সিলেট ৩১শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৭ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ৩০শে রজব, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ১:৩২ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ৩০, ২০২৫
নিজস্ব প্রতিবেদক :: সিলেটের তামাবিল স্থলবন্দরে চলছে তুঘলকি কাণ্ড। গত ৮ বছরে আওয়ামী লীগ নেতা নেতৃত্বে তার ঘনিষ্টজনদের নিয়েই কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ১ শত ৭৬ কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষ আইনের দোহাই দিয়ে পণ্য লোড-আনলোডের সেবা না দিয়েই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অঙ্কের টাকা। এই টাকার প্রায় অর্ধেক পান লোড-আনলোডের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ঠিকাদার। যদিও ঠিকাদারের কোনো প্রতিনিধি বা শ্রমিক কখনো ছিল না বন্দরে। ব্যবসায়ীরা নিজেদের শ্রমিক দিয়েই পণ্য লোড-আনলোড করে আসছে। আবার এর জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষকে প্রতি টনে তাদের প্রায় ১৪৬ টাকা ফি দিতে হচ্ছে। স্থল বন্দরের হিসাব অনুযায়ী শুধুমাত্র ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় ১৫ লাখ টন পাথর আমদানি থেকেই লেবার হ্যান্ডলিং ফি বাবদই ২২ কোটি টাকা স্থলবন্দরকে পরিশোধ করেছে ব্যবসায়ীরা। কোনো সেবা না দিয়েই কেবল বন্দরের সঙ্গে চুক্তি থাকায় ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ঠিকাদার খুলনার হোসনেয়ারা এন্টারপ্রাইজ।
২০১৭ সালে স্থল বন্দর কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই এমন কাণ্ড চলমান থাকলেও এতদিন কেউ মুখ খোলেনি। কারণ হিসাবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, তামাবিল পাথর আমদানি গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন বিতর্কিত আওয়ামী লীগ নেতা লিয়াকত আলী। তার সঙ্গে ঠিকাদারের আঁতাত থাকায় কেউ কথা বললেই নানাভাবে নাজেহাল করা হতো। কারণ স্থলবন্দর ছিলো পলাতক আসামি লিয়াকত আলীর ঘনিষ্ঠজনদের দখলে। স্থালবন্দরের কর্তা সারোয়ার হোসেন ছেদু ও আওয়ামী লীগ নেতা জালাল উদ্দিনই বন্দরের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করতেন। তাদের সাথে ছিলেন ছিলেন তৎকালীন গোয়াইনঘাট উপজেলার পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান শাহ আলম স্বপন। যিদি গত ৫ আগস্টের পর থেকে লুটপাটের আলোচনায়। এছাড়া বাহির থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন উপজাতি নেতা মি. হেনরি লামিন। যা জালাল উদ্দিনের একটি অডিও বার্তায় প্রমানিত।
জানা যায়, সিলেট বিভাগের প্রথম এবং দেশের ১১তম স্থলবন্দর তামাবিল দিয়ে ভারত থেকে কয়লা, পাথর, চুনাপাথর, ফল ইত্যাদি আমদানি করা হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে ইট, প্রক্রিয়াজাত খাবার, প্রসাধনী পণ্য ইত্যাদি রপ্তানি করা হয়। বর্তমানে এই বন্দর দিয়ে আমদানি হওয়া পণ্যের মধ্যে ৯৮ শতাংশই পাথর। বৃহস্পতিবার সরেজমিন দেখা যায়, বন্দরে প্রবেশের জন্য আমদানিকৃত পাথরবোঝাই ট্রাক অপেক্ষমাণ। পাথরবোঝাই ট্রাক বন্ধরের স্কেলে ওজন দিচ্ছে, তারপর বন্দরের ভেতরে নিজেদের শ্রমিক দিয়ে তা ভারতীয় ট্রাক থেকে আনলোড করা হচ্ছে। সকালে যাদের ট্রাক বন্দরে ঢুকেছে তারা বিকালে টাকার বিনিময়ে পে-লোডার দিয়ে বাংলাদেশি ট্রাকে পণ্য লোড করে নিয়ে যাচ্ছেন। আবার যাদের নিজস্ব ইয়ার্ড আছে তারা সরাসরি ট্রাক নিয়ে চলে যাচ্ছেন ব্যক্তিগত ইয়ার্ডে। সেখানেও নিজস্ব শ্রমিক দিয়েই আনলোড করছেন। অথচ এই দুই ধরনের ব্যবসায়ীই বন্দরে ট্রাক প্রবেশের আগেই লেবার হ্যান্ডলিং ফি বাবদ প্রতি টনে ১৪৬.৩৪ টাকা ফি পরিশোধ করেছেন।
ব্যবসায়ী নাসির আহমদ জানান, দীর্ঘদিন ধরে এই স্থলবন্দরে ব্যবসা করছেন কিন্তু কোনোদিনই ঠিকাদার বা স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের কোনো লোড-আনলোড সেবা পাননি। অথচ বন্দরে ট্রাক ঢুকলেই টনপ্রতি ১৪৬.৩৪ টাকা আগে জমা দিতে হয় ব্যাংকে। যে সেবার জন্য টাকা জমা দেন সেই সেবা নিতে পুনরায় নিজস্ব শ্রমিক নিয়োগ করে নগদ অর্থ দিতে হয়। সেক্ষেত্রে লোড-আনলোডে দিগুণ খরচ বহন করতে হচ্ছে তাদের। একই কথা বলেন পাথর আমদানিকারক আব্দুল আলীম। তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু শুনি বন্দরে ঠিকাদার নিয়োগ করা আছে। কিন্তু কখনো ঠিকাদার বা তার প্রতিনিধি বা কোনো শ্রমিক গত ৭ বছরে দেখা মেলেনি।’
স্থলবন্দরের আইন অনুযায়ী, আমদানিকৃত পণ্যের লোড-আনলোডের (লেবার হ্যান্ডলিং) এর জন্য একজন ঠিকাদার নিযুক্ত করা হয়। ঠিকাদার তার নিজস্ব শ্রমিক অথবা যন্ত্র দিয়ে আমদানিকারকদের পণ্য লোড-আনলোড করবেন। আমদানিকারকরা স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষকে নির্ধারিত ফি পরিশোধ করবেন।
আইন অনুযায়ী ২০১৭ সাল থেকেই খুলনার দৌলতপুরের এসএম মনিরুজ্জামান শাহীনের মেসার্স হোসনেয়ারা এন্টারপ্রাইজ সর্বনিম্ন দরদাতা হিসাবে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। সবশেষ ২০২২ সালের ২৭ এপ্রিল চুক্তি হয় এই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। ব্যবসায়ীরা স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষকে প্রতি টনে ১৪৬.৩৪ টাকা দিলেও ঠিকাদার চুক্তিবদ্ধ হন ৭০.৫৪ টাকায়। টনপ্রতি বাকি ৭৫.৮০ টাকা স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের তহবিলেই জমা থাকে। সেই হিসাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তামাবিল স্থল বন্দর দিয়ে পাথর আমদানি হয়েছে ১৫০৯৯৫২ টন। প্রতি টনে ১৪৬.৩৪ টাকা হারে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ফি নেওয়া হয়েছে ২২ কোটি ৯ লাখ ৬৬ হাজার ৮৩ টাকা। যার মধ্যে ঠিকাদার কোনো সেবা না দিয়েই হাতিয়ে নিয়েছে ১০ কোটি ৬৫ লাখ ১২ হাজার ১৪ টাকা। এই টাকা হাতিয়ে নিতে ঠিকাদারকে শুধুমাত্র বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটি চুক্তি আর জামানত হিসাবে প্রায় ২ কোটি টাকা জমা দিতে হয়েছে।
এ বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক এসএম মনিরুজ্জামান শাহীনের ফোনে একাধিকবার ফোন করেও সাড়া মিলেনি। খুদেবার্তা পাঠালেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
তবে তামাবিল স্থলবন্দরের সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অনেক স্থলবন্দরেই ঠিকাদার সেবা দিচ্ছে। সরেজমিন ব্যবসায়ী শ্রমিকদের দেওয়া তথ্যমতে সেবা বা কোনো শ্রমিকের দেখা না মিললেও তিনি ঠিকাদারের পক্ষে কথা বলেন। তবে তিনি বলেন, পাথরের ক্ষেত্রে লেবার হ্যান্ডলিং চার্জ থাকবে কিনা তা ইতোমধ্যেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান জানান, তিনিও বিষয়টি জানেন। ঠিকাদার ইস্যুতে শ্রম আইন ও স্থলবন্দর আইনের বাধ্যবাদকতায় কিছু করা যাচ্ছে না। তবে তিনি বলেন, এসব ফি স্থলবন্দরের আয়ের উৎস।
আ.লীগের ছায়াতলে ছিলেন ঠিকাদার, ছায়া দিতে দৌড়ঝাঁপ বিএনপি নেতার : তামাবিল স্থল বন্দরের ব্যবসায়ীদের মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যবসায়ীরা লেবার হ্যান্ডলিং সেবা না পেয়ে বিক্ষুব্ধ হলে ঠিকাদারের সঙ্গে আলোচনায় বসেন তামাবিল পাথর আমদানি গ্রুপের সভাপতি জৈন্তাপুর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলী। সেই আলোচনায় ঠিকাদারের সঙ্গে তার আঁতাত হয়। ব্যবসায়ীদের জানানো হয়, লেবার হ্যান্ডলিং ফি বাবদ ঠিকাদার যে অংশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে পায়, সেই অংশ থেকে প্রতি টনে ১৩ টাকা করে ব্যবসায়ীদের ফেরত দেবেন। অর্থাৎ কোনো সেবা না দিয়ে প্রতি টনে ৭০.৫৪ টাকা নিয়ে যাবে ঠিকাদার। এর মধ্যে মাত্র ১৩ টাকা পাবেন ব্যবসায়ীরা। ২০২৩ সাল পর্যন্ত নাকি অনেক ব্যবসায়ী সংগঠনের মাধ্যমে এই টাকা পেয়েছেন। তবে ঠিকাদারের কাছে ঠিক কত টাকার চুক্তি হয়েছিল তা জানেন না ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের মতে ঠিকাদারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে মাত্র ১৩ টাকা ফেরত দিয়ে ঠিকাদারকে সুবিধা দিয়ে গেছেন আওয়ামী লীগ নেতা লিয়াকত আলী।
গত আগস্টে পটপরিবর্তনের পর থেকে পলাতক রয়েছেন তিনি। এবার ঠিকাদারের কাছ থেকে সেই সুবিধা আদায়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন ৫ আগস্টের পর শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে পদ স্থগিত জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম শাহপরান। ১৪ জানুয়ারি তড়িঘড়ি করে তিনি কয়েকজন ব্যবসায়ী নিয়ে তামাবিল পাথর আমদানি গ্রুপের নতুন কমিটি ঘোষণা করেন। যার সভাপতি তিনি নিজেই। পলাতক লিয়াকত আলীর ঘনিষ্ঠ সহচর ফখরুল ইসলামকে সিনিয়র সহ-সভাপতি, ওমর ফারুককে সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব দেন কমিটিতে। কমিটি গঠনের আগেই ৯ জানুয়ারি স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি দেন পদস্থগিত বিএনপি নেতা শাহপরান। ঠিকাদার সেবা না দিয়ে ব্যবসায়ীদের প্রতি টনে ১৩ টাকার যে অর্থ উপঢৌকন হিসাবে গোপন চুক্তিতে দেওয়ার কথা তার হিসাব করে ২০১৭ সালের নভেম্বর থেকে ২০২২ পর্যন্ত ৪ কোটি ৩৫ লাখ এবং ২০২২ থেকে অদ্যাবধি যে অর্থ প্রাপ্য রয়েছে তা পরিশোধের পূর্বে ঠিকাদারের বিল না দেওয়ার অনুরোধ করেন তিনি।
এই চিঠি দেওয়ার পরই কমিটি গঠন নিয়ে খোদ কমিটির সদস্য বিএনপি নেতা ইলিয়াস উদ্দিন লিপু জানান, কমিটি হয়েছে ঠিকাদারের সঙ্গে গোপন চুক্তি করা পলাতক আওয়ামী লীগ নেতা লিয়াকত আলীর পরামর্শে এবং তার ঘনিষ্ঠজনদের দায়িত্ব দিয়ে, মূলত ঠিকাদারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা।
চিঠির বিষয়টি স্বীকার করেন স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান। তিনি বলেন, আগে কি চুক্তি হয়েছে তা আমার জানা নেই, তাই এই বিষয়ে আমি ঢুকছি না।
রফিকুল ইসলাম শাহপরান বলেন, আমার জানামতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঠিকাদারের একটি চুক্তি ছিল সেবা না দিয়ে কিছু অর্থ ফেরত দেওয়ার, কিন্তু তা দেয়নি। সেই টাকা আদায়েই চিঠি দিয়েছি।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd