অনিয়ম-দূর্নীতির আখড়া সিলেটের বিদ্যুৎ অফিস!

প্রকাশিত: ৬:০০ অপরাহ্ণ, জুন ২৮, ২০২৪

অনিয়ম-দূর্নীতির আখড়া সিলেটের বিদ্যুৎ অফিস!

ক্রাইম প্রতিবেদক: বিদ্যুৎ খাতের নানা অপচয় ও বকেয়া বিল ঠেকাতে ভিশন-২০২১-এর আওতায় স্মার্ট প্রিপেইড মিটার সংযোজনের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। পরিতাপের বিষয় বিদ্যুৎ খাতের অনিয়ম ঠেকাতে সরকার বিপুল অর্থ খরচ করে যে উদ্যোগ নিয়েছিল সেটাকেই ইস্যু করে গড়ে উঠেছে অনিয়ম আর দুর্নীতি। গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ এর নতুন সংযোগ পোস্ট-পেইড মিটারে নতুন সংযোগ দেয়া বন্ধ হলেও বিদ্যুৎ আইন ও নিয়ম কানুন এর তোয়াক্কা না করে অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় রুপ ধারণ করেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-৪ কুমারগাঁও সিলেট অফিস। সাথে যোগ হয়েছে গ্রাহক ভোগান্তির নতুন মাত্রা। সেই নীল নকশা বাস্তবায়নে কাজ করছেন মাঠ পর্যায় থেকে শুরু করে অফিসের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

 

সরকার ঘোষণা দিয়ে চার বছর পূর্বে ২০২১ সালে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ এর নতুন সংযোগ পোস্ট-পেইড মিটার স্থাপন বন্ধ করা হয়। কিন্তু এই অফিসে কর্মরত বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারী সেই আদেশ উপেক্ষা করে নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করেই খুলে আনা পোস্ট-পেইড মিটার গ্রাহকের অগোচরে জালিয়াতি করে মালিকানা ও এলাকা পরিবর্তনের মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।

 

সিলেট সদর এয়ারপোর্ট থানাধীন লাখাউরা গ্রামের মাসুদ আহমেদের অভিযোগের সুত্র ধরে অনুসন্ধানে উঠে আসে এই অনিয়মের চিত্র। অভিযোগে মাসুদ উল্লেখ করেন- অক্টোবর ২০২১ সালে বিদ্যুৎ মিটার রিডার মাহবুব এর মাধ্যমে তার বাসায় ৭ হাজার টাকার বিনিময়ে সাবেক উপ-সহকারী প্রকৌশলী রুহুল আমিন এর কাছ থেকে তার মা সুফিয়া বেগমের নামে একটি নতুন সংযোগ তিনি নেন। সেই বিদ্যুৎ মিটারে অক্টোবর ২০২১ থেকে নভেম্বর ২০২২ পর্যন্ত কোন বিদ্যুৎ বিল তাকে অফিস থেকে প্রদান করা হয়নি। ডিসেম্বর ২০২২ থেকে তারা নিয়মিত বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে আসছেন। গত ০৫/০৫/২০২৪ ইং তারিখে তাদের কিলোওয়াট বৃদ্ধি করার জন্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-৪ কুমারগাঁও সিলেট অফিসের সহকারী প্রকৌশলী আজহারুল ইসলামের সাক্ষরিত একটি নোটিশ প্রদান করা হয়। নোটিশপ্রাপ্তির পর তারা অফিসে গিয়ে এর কারণ জানতে চাইলে একই অফিসের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আল্ ইমরান জানান- তাদের মিটারে সমস্যা আছে এমকি বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রয়েছে এবং ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার অধিক বিল আসবে। এরকম করে প্রায় ২ সপ্তাহ অফিসে যাতায়াত করার পর গত ২০/০৫/২০২৪ ইং তারিখে তারা অফিসে গেলে ২৫ হাজার ৪৯৯ টাকার একটি বিলের কাগজ তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এমনকি ৭ দিনের ভিতরে এই বিল পরিশোধ না করলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দামার হুমকি প্রদান করেন সহকারী প্রকৌশলী আজহারুল ইসলাম ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী আল্ ইমরান।

 

এমতা অবস্থায় নিরুপায় হয়ে গত ২১/০৫/২০২৪ ইং তারিখে বর্ণিত বিষয়ে ক্রাইম সিলেট পত্রিকার সম্পাদক বরাবারে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন সুফিয়া বেগমের পুত্র মাসুদ আহমদ। অভিযোগের সুত্র ধরে মাঠে নামে আমাদের অনুসন্ধানী টিম আর ধাপে ধাপে বেরিয়ে আসতে থাকে ওই বিদ্যুৎ অফিসের কর্মকর্তাদের নানান অনিয়ম-দূর্নীতির চিত্র।

 

অনুসন্ধানে জানা গেছে- জালালাবাদ থানাধীন গোয়াবাড়ি এলাকার প্রবাসী মোঃ আব্দুল ছালেকের ৭২৮১৪৪ নাম্বারের মিটার জালিয়াতির মাধ্যমে মালিকানা পরিবর্তন করে নয়াবাজার এলাকার শ্রী কল্পনা দাসের নামে প্রদান করা হয়েছে। তবে গত ০৮/০৯/২০২২ ইং তারিখে এনালগ বলে মিটারটি খুলে নিয়ে আসেন উপ-সহকারী প্রকৌশলী আল্ ইমরান। নিয়মনীতির বাহিরে এরকমটা হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মিটার মালিক প্রবাসী আব্দুল ছালেকের বাতিজা অমেল জানান- এ বিষয়ে তারা কিছু জানেন না তবে এসবের মূল কারিগর উপ-সহকারী প্রকৌশলী আল্ ইমরান। এদিকে উপ-সহকারী প্রকৌশলী আল্ ইমরান জানান- এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না এ বিষয়ে সহকারী প্রকৌশলী আজহারুল ইসলাম ভালো জানেন বলে তার দাবি।

 

অনুসন্ধানে আরোও জানা গেছে- জালালাবাদ থানাধীন উপরপাড়া এলাকার বাসিন্দা ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক কর্মচারী আব্দুল জব্বারের নামীয় মিটার যাহার নং- ৩০৭১৫। এই মিটারটিও জালিয়াতির মাধ্যমে মালিকানা ও এলাকা পরিবর্তন করে একই থানাধীন দুসকি এলাকার নূর মিয়ার পুত্র সজিব মিয়ার নামে প্রদান করা হয়েছে, যাহার বর্তমান মিটার নং- ৩০৮৫৯০। এই বিষয়ে আব্দুল জব্বারের পুত্র মাশুক মিয়া প্রতিবেদকে জানান- গত ২৪/১২/২০১৯ ইং তারিখে তার পিতা মৃত্যু বরণ করেন তবে কে বা কারা তাদের মিটারটির মালিকানা ও এলাকা পরিবর্তন করেছে তার কিছুই তাদের বোধগম্য নয়। এদিকে সজিব মিয়ার সঙ্গে মালিকানা ও এলাকা পরিবর্তন করা মিটারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান- মিটারটি তিনি অফিস থেকে কিনে এনেছেন তবে কে বা কার কাছ থেকে কিনেছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কারো নাম বলতে পারবেন না বলে সাফ জানান।

 

এদিকে, একই থানাধীন আলী বাহার টি,এন, কোম্পানীর নামীয়, যাহার নং- ১০১৬৩৪ মিটারটিও জালিয়াতির মাধ্যমে মালিকানা ও এলাকা পরিবর্তন করে দুসকি এলাকার মৃত মছরব আলীর পুত্র মোঃ ছমির মিয়ার নামে প্রদান করেছে বিদ্যুৎ অফিস, যাহার বর্তমান মিটার নং- ৯৬৩৩৬৫। এ বিষয়ে আলী বাহার টি,এন, কোম্পানীর ম্যানেজারের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান- এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না এসব বিদ্যুৎ অফিসের কর্মকর্তারা জানেন।

 

অন্যদিকে, দুসকি এলাকার মোস্তাক আলীর নামে গত ০৬/০৬/২০২১ ইং তারিখে একটি নতুন আবাসিক পোষ্ট-পেইড মিটারের সংযোগ নেন তিনি। সেই মিটারের ডিসপ্লেতে একটি নাম্বার আর বডিতে আরেকটি নাম্বার এবং আবাসিক বলে সংযোগ নিলেও বাণিজ্যিকখ্যাতে মিটারটি ব্যবহার করা হচ্ছে এমনটা সরজমিনে দেখা গেছে। র্দীঘদিন অদৃশ্য কারণে এ মিটারের বিদ্যুৎ বিল না পাঠালেও গত ০৮/০৯/২০২২ ইং তারিখে সর্বপ্রথম মাত্র ১৫০ ইউনিটের বিদ্যুৎ বিল প্রদান করে বিদ্যুৎ অফিস। কিন্তু সংযোগের পরবর্তী ১৫ মাসের বিদ্যুৎ বিলের কোন হদীস মিলে নি এমনকি এ নিয়ে কোন মাথা নেই যেনও বিদ্যুৎ অফিস কর্তৃপক্ষের।

 

এসব বিষয়ে প্রতিবেদক দফায় দফায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-৪ কুমারগাঁও সিলেট অফিসে যাতায়াত করার পরে সহকারী প্রকৌশলী আজহারুল ইসলাম জানান- এবিষয়ে সিলেটের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-৩ এর প্রকৌশলী শ্যামল চন্দ্র সরকারকে প্রধান করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন আসলে বিস্তারিত জানানো হবে।

 

এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান শ্যামল চন্দ্র সরকারের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান- তদন্ত কার্যক্রম শেষ করে তিনি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-৪ এর অফিসে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। তবে প্রতিবেদনে কাদের বিরদ্ধে অনিয়ম-দূর্নীতির সত্যতা পাওয়া গেছে এমন প্রশ্নের জবাবে অদৃশ্য কারণে তিনি মুখ খুলতে নারাজ।

 

তদন্ত কার্যক্রম শেষ হওয়ার প্রায় সপ্তাহখানেক পর সহকারী প্রকৌশলী আজহারুল ইসলাম জানান- দুইজন মিটার রিডার ও কম্পিউটার সেকশনের একজনের বিরুদ্ধে নানান অনিয়ম-দূর্নীতির সত্যতা পাওয়ায় তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। তবে অদৃশ্য কোন এক কারণে তিনিও এই তিনজনের নাম প্রকাশ করতে নারাজ।

 

এ বিষয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মুন্সি ইঞ্জিনিয়ার্স এন্ড এসোসিয়েশনের সুপারভাইজার আশরাফ আলীর সাথে সরাসরি এবং মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি দুইজন মিটার রিডারের চাকরিচ্যুতের নোটিশ প্রাপ্তির সত্যতা নিশ্চিত করে জানান- অবৈধভাবে মালিকানা পরিবর্তন করার দায়ে বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-৪ থেকে মিটার রিডার ওমর ফারুক ও মাহবুবের নামে চাকরিচ্যুতের নোটিশ আমাদের কাছে দেওয়া হয়েছে। তবে যা ব্যবস্থা নেওয়ার আমাদের ম্যানেজার স্যার নিবেন।

 

এ বিষয়ে মুন্সি ইঞ্জিনিয়ার্স এন্ড এসোসিয়েশনের ম্যানেজার লিমনের সাথে সেলফোনে দুই দফায় যোগাযোগ করলে তিনি কোন নোটিশ পান নি বলে জানান।

 

এ বিষয়ে কম্পিউটার সেকশনের টিটু শর্মা নিজেই তার চাকরিচ্যুতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এবং প্রতিবেদকে বিভিন্ন রকমের প্রলোভন দেখিয়ে সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য আকুতি-মিনুতি করেন।

 

এ বিষয়ে বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-৪ এর উপ-সহকারী প্রকৌশলী আল ইমরান এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ অস্বীকার কিংবা স্বীকার করেন নি এবং এই বিষয়ে কোন মন্তব্য করতেও রাজি হননি। উল্টো সহকারী প্রকৌশলী আজহারুল ইসলাম এর সাথে আলাপ করার কথা বলেন এবং সহকারী প্রকৌশলী আজহারুল ইসলাম সব কিছু জানেন বলেও জানান তিনি।

 

বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-৪ এর প্রকৌশলী মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এর সাথে সরাসরি দেখা করে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান- আমি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পরে দুইজন মিটার রিডার এবং কম্পিউটার সেকশনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দিয়েছি যা ব্যবস্থা নেওয়ার তারাই নিবেন তিনিও এই তিনজনের কারো নাম প্রকাশ করতে নারাজ।

 

উল্লেখ্য যে, বর্ণিত বিষয়ে যাতে কোন ধরণের সংবাদ প্রকাশ না হয় সেজন্য প্রতিবেদকের নিকট বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-১ এর সাবেক উপ-সহকারী প্রকৌশলী নুরুল আমিনকে পাঠান বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-৪ এর উপ-সহকারী প্রকৌশলী আল ইমরান। এমনকি আল ইমরান নিজে নুরুল আমিনের সেলফোন মারফতে প্রতিবেদককে সঙ্গে কথা বলে তাকে মোটা অংকের টাকার প্রস্তাব করে উক্ত সংবাদটা যাতে প্রকাশিত না হয় সেজন্য আহ্বান জানান।

চলমান সংবাদ নং- ০১।

Sharing is caring!

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

June 2024
S S M T W T F
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930  

সর্বশেষ খবর

………………………..