অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিনেই রণক্ষেত্র সিলেট

প্রকাশিত: ১০:০৩ অপরাহ্ণ, আগস্ট ৪, ২০২৪

অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিনেই রণক্ষেত্র সিলেট

নিজস্ব প্রতিবেদক : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিনেই রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে সিলেট নগর। স্থানে স্থানে হামলা, সংঘর্ষ, গুলিতে নগরজুড়ে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

রোববার বেলা ১২টার দিকে নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে পয়েন্টে ছাত্র-জনতার সাথে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল ও শর্টগানের গুলীতে এবং ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলায় সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, কিশোরসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। এরমধ্যে ২ কিশোরসহ ৫ জনের অবস্থা গুরুতর বলে জানা গেছে। এদিকে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বেলা ৮টায়ও নগরীর সকল পয়েন্টে থেমে থেমে সংঘর্ষ চলছিল। এসময় আন্দোলনকারীদের পাশাপাশি সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের সশস্ত্র অবস্থান নিতে দেখা গেছ।

শিক্ষার্থীরা জানান, ১১টা থেকে কোর্ট পয়েন্টে শান্তিপূর্ণ অবস্থান করেন তারা। বেলা দেড়টার দিকে নগরীর বন্দরবাজার কোর্টপয়েন্ট থেকে জিন্দাবাজার এলাকায় দেশী-বিদেশী অস্ত্র নিয়ে ছাত্র-জনতার উপর হামলা করে ছাত্রলীগ। তখন জিন্দাবাজার পয়েন্টে ছাত্র-জনতা তাদেরকে ধাওয়া দিলে ছাত্রলীগ ফিরে আসে। তখন পুলিশ ছাত্র-জনতার উপর গুলীবর্ষণ করে ছাত্রলীগকে এগিয়ে নিয়ে যায়। তখন ছাত্রলীগ আরো বেপরোয়া হয়ে ছাত্র-জনতা ও নিরীহ পথচারীদের কোপাতে থাকে। এসময় বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হন।

এদিকে ছাত্র-জনতার উপর ছাত্রলীগের হামলার খবর ছড়িয়ে পড়লে বেলা ২টার পর থেকে সংঘর্ষ পুরো নগরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত নগরীর সুরমা মার্কেট পয়েন্ট, তালতলা, বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, নাইওরপুল, সোবহানীঘাট, উপশহর, মিরাবাজার, শিবগঞ্জ, টিলাগড়, আম্বরখানা, সুবিদবাজার, পাঠানটুলা, মদীনা মার্কেট, চন্ডিপুল, কদমতলী বাস টার্মিনাল, তেমুখী, কুমারগাওসহ পুরো নগরজুড়ে চলতে থাকে সংঘর্ষ। শিক্ষার্থীরা টায়ার জালিয়ে রাস্তা অবরোধ করে রাখে।

রোববার সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল ১০টা থেকে আন্দোলনে অংশ নিতে নগরীর কোর্টপয়েন্টে জড়ো হতে থাকে শিক্ষার্থী ও জনতা। বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন পয়েন্টে আগুন লাগিয়ে রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। ছাত্রজনতা নগরীর বন্দরবাজার, কোর্ট পয়েন্ট, তালতলা, জিন্দাবাজার, মহাজনপট্টি, নয়াসড়ক, বারুতখানা, ওসমানী শিশু পার্কের সামনে বিচ্ছিন্নভাবে জড়ো হয়ে মিছিল স্লোগান দিতে থাকেন। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বন্দর কোর্ট পয়েন্টে ছাত্র-জনতার উপস্থিতি ক্রমশ বাড়তে থাকে। এ সময় তাদের সঙ্গে সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপি এবং ছাত্রদলসহ অন্যান্য সংগঠনের নেতাকর্মীরা কর্মসূচীতে যোগ দেয়। ছাত্র-জনতা পুলিশকে দেখে ভুয়া ভুয়া স্লোগানে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। দুপুর ১২টার দিকে উভয়পক্ষের মাঝে উত্তেজনা দেখা দিলে পুলিশ তাদের দিকে সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল, টিয়ারগ্যাস, রাবার বুলেট ছুড়তে শুরু করে এবং ছাত্রজনতার পক্ষ থেকেও ছুড়া হয় ইটপাটকেল। এতে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর ফের বন্দরবাজার কোর্ট পয়েন্ট দখলে নেয় ছাত্রজনতা। তখন নগরীর তালতলা পয়েন্ট এলাকায় আওয়ামীলীগ-যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা সমবেত হতে থাকেন। বেলা ১টার দিকে নগরীর কোর্ট পয়েন্ট এলাকা থেকে ছাত্রজনতাকে ফের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে পুলিশ। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যেতে না চাইলে আবারো একশনে যায় পুলিশ। তখন শিক্ষার্থীরা জিন্দাবাজার পয়েন্টের দিকে চলে যায়। দেড়টার দিকে সামনে পেছনে পুলিশ প্রহরায় কোর্টপয়েন্টে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীরা। এসময় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা জিন্দাবাজারের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। তখন পুলিশ ডায়বেটিক হাসপাতালের সামনে থেমে যায়। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগকে ধাওয়া দিলে তারা ফের বন্দরের দিকে ছুটে আসে। তখন পুলিশ এগিয়ে গিয়ে শিক্ষার্থীদের উপর গুলীবর্ষণ করে। তখন ছাত্রলীগ আবার এগিয়ে গিয়ে শিক্ষার্থী ও নিরীহ পথচারীদের কোপাতে থাকে। ছাত্রলীগের হামলায় অন্তত ২০ জন আহত হন। রোববার দিনভর দফায় দফায় সংঘর্ষে অন্তত ১০০ জন আহত হয়েছেন।

সিলেট মহানগর পুলিশের উপ পুলিশ কমিশনার আজবাহার আলী শেখ বলেন, আন্দোলনকারীরা পুলিশের ওপর অতর্কিত হামলা চালালে আমরা প্রতিরোধ করি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমরা ফাঁকা গুলি চালাই।

সরকার পতনের একদফা দাবিতে রোববার থেকে অনির্দিষ্টকালের সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এ আন্দোলনের শুরুর দিন সকাল থেকে সিলেট মহানগরে যানবাহন কম চলাচল করতে দেখা গেছে। অন্যান্য দিন সকাল ১০টা থেকে দোকানপাট খোলা শুরু করলেও রোবাবর সিলেটের চিত্র ছিল ভিন্ন।

সকাল ১০টার দিকে বন্দরবাজার, জিন্দাবাজারসহ নগরীর কোনো মার্কেট বা দোকান খোলা দেখা যায়নি। এ ছাড়া এসময় অন্যান্য দিন সড়কে কর্মব্যস্ত মানুষের ছুটে চলা চোখে পড়লেও আজ এমন দৃশ্য ছিল না। সকালে দিকে সড়কে যানবাহন কম থাকলেও দুপুরের পর যানবাহন শুন্য হয়ে পড়ে পুরো নগরী।

এমপি হাবিবের অফিসে হামলা :
অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিবের অফিসে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া গেছে। রোববার বেলা দুইটার দিকে মহানগরীর চন্ডিপুলস্থ অফিসে এই হামলার হয়। জানা গেছে, বেলা দুইটার দিকে একদল দুর্বৃত্তরা অফিসের সামনে থাকা ১০-১২টি মোটরসাইকেলে আগুন দেয়। এসময় অফিসের গ্লাস, চেয়ার ভাঙচুর করা হয়। সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, আমার অফিস বন্ধ ছিলো। এক দল দুর্বৃত্ত অফিসের সামনে হামলা চালিয়েছে।

৪ সাংবাদিক আহত :
অসহযোগ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রোববার সকাল থেকেই নগরীর কোর্ট পয়েন্টে পুলিশ-আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার পর দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পরে মহানগরের বিভিন্ন এলাকায়। সংঘর্ষ চলাকালে ৪ সাংবাদিক আহত হয়েছেন। এক সাংবাদিকের ক্যামেরা ভাংচুরেরও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে চ্যানেল এস এর সিলেট ব্যুরো চীফ মঈন উদ্দিন মঞ্জু পুলিশের গুলীতে আহত হন। এছাড়া একাত্তর টেলিভিশনের রিপোর্টার হোসাইন আহমদ সুজাদ ও ক্যামেরাপার্সন তারেক আহমেদ ও যুগান্তরের ফটো সাংবাদিক মামুন হাসান আহত হয়েছেন। এর মধ্যে আন্দোলনকারীদের মারধরে আহত একাত্তর টেলিভিশনের রিপোর্টার হোসাইন আহমদ সুজাদ সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এছাড়া ভাঙা হয়েছে একাত্তর টেলিভিশনের ক্যামেরা।

আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয়ে হামলা অগ্নিসংযোগ :
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘোষিত সরকার পতনের একদফা দাবীতে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে সিলেটের আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয়ে হামলা-অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া গেছে। রোববার বিকাল ৪টার দিকে সিলেট আঞ্চলিক নির্বাচন কমিশন অফিস ও এর পার্শ্ববর্তী মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবনে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে আন্দোলনকারীরা।

এসময় নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুটি মোটরসাইকেল ও দুটি জিপ গাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের টিম গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, বেলা ২টা থেকে নগরীর শাহজালাল উপশহর পয়েন্টে কয়েকশ আন্দোলনকারী জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। বিকাল ৪টার দিকে হঠাৎ তারা উপশহর পয়েন্ট সংলগ্ন সিলেট আঞ্চলিক নির্বাচন কমিশন অফিস ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবনে হামলা ও ভাঙচুর শুরু করেন। নির্বাচন কমিশন অফিসের সামনে থাকা দুটি মোটরসাইকেল ও গ্যারেজে থাকা দুটি জিপ গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেন। এতে গাড়িগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এছাড়া নির্বাচন কমিশন অফিসের বিভিন্ন কক্ষে ঢুকে আন্দোলনকারীরা ব্যাপক ভাঙচুর চালান। খবর পেয়ে বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের একটি টিম গিয়ে নির্বাচন অফিসের গ্যারেজের আগুন নিভায়।

কাস্টমস অফিসে হামলা :
নগরীর উপশহর মেন্দিবাগ সংলগ্ন কাস্টমস এক্সাইজ-ভ্যাট কমিশনারেট অফিস ও কর ভবনে হামলার ঘটনা ঘটেছে। রোববার বিকেল পাঁচটার দিকে এ ঘটনা ঘটে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক দল দুর্বৃত্ত মেন্দিবাগ কাস্টমস এক্সাইজ- ভ্যাট কমিশনারেট অফিসে হামলা চালায়। এসময় তারা অফিসের বাহিরের গ্লাস ভাঙচুর করে। একই সময় কর ভবনেও হামলা হয়। এসময় ভেতরে থাকা কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় এক ঘন্টা ভেতরে অবরুদ্ধ ছিলেন তারা। পরে পুলিশে এসে দুর্বৃত্তদের ধাওয়া করে ছত্রভঙ্গ করে। তবে কেউ হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

August 2024
S S M T W T F
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31  

সর্বশেষ খবর

………………………..