিকস, মাদকদ্রব্যের চালান থেকে জৈন্তাপুর পুলিশের ওসির লাইনম্যান পরিচয় দিয়ে প্রতিনিয়ত চাঁদা উত্তোলন করে আসছে। এছাড়াও বিগত সময়ে সারি নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনলনের (ড্রেজার) বোমা মেশিনের নৌকা থেকে নিয়োমিত চাঁদা উত্তোলন করত সে। তবে তাকে নিয়োমিত চাঁদা না দিলে থানার পুলিশ দিয়ে নৌকা আটক করে বিভিন্ন মামলা-হামলার ভয় দেখাতো সে। জৈন্তাপুর উপজেলার মোকামপুঞ্জি, আলু বাগান, শ্রীপুর সীমান্ত দিয়ে যেসব ভারতীয় অবৈধ পণ্য যেমন- গরু-মহিষ, কসমেট্রিকস, মাদক, চিনি-চাপাতা, ট্যান্ডু পাতার নাসির বিড়ি ও নাসিম বিড়িসহ বিভিন্ন পণ্য সামগ্রীর চালান থেকে প্রতি রাতেই জেলা ডিবি পুলিশের ওসি ও থানা পুলিশের ওসির লাইনম্যান পরিচয়ে চাঁদা উত্তোলন করে নজরুল আর মুজিব। মুজিব সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি দেখানোর জন্য প্রতি রাতে শেওলারটুক ও বাওন হাওড় এলাকায় অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়। মুজিবের অস্ত্রের মহড়ার বিষয়ে এলাকার অনেকেই অবগত রয়েছেন। এ বিষযে আমি জৈন্তাপুর মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার না পেয়ে আমি নিরুপায় হয়ে ২নং জৈন্তাপুর ইউপির সদস্য আব্দুল কাদের-কে অবগত করেছি।
এ বিষয়ে স্থানীয় বাওন হাওড় গ্রামের মোঃ মুকবুল মিয়া জানান- মুজিব থানা পুলিশের লাইনম্যান পরিচয় দিয়ে ভারত থেকে চোরই পথে আসা অবৈধ মালামাল থেকে চাঁদা তুলে এলাকায় আদিপাত্য বিস্তার করে এলাকার মানুষকে থানা পুলিশের ভয় দেখায়। এ কারণে এলাকার কেউ প্রতিবাদ করে না। এলাকায় কোন কিছু করতে গেলে মুজিব-কে টাকা দিতে হয় টাকা না দিলে এলাকার মানুষকে নানা ভাবে পুলিশ দিয়ে হয়রানি করে। আমার নিজের জায়গা থেকে বালু উত্তোলন করেও মুজিব-কে দফায়-দফায় থানা পুলিশের নামে অনেক টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে। কেন আপনী মুজিব-কে চাঁদা দিলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে মুকবুল মিয়া প্রতিদেককে জানান- চাঁদা না দিয়ে কোন উপায় নেই। মুজিব আমাকে নিয়ে ৩দিন থানায় গেছেন ওসি স্যারের সাথে দেখা করাতে কিন্তু ওসি স্যারের সাথে দেখা না করিয়ে থানার গোলঘরে মুস্তাফিজুর স্যারের সাথে দেখা করান। এসময় মুস্তাফিজুর স্যার বালু উত্তোলনের প্রতি ফুট হিসেবে আমাকে একটা রেট নির্ধারণ করে দেন। ওই রেট হিসাব করে আমিসহ অন্যান্য নৌকার মালিকরাও মুজিব-কে নিয়োমিত চাঁদা দিয়ে বালু উত্তোলন করেছি। একবার টাকা দিতে একটু দেরি হওয়ার কারণে থানা পুলিশ এনে মুজিব আমাকে অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ করায় এমনকি আমাকে মানসিক ভাবে অনেক টর্চার করে। বিষয়টি আমি কোন ভাবেই মেনে নিতে পারিনি। আমি থানা পুলিশের নামে টাকা দেওয়ার পরও কেন? আমার উপর এমন অত্যাচার। পরবর্তীতে আমি মুজিব’র কাছে যাই মুজিব আমাকে নিয়ে আবার থানায় যায় ওসি স্যারের সাথে দেখা করাতে পরবর্তীতেও ওসি স্যারের সাথে আমার দেখা হয় নাই।
এ বিষয়ে স্থানীয় বাওন হাওড় গ্রামের মোঃ আলম মিয়া জানান- আমরা গরীব অসহায় মানুষ। একটি নৌকা ভাড়ায় এনে সামান্য বালু উত্তোলন করে কোনমতে আমাদের সংসার চালাচ্ছিলাম। এমন সময় থানা পুলিশের লাইনম্যান পরিচয় দিয়ে মুজিব আমার বালুর নৌকা থেকে পুলিশের নাম করে নিয়োমিত চাঁদা নিয়েছে। সে ভারতীয় চোরাই পথে আসা বিভিন্ন পণ্য সমগ্রী,গরু-মহিষ, চিনি, মাদক, চাপাতা, কসমেট্রিকসের চালান থেকে নিয়োমিত চাঁদা আদায় করে আসছে। কেউ প্রতিবাদ করলে মুজিব বিভিন্ন মিথ্যা মামলা-হামলার ভয় দেখায়। পুলিশের লাইনম্যান পরিচয়দানকারী মুজিব কি? এলাকায় অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়? এমন প্রশ্নের জবাবে আলম মিয়া জানান- বিষয়টি আমি দেখিনি তবে এলাকার অনেকের কাছে শোনেছি।
স্থানীয় বাওন হাওড় এলাকার মোঃ জয়নাল মিয়া জানান- মুজিব থানা পুলিশের লাইনম্যান পরিচয় দিয়ে চোরাচালানের মালামাল থেকে নিয়োমিত চাঁদা তুলে। এ বিষয়টি এলাকার সবারই জানা আছে। আমার বালুর নৌকা থেকে থানা পুলিশের নাম করে অনেক টাকা চাঁদা নিয়েছে মুজিব ও আর ডিবি পুলিশের নামে নজরুল। এদের অত্যাচারে অসহায় এলাকার সাধারণ মানুষ। চাঁদাবাজি, জমি দখল, মানুষকে জিম্মি করে টাকা আদায় করাই তাদের পেশা। সম্প্রতি সময়ে আমি একটি জমি কিনি ওই জমি থেকে তার বাহিনী নিয়ে হামলা করে আমাকে বেদখল দিবে এমন ভয়ভীতি দেখিয়ে আমার নিকট থেকে ১৯ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছে লাইনম্যান নজরুল। পরবর্তীতে জমিটিতে তৃতীয় পক্ষের একটি (ভুমিখেকু চক্রের) দৃষ্টি পড়লে তারা নজরুলকে মুঠা অংকের টাকার লোভ দেখায় এতে নজরুল টাকার লোভে গ্রাম্য শালিসের মাধ্যমে জমিটি তৃতীয় পক্ষকে সমজিয়ে দেয়। বর্তমানে নজরুল ভারত থেকে চোরাই পথে আসা গরু-মহিষের চালান থেকে ডিবি পুলিশের কোন ওসির লাইনম্যান পরিচয় দিয়ে চাঁদাবজি করে আসছে।
সম্প্রতি সময়ে বাওন হাওড় এলাকায় বিল্লাল মিয়ার ফসলী জমির ফসল নষ্ট করে চোরাই পথে আসা ভারতীয় গরু-মহিষের চালান থামিয়ে চাঁদা তুলছে ডিবির লাইনম্যান নজরুল। এসময় বিল্লাল মিয়া ফসল নষ্টের প্রতিবাদ করলে নজরুল তার লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে বিল্লাল মিয়ার উপর হামলা চালিয়ে বাড়ীঘর ভাঙ্গচুর করে। এসময় বিল্লাল মিয়ার স্ত্রীসহ বেশ কয়েক জন আহত হয়।
নজরুলের বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সানকী ভাঙ্গা এলাকার শাহাদৎ শিকদার, হায়দর আলী, তৈয়ব আলী, বাবুল মিয়া, ধনু মিয়া, শাহজাহান মিয়াসহ এলাকার একাধিক লোকজন জানান- নজরুল একজন চাঁদাবাজ। তার কারণে এলাকার মানুষ শান্তিতে নেই। সম্প্রতি সময়ে তাকে চাঁদা না দেওয়ায় ২০/৩০ জনের লাঠিয়াল বাহিনী দেশীয় অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে আমাদের জমি জোর পূর্বক দখল করতে আসে। এসময় গ্রামবাসীর তোপের মূখে নজরুল বাহিনী অস্ত্র-সস্ত্র রেখে পালিয়ে যায়। বিষয়টি আমাদের চেয়ারম্যান সাহেবকে জানিয়েছি।
এ বিষয়ে স্থানীয় বুধিগাও হাওড় গ্রামের আলী হোসেন, মুনসুর আলী, দুলাল মিয়া, মানিক মিয়া, কুহিনুর বেগমসহ একাধিক লোকজন জানান- নুজরুল এলাকায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের চাঁদাবাজির সাথে জড়িত থাকে। সম্প্রতি সময়ে নজরুল ২০/২৫ জনের একটি লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে জোরপূর্বক ভাবে সারী নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী বুধিগাও এলাকা সংলগ্ন নদী থেকে বালু উত্তোলন করে। তাকে বালু উত্তোলনে বাঁধা দিলে নজরুল ও তার বাহিনী আমাদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে হামলার চেষ্টা করে। এ ঘটনায় ডিবি পুলিশের লাইনম্যান নজরুল গংদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক, ডিইজি, পুলিশ সুপার, সহকারী পুলিশ সুপার (গোয়াইনঘাট-সার্কেল) ও পরিবেশ অধিদপ্তর বরাবর আমরা অনেকেই লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছি।
স্থানীয় এলাকার একাধিক ভুক্তভোগী পরিবারের দাবি- প্রশাসনের সাথে সুসর্ম্পক থাকার কারণে ডিবি পুলিশ ও থানা পুলিশের লাইনম্যান পরিচয়দানকারী নজরুল ও মুজিব রয়ে গেছে ধরা ছোয়র বাইরে। ফলে সীমান্ত এলাকাটি পরিণত হয়েছে অপরাধী চক্রের স্বর্গরাজ্যে হিসেবে।
এবিষয়ে নজরুল ইসলাম ও মুজিবুর রহমান মুজিব’র বক্তব্য জানতে তাদের ব্যবহৃত সেলফোনে একাধিক বার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও উভয়ে ফোন রিসিভ করেনি।
এ বিষয়ে জেলা ডিবি পুলিশ (উত্তার) জোনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ ইকবাল হোসেন’র সাথে মোবাইল ফোনে আলাপকালে তিনি জানান- ডিবি পুলিশের নাম ভাঙ্গিয়ে নজরুল ও মুজিব নামের দুই যুবক চাঁদা উত্তোলন করছে এ বিষয়টি আমি শোনেছি। ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে জৈন্তাপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ তাজুল ইসলাম-পিপিএম’র বক্তব্য জানতে সরকারি মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেনি। এদিকে সরকারি নাম্বারে কোন ফোন গেলে তিনি প্রযুক্তির সহয়তায় নিয়ে নাম্বারটি সনাক্ত করেন আর কোনও সাংবাদিকের নাম্বার দেখলে ইচ্ছেকৃত ফোন রিসিভ করেন না বলে একাধিক সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এমন অভিযোগ পাওয়া যায়।
ডিবি পুলিশের লাইনম্যান পরিচয়দানকারী নজরুল ইসলাম ও থানা পুলিশের লাইনম্যান পরিচয়দানকারী মুজিবুর রহমান-মুজিব’র চাঁদাবাজি বন্ধে তদন্ত পূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা নিবেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এমন প্রত্যাশা সচেতন মহলের।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd