সিলেট ২৩শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৯ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২২শে রজব, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ১২:২০ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ২৩, ২০২৫
নিজস্ব প্রতিবেদক :: ওরা ৪ জন ছিলেন স্থানীয় এমপি, সেই সাথে মন্ত্রী ইমরান আহমদের খলিফা। ছিলেন বেপরোয়া। স্থানীয় বিএনপি-জামায়াত কিংবা সাধারণ মানুষ কাউকেই মানুষ বলে মনে করতেন না। এমনকি পাত্তা দিতে না আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাকর্মীদের। গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব লুটেরা সিন্ডিকেট। জিম্মি করে রাখতো সাধারণ ব্যবসায়ীদের। গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুরের পাথরের রাজ্য ভোগ করেছিলেন তারা। সহযোগী ছিল স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ। দেশের অত্যন্ত সম্ভাবনাময়ী তামাবিল স্থল বন্দর সংশ্লিষ্টরা তোয়াজ করে চলতে হতো তাদের। নচেৎ লজ্জাজনক বদলি।
এরমধ্যে পার হয়ে যায় দীর্ঘ ১৭ বছর। এই সময়ে কত সম্পদ তারা গড়েছে, নিজেরাও জানে না। কিন্তু স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনে হতভম্ব তারা। এরমধ্যে খবর আসে তাদের আশ্রয়দাতা সিলেট-৪ আসনের সাবেক এমপি ও প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক।
সাবেক এমপি ও মন্ত্রী কারাগারে গেলেও তার এই চার খলিফা এখনো রাজার বেসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এই চার খলিফার মধ্যে অন্যতম জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি ও তামাবিল স্থলবন্দর চুনাপাথর ও কয়লা আমদানিকারক গ্রুপের সভাপতি লিয়াকত আলী। তিনি ছিলেন এমপি ইমরানের স্বঘোষিত এপিএস। তিনি ছিলে তামাবিল স্থল বন্দরের ‘ডন’। তামাবিল স্থলবন্দরকে নিজের ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন তিনি। কামিয়েছেন শত শত কোটি টাকার চেয়েও বেশি। দেশে ও ভারতে রয়েছেন পৃথক পৃথক স্ত্রী ও সম্পদ। সম্পদের বিস্তৃতি রয়েছে ইউরোপ-আমেরিকায়ও। লিয়াকত আলীর ক্ষমতার কাছে গোয়াইনঘাট জৈন্তাপুর থানা পুলিশ ছিল নির্দেশের গোলাম। নতুবা বদলি। থানার ওসি, এসিল্যান্ড ও ইউএনও পছন্দ করে আনতেন তারা। কারণ মন্ত্রী ইমরান আহমদের এক ফোনেই সমাধাণ হয়ে যেত পোষ্টিং। পোষ্টিং পর কর্মকর্তারা কৃতজ্ঞতা দেখাতে কখনো কার্পণ্য করেনি।
তার বিরুদ্ধে দুদকে মামলা থাকলেও কে নাড়াবে সেই মামলা, তিনি মন্ত্রীর লোক। তার অন্যান্য সহযোগীদের একজন জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের অর্থবিষয়ক সম্পাদক জালাল উদ্দিন। কথিত এই ব্যবসায়ীরও সম্পদ বেহিসাব। দেশে ও ভারতে পৃথক স্ত্রী ও সম্পদের পাহাড়। তামাবিল স্থলবন্দরে যেভাবে খুশি সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনিও। কারণ মন্ত্রীর খাস খলিফাদের একজন তিনি। মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে ভারত থেকে কত পণ্য নিয়ে এসেছেন তার কোন হিসেব নেই। কারণ স্থানীয়ভাবে তাকে আটকাতে পারবে এমন কেউ থাকলেও অসহায়। একবার শুল্ক গোয়েন্দার হাতে ধরা খেয়ে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা গুনেছিলেন। তারপর গড়ে তুলেন শুল্ক গোয়েন্দাদের সাথে খাতির। পরবর্তীতে বেপরোয়া হয়ে উঠেন তিনিও।
একইভাবে ইমরান আহমদের খলিফাদের তালিকায় ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা স্থলবন্দরের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সরোয়ার হোসেন (ছেদু)। সরকার দলীয় প্রভাবে তারা ছিলেন দেশের প্রচলিত নিয়ম কানুনের ঊর্ধ্বে। সাধারণ ব্যবসায়ীরা ছিলেন তাদের কাছে জিম্মি। তাদের মর্জি রক্ষা করতে না পারলে ব্যবসা বন্ধ। তাই ম্যানেজ করেই তামাবিল স্থলবন্দরে ব্যবসায়িক কাজ করতে হতো তাদের। এভাবে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন এই চার খলিফা। গত ৫ বছর থেকে তামাবিল স্থলবন্দর কেন্দ্রিক ব্যবসা বাণিজ্য হয়ে উঠে তাদের মূল আখড়া। তারা সেখানে একক আধিপত্ব বজায় রাখেন। স্থল বন্দরে প্রতিদিন কাস্টমস এলাকায় লেবার হোল্ডিংয়ে নামে ১১০০ টাকা সার্ভিস চার্জ। প্রতি গাড়ি থেকে আরো ৫০০ টাকা নিতেন দলীয় চাঁদা। ট্রাকের মাল প্রতি টন ৪৭০ টাকা করে নিতেন বখরা। সরকার পতনের পর সিলেটের তামাবিল স্থলবন্দর, জাফলং, ভোলাগঞ্জসহ বিভিন্ন পাথর কোয়ারি ও বালুমহালে দখলবাজ ও চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের পরিবর্তন হচ্ছে। বন্দর ও পাথর কোয়ারিগুলো অবৈধভাবে আয়-রোজগারের ক্ষেত্র বানিয়েছিল আওয়ামী লীগ সমর্থিত লোকজন। এসব জায়গায় একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধিদের। এখন সেই নিয়ন্ত্রণ অন্যরা দখলে নিচ্ছে।
সিলেটের গোয়াইনঘাট সীমান্তের তামাবিল স্থলবন্দরটি এক দশক ধরে নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল তামাবিল চুনাপাথর, পাথর ও কয়লা আমদানিকারক গ্রুপ। এ গ্রুপের সভাপতি জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলী ও আওয়ামী লীগ নতা সরোয়ার হোসেন ছেদু, অর্থ সম্পাদক জালাল উদ্দিন। বন্দরের নিয়ন্ত্রণ ছিল লিয়াকত আলী ও জালালের হাতে। পণ্য তোলা-খালাস থেকে শ্রমিকদের খরচ বাবদ প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা আদায় করতেন তারা। সরকার পতনের কয়েকদিনের মধ্যেই বিএনপি-জামায়াত সমর্থিতরা অফিস দখল করে নেন। এরপর থেকেই শুরু হয় চাঁদাবাজি ও লুটপাট। কিন্তু এই লুটপাটকে কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছেন না বন্দরের নিয়ন্ত্রক লিয়াকত আলী ও জালাল উদ্দিন। ফলে বার বার কমিটি গঠন করেও সফল হচ্ছেন না লুটপাটকারীরা। একদিনের ব্যবধানে তামাবিল স্থলবন্দরে তিনটি কমিটি করা হয়েছে। এরই নেপথ্যে রয়েছেন সভাপতি জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলী ও আওয়ামী লীগ নতা সরোয়ার হোসেন ছেদু, অর্থ সম্পাদক জালাল উদ্দিন। অন্যদিকে রয়েছেন জেলা বিএনপির বহিস্কৃত নেতা শাহ আলম স্বপন। তারা কোন ভাবেই সিলেট জেলা বিএনপির পদবঞ্চিত নেতা রফিকুল ইসলাম শাহ পরানকে তামাবিল চুনাপাথর, পাথর ও কয়লা আমদানিকারক গ্রুপের সভাপতি হিসাবে মানতে নারাজ। প্রথমইে জেলা বিএনপির পদবঞ্চিত নেতা রফিকুল ইসলাম শাহ পরানকে সভাপতি ও ওমর ফারুককে সাধারণ সম্পাদক করে ১৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। সাথে সাথে পরদিন লেবাসধারী বিএনপি মি. হেনরি লামিনকে সভাপতি ও ইলিয়াস উদ্দিনকে সাধারণ সম্পাদক করে জেলা বিএনপির বহিস্কৃত নেতা শাহ আলম স্বপন ২১ সদস্য বিশিষ্ট আরেকটি কমিটি প্রকাশ করান। কিন্তু বসে থাকেননি জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলী ও আওয়ামী লীগ নতা সরোয়ার হোসেন ছেদু, অর্থ সম্পাদক জালাল উদ্দিনও তাদের বলয়ের সাইদুল ইসলাম জয়কে সভাপতি ও রুবেল আহমদ রাহীকে সাধারণ সম্পাদক করে ২০ সদস্য বিশিষ্ট আরেকটি কমিটির জন্ম দিয়েছেন। তাদের এমন কান্ড দেখে অবাক সাধারণ ব্যবসায়ীরা। কোন ভাবেই কেউই চাইছেন না তামাবিল স্থলবন্দর নিয়ন্ত্রণ হাত ছাড়া করতে। তামাবিল স্থলবন্দর নিয়ন্ত্রণ হাতে নিলে গড়ে তোলবেন সম্পদের পাহাড়। এমনই আশা-ভরসা নিয়ে সবাই নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। সূত্রমতে, গত ১৭ আগস্ট তামাবিল আমদানিকারক গ্রুপের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম শাহপরানকে সভাপতি ও ওমর ফারুককে সাধারণ সম্পাদক করে ২৯ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করলে তা অস্বীকার করেন আরেক গ্রুপের ব্যবসায়ীরা। সাবেক ছাত্রদল নেতা আবুল হাসিমকে সভাপতি ও যুবদল নেতা জাহিদ খানকে সাধারণ সম্পাদক করে ৩১ সদস্যের পাল্টা কমিটি ঘোষণা করেন তারা। এমনকি ওই দিন কানাডা থেকে লুৎফুর রহমানকে সভাপতি ও হেলুয়ার আহমদকে সাধারণ সম্পাদক করে আরেকটি কমিটি ঘোষণা হয়। এ নিয়ে আগস্ট থেকে শুরু হয় উত্তেজনা।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd