সিলেট ৩০শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৭শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ৯:৫৬ অপরাহ্ণ, মে ৮, ২০২৪
ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : হাওরজুড়ে এখন মহা কর্মযজ্ঞ। ধান কাটা, মাড়াই করা, শুকানো, আর কেনা-বেচাতে সরগরম মাঠের পর মাঠ। সোনারাঙা ধানগুলো কৃষকের কাছে একেকটি স্বপ্ন। সারাবছরের ‘খোরাকি’ রেখে যে ধান অবশিষ্ট থাকবে তা বিক্রি করে ছেলে লেখাপড়া, মেয়ের বিয়ে, বৃদ্ধা মা-বাবার চিকিৎসাসহ পরিবারের সারাবছরে আনুষাঙ্গিক খরচ মিটবে। কিন্তু অর্থের প্রয়োজনে স্বপ্নের এই ধান ঘরে তোলার আগেই যখন মাঠ থেকে কমমূল্যে বিক্রি করে দিতে হয়, তখন লোকসানের চিন্তা মাথায় নিয়ে কৃষকের চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রæ ক’জনেই-বা দেখে।
আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় এবার হবিগঞ্জের হাওরগুলোতে বোরো ধানের ফলন ভালো হয়েছে। এরপরও মলিনমুখ কৃষকের। পাইকার এবং ফরিয়াদের সিন্ডিকেটের কারণে ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষক।
প্রতিমণ ধান উৎপাদন করতে কৃষকের খরচ ৮০০ টাকার বেশি। সেই হিসেব বিবেচনা করে সরকার এবার প্রতিমণ ধানের দাম ১২৮০ টাকা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু পাইকার এবং ফরিয়ারা সিন্ডিকেট করে মনপ্রতি ধান ৭৫০ থেকে ৯০০ টাকায় কিনছে।
কৃষকরা বলছেন, ধান কাটা ও মাড়াইসহ আনুষাঙ্গিক খরচে অর্থের যোগান দিতে বাধ্য হয়েই পাইকারদের নির্ধারিত দামে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের।
হবিগঞ্জের বানিয়াচং, আজমিরীগঞ্জ, লাখাই এবং নবীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন হাওরঘুরে দেখা যায়- ব্যবসায়ি ও ফরিয়ারা মাঠ থেকেই শত শত মণ ধান কিনছেন। স্থান ভেদে ধানের দামেও রয়েছে কিছুটা পার্থক্য। কাচাঁ ধান মণপ্রতি ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকা এবং শুকনো ধান ৮৮০ থেকে ৯০০ টাকা দামে বেচা-বিক্রি হচ্ছে।
আজমিরীগঞ্জ উপজেলার শিবপাশা এলাকার কৃষক এমরান হোসেন বলেন, ‘এবার ধানের ফলন অনেক ভালো হয়েছে। কিন্তু উৎপাদন করতে খরচ বেশি হওয়ায়, বর্তমান দামে আমাদের পুষছে না।’
তিনি বলেন, এখন প্রতিমণ কাচাঁ ধান বিক্রি হচ্ছে ৭৭০ টাকায়। এক কের (৩২ শতক) জমি করতে খরচ হয় ১৫ হাজার টাকার বেশি। ধান পাওয়া যায় ১৮-২০ মণ। যদি ধানের দাম এক হাজার টাকার বেশি হতো, তাহলে আমরার কিছুটা লাভ হতো।’
একই উপজেলার কৃষক আলী আমজাদ বলেন, ‘সব জিনিসের দাম বাড়ছে। সারের দাম ডাবল হইয়া গেছে। ধান কাটতে কামলাওে দেওয়া লাগে এক হাজার টাকা কইরা। কিন্তু ধান বেচার সময় দাম পাই না। সাড়ে সাতশো থেকে আটশো টাকায় ধান বেচা লাগে।’
তিনি বলেন, ‘ধান কইরা আমাদের এখন যেভাবে লস হইতাছে, বেশিদিন আর ধান করা যাইতো না। সব জিনিসের দাম বাড়ে, ধানের দাম বাড়ে না।’
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ি হাওরের প্রায় ৮০ শতাংশ ধান কাটা শেষ হয়ে গেছে। তবে এখনও সরকারিভাবে ধান কেনা শুরু হয়নি। এমনকি জেলা থেকে কি পরিমাণ ধান কেনা হবে তাও নির্ধারণ করা হয়নি।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক চাই থোয়াই প্রæ মার্মা বলেন, ‘হবিগঞ্জে আগামী ৭ মে থেকে ধান সংগ্রহ অভিযান শুরু হবে। তবে জেলা থেকে কি পরিমাণ ধান-চাল কেনা হবে তা নির্ধারণ করা হয়নি। হয়তো ২/১ এদিনের ভেতরে বরাদ্দ আসবে।’
জেলায় এ বছর বোরো আবাদ হয়েছে ১ লাখ ২৩ হাজার ৭৩৭ হেক্টর জমিতে। যেখানে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্র ধরা হয়েছে ৫ লাখ ২০ হাজার ৬৫০ মেট্রিকটন। যার বাজার মুল্য প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা।
পরিসংখ্যান বলছে, হবিগঞ্জে প্রতি বছর যে পরিমাণ ধান উৎপাদন হয় তার ১৮ থেকে ২০ শতাংশ কিনতে পারে সরকার। বাকি ৬০ শতাংশের বেশি ধান পাইকার বা ফরিয়াদের কাছেই বিক্রি করতে হয়। কৃষকরা বলছেন, যদি সরকার বৈশাখের শুরুতেই পাইকারি পর্যায়েও ধানের দাম নির্ধারণ করে দেয়, তাহলে ধানের ন্যায্যমূল্য পাবেন তারা। অন্যতায় প্রতি বছরের যে লৈাকসানের বৃত্ত তৈরী হয়, সেখান থেকে বের হওয়া যাবে না।
লাখাই উপজেলার কৃষক আব্দুল মজিদ বলেন, ‘হাওরের বেশিরভাগ ধানই কাটা হয়ে গেছে। কিন্তু সরকার একটি দাম নির্ধারণ করে বসে আছে। এখনও ধান কেনা শুরু করেনি। কৃষকরা যখন কম দামে পাইকার বা ফরিয়াদের কাছে ধান বিক্রি করে ফেলবেন, তখন সরকার ধান কিনবে। তাহলে সরকারের এই দামে কি কৃষক উপকৃত হবেন? এছাড়া কৃষক যদি সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে যায়, তাহলে তাদের নান অজুহাত থাকে।’
তিনি বলেন, ‘সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার প্রকৃয়া আরো সহজ করতে হবে। এছাড়া বৈশাখের শুরুতেই ধান কেনার ব্যবস্থা করতে হবে।’
জেলা নাগরিক আন্দোলন কমিটির সভাপতি পীযূষ চক্রবর্তী বলেন, ‘কৃষক রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ফসল ফলায়। অথচ বিক্রির সময় তারা দাম পায় না। ৭০০-৮০০ টাকা মন দামে তাদেরকে ধান বিক্রি করতে হয়। কিন্তু বাজাওে চালের দাম দেখা যায় দিনদিন বাড়ছেই। কারণ মধ্যস্বত্তভোগীরা নিজেদের ইচ্ছেমতো কৃষকদের জিম্মি করে রেখেছে।’
তিনি বলেন, ‘কৃষকদের সবচেয়ে বড় দুঃখ হলো সে সারাবছর যে ফসল ফলিয়েছে তার দাম কত হবে সে জানে না। তার উৎপাদিত পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয় তৃতীয় পক্ষ। তাও যদি কৃষকদেও সাথে বসে আলোচনা করে সার্বিকভাবে দাম নির্ধারণ করা হতো তাহলে কৃষকের অন্তত লোকসান গুণতে হতো না।’
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd