সিলেট ৫ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২১শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ৪ঠা রজব, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ১১:৫৩ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২, ২০২৫
নিজস্ব প্রতিবেদক :: সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলা দেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি বৈচিত্রের কাল্পনিক দৃশ্য ভ্রমণপিপাসুদের অভয়রণ্য জাফলং। মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশ ঘেরা এ জনপদ ও প্রকৃতি কন্যা জাফলং এর প্রাকৃতিক দৃশ্যপট দেখতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিনিয়ত ছুটে আসে ভ্রমন পিপাসু হাজারও মানুষ। কিন্তু ওইসব পাথর ব্যবসায়ীদের কারণে জাফলং হারাচ্ছে অপরূপ সুন্দর্য। পরিবেশ ও পর্যটনকেন্দ্র রক্ষায় দীর্ঘদিন থেকে বন্ধ থাকা কোয়ারীতে জমে আছে সাদা সোনা। আর এই বন্ধের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল অবৈধ ভাবে পাথর উত্তোলন করছে। এই উত্তোলিত পাথর বহনকারী গাড়ি থেকে দৈনিক লাখ লাখ টাকা আদায় করছে বিএনপি নামধারী একটি চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট। রহস্যজনক কারণে চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে উপজেলা প্রশাসন ও থানা পুলিশ কোন আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। ফলে এরা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এই চাঁদাবাজির একটি অংশ স্থানীয় সাংবাদিকদের বিকাশে যাচ্ছে ফয়ে তারা নিরব ভূমিকা পালন করছে। এছাড়া থানা পুলিশ ও আনসার সদস্যরা নিয়মিত ডিউটি পালন করছে। কিন্তু তারা কোন বাধা প্রধান করেনি। সিলেটের একটি দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর প্রায় মাস খানেক আগে একটি দায়সাড়া অভিযান পরিচালনা করছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। এরপর থেকে তিনিও নিরবে গোয়াইনঘাট ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এসিল্যান্ড দেখেও না দেখার ভান করে বসে আছেন। এই লুটপাট চাঁদাবাজি নিয়ে দৈনিক আলোকিত সিলেটে ধারাবাহিক সংবাদ প্রকাশের পরও টনক নড়েনি প্রশাসনের। কারণ এই সিন্ডিকেটের প্রধান হলেন বহিস্কৃত বিএনপি নেতা শাহ আলম স্বপন। তিনি গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরই জাফলং কোয়ারী এলাকায় একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। তার বলয়ে ছিলেন জেলা বিএনপির সহ-সম্পাদক রফিকুল ইসলাম শাহপরান। পরে এই পাথর লুটপাটের অভিযোগে শাহপরানের দলীয় পদ স্থগীত করা হয়। এরপর থেকে তিনি এই সিন্ডিকেট থেকে সরেদাঁড়ান। বর্তমানে জাফলং এলাকায় স্বপনের একক রাজত্ব তৈরি হয়েছে। তার রয়েছে বিশাল লাটিয়াল বাহিনী। এই বাহিনীর সদস্যরা সর্বদা এলাকায় প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিয়ে থাকেন।
সবশেষ জাফলংয়ের নয়াবস্তি এলাকার গ্রাম পুলিশ ও শারীরিক প্রতিবন্ধি মোঃ ইউসুফ আলীর জমি দখল নিয়ে ঘটেছে লঙ্কা কাণ্ড। রাতভর অস্ত্রের মহড়া দেখেছে জাফলংবাসী। এঘটনায় জাফলংয়ে পাথর খেকো লুটপাটকারী শাহ আলম স্বপন ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের মৃত ইব্রাহিম আলীর ছেলে মোঃ ইউসুফ আলী। অভিযোগ দায়েরের ১২ দিন বেশী সময় অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত অভিযোগটি এফআইআর হিসেবে রেকর্ড করেনি গোয়াইনঘাট থানা পুলিশ।
মামলার এজহার সূত্রে জানা যায়- মামলার আসামীগণ ইউসুফ আলীর মালিকানাধীন বালুরচর দখল করতে যান। বাদী এতে বাঁধা দিলে আসামীরা বাদী সহ তার আত্মীয় স্বজনের উপর হামলা করেন। এঘটরার পর দিন মঙ্গলবার দিবাগত গভীর রাত ২টার দিকে স্বপন বাহিনী পুনরায় অস্ত্রের মহড়া দিয়ে বাদি পক্ষের উপর সশস্ত্র হামলা করে। এতে পুরো জাফলংজুড়ে নগদ ৩ লক্ষ ৭২ হাজার টাকা ও ৪ ভরি স্বর্নালঙ্কার লুটপাট করে নিয়ে যায়।
শুধু এই একটি ঘটনাই নয়, স্বপন বাহিনী প্রতিদিনই জাফলং এলাকায় এই নৈরাজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। আর কেউ মুখ খুলেই তার উপর চলে অমানষিক নির্যতন। এই ভয়ে কেউ মুখ খুলে প্রতিবাদ করেনি।
ইউসুফ আলীর মামলা রেকর্ড না হওয়া নেপথ্যের কারণ হচ্ছে। এই মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে লুটপাটের মূলহোতা শাহ আলম স্বপনকে। তিনি ছিলেন গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। সেই সুবাদে পুলিশ ভয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা রেকর্ড করছে না বলে দাবি করেছেন মামলার বাদি। এই মামলায় অন্যান্য আসামি হলেন উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহবায়ক মিজানুর রহমান হেলয়ার, যুবদলের যুগ্ম আহবায়ক ইউসুফ আহমদ, পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন ছাত্রদলের বহিস্কৃত সভাপতি আজির উদ্দিন সহ একদল সন্ত্রাসী।
জাফলংয়ের এক পাথর ব্যবসায়ী নাম নাপ্রকাশ না করার শর্তে প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন,‘বর্তমান সময়ের বিএনপির এই চাদাঁবাজ সিন্ডিকেটের চেয়ে ভালো ছিলো আওয়ামী লীগের চাঁদাবাজরা। আগে আওয়ামী লীগের চাঁদাবাজদের ১৩শ টাকা করে দিয়ে গাড়ি পাস করছি। এখন বিএনপির স্বপন সিন্ডিকেটকে ২৫শ টাকা করে দিতে হয়। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভাবছিলাম পাথর কোয়ারীতে চাঁদাবাজি বন্ধ হবে। কিন্ত না এখন চাঁদাবাজির মাত্রা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
জাফলং বল্লাঘাট বল্লাপুঞ্জি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উত্তর সীমানার পাশের্^ পরিবেশ অধিদপ্তরের আশ্বাসে ফেলুডার দিয়ে গর্ত করে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় প্রভাবশালী বহিস্কৃত বিএনপি নেতা শাহ আলম স্বপন চক্রের বিরুদ্ধে। এতে জাফলং হারাচ্ছে অপরূপ সুন্দর্য। হাতিয়ে নিচ্ছেন দৈনিক লাখ লাখ টাকা। এই চক্রের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করা সাহস পায়নি। জোর পূর্বক মানুষের জমি থেকে যন্ত্রদানব ব্যবহার করে উত্তোলন করছেন পাথর। পরিবেশের শাপাপাশি হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের ঘর-বাড়ি ও সরকারি স্থাপনা।
এই চক্রটি জোর পূর্বক পাথর উত্তোলনের পাশাপাশি নিরীহ মানুষের জায়গা দখলে নিচ্ছেন। সেই জায়গা থেকে পাথর উত্তোলন করে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছেন এবং পাথর বোঝাই গাড়ি থেকে ২৫শ-৩ হাজার টাকা করে আদায় করছেন এমনই অভিযোগ স্থানীয়দের।
সরেজমিনে জানা গেছে, বল্লাপুঞ্জি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর ঘেষা মরিয়ম রেস্টোরেন্টের পূর্ব পাশে স্বপনের নেতৃত্বে ফেলুডার দিয়ে মাটি কেটে বড় বড় গর্ত করে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করছে স্থানীয় এলাকার আব্দুর রহিম মাস্টারের দুই ছেলে মানিক মিয়া এবং ইসরাত মিয়া। পাথর উত্তোলনের ফলে ঝুঁকিতে রয়েছে বল্লাঘাট পর্যটনকেন্দ্রের দোকানপাট, বল্লাপুঞ্জি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকা।
এদিকে অবৈধ পাথর উত্তোলনের বিষয়ে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে মানিক মিয়া বলেন, ‘আমাদের রেকডীয় জমি থেকে পাথর উত্তোলন করছি। পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালকের সঙ্গে আমাদের সমবোঝতা হয়েছে। ওনি আশ্বাস দিয়েছেন তাই পাথর উত্তোলন করছি।’
এ ব্যপারে পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের সহকারী পরিচালক বদরুল হুদা জানান, তিনি অবৈধ পাথর উত্তোলনের জন্য কাউকে আশ্বাস দেননি এবং এ বিষয়ে কারও সঙ্গে সমবোঝতাও হয়নি। অবৈধ পাথর উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে পরিবেশ ধ্বংশের অভিযোগে মামলা প্রস্তুতি চলমান রয়েছে।
গোয়াইনঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সরকার তোফায়েল আহমদ জানান, অবৈধ পাথর উত্তোলন বন্ধে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক শের মোহাম্মদ মাহবুব মুরাদ জানান, গত ৫ আগষ্টের পর প্রকৃতি কন্যা জাফলংয়ের পাথর কোয়ারীতে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে শোনেছেন। ইতোমধ্যে পাথর লুটপাটে জড়িতদের বিরুদ্ধে স্ব স্ব থানায় মামলা হয়েছে। দ্রুত তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। জাফলংয়ে অবৈধ ভাবে পাথর উত্তোলনের ফলে ধ্বংস হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ, মানুষ হারাচ্ছে ফসলী জমিও আবাসস্থল।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd