সিলেট ৩০শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৭শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ৪:১১ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৪
ক্রাইম প্রতিবেদক:
সিলেট নগরীর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কার্যালয় সংলগ্ন গলির ভেতরে মুক্তিযোদ্ধা উপশাখা অফিসে ফাই-ফরমাশ খাটার চাকরি নিয়েছিলেন মো. জাকারিয়া আহমদ। সে গল্পটি কয়েক দশক আগের। এখন সে জাকারিয়া আহমদই অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা-সভাপতি। নির্বাচন ছাড়াই দেড় যুগ ধরে অটোরিকশা শ্রমিকদের উপর ছড়ি ঘুরাচ্ছেন তিনি। সিলেট বিভাগের শ্রমিক ইউনিয়নের মধ্যে এ ইউনিয়নেই সবচেয়ে বেশি সদস্য। সদস্য সংখ্যা প্রায় ৪৫ হাজার। বিশাল এ শ্রমিকের শক্তিকে পুঁজি করে জাকারিয়া আহমদ যখন-তখন সড়কে হামলে পড়েন। প্রতিষ্ঠা করেন ত্রাসের রাজত্ব। ‘ছোট যানে’র নেতা হলেও কাঁপন ধরিয়ে দেন ‘বড় যানে’র নেতাদের মনেও। দাপটের রাজনীতিতে তিনি সমান তালে পাল্লা দেন ট্রাক-বাসের শ্রমিক নেতাদের সাথে। তিনি সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমানের অনুসারী হওয়ার সুবাধে ভাগিয়ে নিয়েছেন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদকের পদও। তার পেছনে অর্ধলক্ষ শ্রমিকের শক্তি ও আওয়ামী লীগের সিলেটসহ বড় বড় কয়েকজন নেতাদের ছত্রছায়ার পুঁজিই তাকে করে তুলেছে সিলেটের পরিবহন সেক্টরের ‘ঈশ্বর’। তার অঙ্গুলি হেলনে অচল হয়ে পড়ে সিলেটের রাজপথ। প্রশাসনও তার শক্তির কাছে খেই হারিয়ে ফেলে কখনও কখনও। বিধ্বংসী এই মাফিয়া এখন সিলেটের সাধারণ মানুষের কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্ক। জাকারিয়া আহমদের বাড়ি সিলেট শহরতলির টুকেরবাজারে। বাবার নাম আবদুল হাসিব।
ছোটবেলাতেই বাবা তাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন। বাবার ত্যাজ্য সন্তান হিসেবে একদম খালি হাতে কর্মজীবন শুরু করা জাকারিয়া আহমদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় মুক্তিযোদ্ধা উপশাখাই। কিছুদিন অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করায় শ্রমিকদের সাথে তারা চেনাজানা হতে থাকে। বুদ্ধির জোরে একসময় তাদেরই নেতা বনে যান। মুক্তিযোদ্ধা উপশাখার সভাপতিও হন এক সময়। তারপর থেকেই তার উত্থানের শুরু। এক সময় দখলে আসে সিলেট জেলা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতির পদও। তারপর পেরিয়ে গেছে দেড় যুগ। সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমানের অনুসারী হওয়ার সুবাধে পদ আগলে রেখেছেন এখনও। দীর্ঘ এ সময়ে দাপটের পাশাপাশি সম্পদও বাড়তে থাকে জাকারিয়া আহমদের। তবে কৌশলী জাকারিয়া আহমদ তার বিশাল সম্পদের খবর সাধারণ শ্রমিকের কাছে আড়াল করেই রাখেন। চোখে পড়ার ভয়ে দেশে তেমন সম্পদ না করলেও বিভিন্ন সূত্র বলছে, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার সম্পদ।
নিরীহ শ্রমিকরা প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদা দিলেও ইউনিয়ন থেকে কোনো সুবিধাই পান না তারা। অথচ নেতাদের ‘অ্যাকাউন্টে’ টাকা জমছে প্রতিদিনই। শ্রমিকের ঘামের টাকায় বাড়ি-গাড়ি করে এসির নীচে আয়েশি জীবন কাটছে তাদের। অবশ্য এ নেতার উপর অষ্টপ্রহর সাধারণ শ্রমিকের দীর্ঘশ্বাসের ছায়াও পড়ে। লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদা দিলেও নিজেদের বিপদে সাধারণ শ্রমিকরা কোনো সহযোগিতাই পান না তার কাছ থেকে। উল্টো ছোটখাট বিবাদ হলে সালিশ বৈঠকের জন্য নিজেদের পকেট খালি করে নেতার পকেট ভারি করতে হয়। নইলে ‘বিচার’ মেলে না। তারপরও সবকিছু মুখ বুজে মেনে নেন তারা। কারণ প্রতিবাদ করলে উল্টো মামলা-হয়রানির শিকার হতে হয়েছে।
গত (০৫ আগষ্ট) ছাত্র-জনতার তোপেড় মুখে পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। এতে খুব একটা বেকায়দায় পড়েন জাকারিয়া। নিজের আখের গুছাতে মরিয়া হয়ে পূর্নবাসনের চেষ্টায় গুরতে থাকেন বিএনপির নেতাদের দরজায়। তবে কেন্দ্রীয় নির্দশেনার ভয়ে সিলেট বিএনপির মূলধারার নেতারা জাকারিয়াকে পাত্তা না দিলেও অবৈধ কালো টাকার গন্ধে নিজেদের সামলাতে পারেননি কতিপয় হাতেগোনা কয়েকজন বিএনপি নেতা।
গতকাল শুক্রবার (০৬ সেপ্টম্বর) রাত ৯টার দিকে নগরীর ৩৯নং ওয়ার্ডের টুকের বাজারে জিন্দাবাজার মুক্তিযোদ্ধা উপ-পরিষদ শ্রমিকবৃন্দ- ৭০৭ এর আয়োজিত এক সভায় ‘তিন চাকার’ মাফিয়া জাকারিয়ার সমর্থনে সিলেট জেলা বিএনপির উপদেষ্টা আব্দুর রহমান, জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মোঃ কালাম, জেলা ছাত্রদলের বহিষ্কৃত সাবেক সভাপতি ও বর্তমান ৩৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আলতাব হোসেন সুমন, জেলা ছাত্রদলের সাবেক সহ-সাধারণ সম্পাদক শামিম আহমদ, সিলেট সদর উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহবায়ক ওলিউর রহমান আলী (আলীবুর) ও জামায়াত নেতা উসমানকে উক্ত সভায় উপস্থিত হয়ে ‘তিন চাকার’ মাফিয়া জাকারিয়াকে পূর্নবাসন করতে তার পক্ষে সাফাই গেয়ে বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। ‘বিএনপিতে চাঁদাবাজ-অনুপ্রবেশকারীদের ঠাঁই নেই’ দলীয় এমন নির্দশনাকে উপেক্ষা করে এই বিএনপি নেতারা ‘তিন চাকার’ মাফিয়া আওয়ামী লীগ অনুসারী জাকারিয়াকে প্রকাশ্য পুনর্বাসনের ঘটনায় ক্ষোভের ঝড় বইছে সিলেট বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনে।
এদিকে ‘তিন চাকার’ মাফিয়া জাকারিয়ার অনুষ্ঠানে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাদের উপস্থিতির প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির একাধিক নেতাকর্মী জানান- যারা আওয়ামী লীগের দালাল এই চাঁদাবাজ জাকারিয়াকে পুনর্বাসনের চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন মূলত তারা নিজেদের নিজ স্বার্থ হাসিল করতে এমনটা করছেন বলে দাবি তাদের।
এ বিষয়ে জানতে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরীর ব্যবহৃত সেলফোনে যোগাযোগ করলে তিনি উক্ত বিষয়টি শুনে কোন বক্তব্য না দিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন এমনকি পরবর্তীতে পূনরায় যোগাযোগের চেষ্টা করলে মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে জানতে সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমরান আহমদ চৌধুরীর ব্যবহৃত সেলফোনে যোগাযোগ করলে তিনি ফোনকল রিসিভ না করায় বক্তব্য সংগ্রহ করা যায়নি।
এ বিষয়ে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ সিদ্দিকী’র সেলফোনে যোগাযোগ করলে তিনি জানান- বিষয়টি আমার জানা নেই তবে আপনার মারফতে এখন অবগত হলাম। কোনভাবেই ‘বিএনপিতে চাঁদাবাজ-অনুপ্রবেশকারীদের ঠাঁই নেই’। এসমস্ত কর্মকান্ডে বিএনপির কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd