সিলেট ৩১শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৭শে রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ৮:২৮ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৪
মিনহাজ উদ্দিন, গোয়াইনঘাট: দীর্ঘ ৭ বছর থেকে বন্ধ সিলেটের সবকটি পাথর কোয়ারী। ভোলাগঞ্জ, জাফলং, বিছনাকান্দি, শ্রীপুর, লোভাছড়াসহ সবকটি পাথর কোয়ারী বন্ধ থাকায় স্থানীয় অর্থনৈতিক অবস্থায় চরম সংকট দেখা দিয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে সনাতন পদ্ধতির পাথর উত্তোলন প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় জড়িত এ খাতে বিনিযোগকারী হাজার হাজার ব্যবসায়ী ও ৩ উপজেলার এসব কোয়ারীতে শ্রম বিলিয়ে দেয়া লাখো শ্রমিকরা কর্মহীন জীবন যাপন করে আসছে।
কোয়ারী সমুহের পাথরের উপর নির্ভর ভোলাগঞ্জ, জাফলং, বিছনাকান্দি, শ্রীপুর, লোভাছড়াতে পড়ে থাকা শত শত স্টোনক্রাশার সমুহে ঝং ধরেছে। কোথাও কোথাও আবার পানির দরে বিক্রি করতে হচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিয়োগকৃত এসব কলকারখানার যন্ত্রপাতি। পাথর কোয়ারী সমুহে পাথর উত্তোলন স্বাভাবিক না থাকাতে স্টোনক্রাশিং প্লান্ট সমুহের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়ায় এসব পাথর ভাঙ্গার কাজে ব্যবহৃত স্টোন ক্রাশারমিল সমুহের আসবাবপত্র,যন্ত্রপাতি,মালামাল বিনষ্ট হচ্ছে।
পাথর পরিবহণ বন্ধ থাকায় রাস্তার ধারে, কলখারখানা সমুহের সম্মুখে বছরের পর বছর থেকে পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে ব্যবসায়ীদের ঋণের টাকার বিপরীতে পাথর পরিবহণের জন্য কিনে আনা অগণিত ট্রাক, ট্রাক্টর। উচ্চ আদালতের নির্দেশে সিলেটের সবকটি পাথর কোয়ারী বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। ফলে সনাতন পদ্ধতিসহ সব ধরণের পাথর বালি উত্তোলন বন্ধে কঠোরভাবে মাঠে নামে প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ।
এদিকে পাথর কোয়ারী সমুহের উৎসমুখের পাথর অপসারণ না করাতে প্রতি বছর জমছে পাথরের বিশাল স্তুপ। দিন দিন বেড়ে চলেছে উজান থেকে নেমে আসা এসব পাথরের স্তুপ। এতে করে প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে নদ নদীর সাধারণ পানি প্রবাহে দেখা দিচ্ছে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা। জাফলং জিরো পয়েন্টে পিয়াইন নদীর উৎসমুখে বিগত প্রলয়ংকারী বন্যায় উজান থেকে নেমে আসা পাথরের স্তুপে ৩০ থেকে ৪০ ফুট উচ্চতায় ভরাট হয়েছে নদীর উৎসমুখ। এতে করে স্থানীয় এসব নদ-নদীর নাব্যতা (গভীরতা) হ্রাস পেয়েছে। নাব্যতা হারিয়ে যাওয়ার ফলে পিয়াইন অববাহিকার জাফলং, ভোলাগঞ্জসহ সবকটি নদীতেই নদী ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে মারাত্মকভাবে। নদী সমহের উৎসমুখে পাথরঝট তৈরী হওয়াতে বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যার পানিতে তীব্র স্রোত দেখা দেয় এবং পানির তোড়ে ব্যাপক ভাঙ্গন শুরু হয়। কয়েক বছর থেকে নদী ভাঙ্গনের ফলে কোয়ারীর উৎসমুখে বিলাল এলাকা জুড়ে ফসলি জমি,পান সুপারির বাগান(জুম),বাড়িঘর,স্কুল,মাদ্রাসাসহ নানা স্থাপনা নদী গর্ভে বিলীন হচ্ছে।
হুমকির মুখে রয়েছে আরও অগিণত মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, হাট বাজার, চা বাগানসহ বিস্তৃত বিশাল পতিত জমি। অপরাপর পাথর কোয়ারীর মতো সিলেটের গোয়াইনঘাটের পাথর কোয়ারীগুলোও একই সময় থেকে বন্ধ রয়েছে। এমতাবস্থায় মাঝে মধ্যে লুকিয়ে কিংবা প্রশাসন, পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে কোয়ারীতে সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনে গেলেও প্রশাসনের মোবাইলকোর্টের অভিযান আর পুলিশের ধর পাকড়ে শিকার হচ্ছে শ্রমিক ব্যবসায়ীরা।
এ বিষয়ে কথা হলে জাফলং বল্লাঘাট পাথর ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি আনোয়ার হোসেন খাঁন আনু বলেন,দীর্ঘ ৭ বছর থেকে জাফলংসহ সিলেটের সকল পাথর কোয়ারী থেকে সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। কোয়ারী সমুহ বন্ধ থাকার কারণে পাথর ব্যবসার সাথে জড়িত আমাদের ব্যবসায়ীরা মানবেতর জীবন যাপন করে আসছেন। তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কোয়ারীর পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকায় সবকটি কোয়ারীতে বহুগুণ বেড়েছে পাথরের পরিমাণ,তাছাড়া প্রতি বছর পাহাড়ি ঢলেও উজান থেকে নেমে আসে পাথর। ফলে উৎসমুখে পাথরের স্তুপে নেমে আসা পানি প্রবাহের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। এসব পাথর দ্রুত অপসারণ না করলে এলাকায় নদী ভাঙ্গন প্রকট আকার ধারণ করবে। কোয়ারী সমুহে কার্যক্রম বন্ধ থাকার কারণে এই খাতে আমাদের বিনিয়োগকারী ব্যবসায়ীদের অবস্থা খুবই নাজুক। পরিবার পরিজন নিয়ে অনেকে মানবেতর জীব যাপন করে আসছেন।
জাফলং স্টোনক্রাশারমিল মালিক সমিতির সভাপতি বাবলু বখত বলেন, পাথর কোয়ারী সমুহের কার্যক্রম বন্ধ থাকাতে স্টোন ক্রাশারমিল সমুহ দীর্ঘদিন থেকে বন্ধ রয়েছে। শত শত স্টোনক্রাশারমিল বন্ধ থাকায় এসব প্রতিষ্টানে ঝং ধরেছে। কোয়ারী বন্ধ জনিত কারনে স্টোন ক্রাশারমিল প্লান্ট বন্ধ। লক্ষ লক্ষ টাকা বিনিযোগ করে গড়ে তোলা একেকটি প্রতিষ্টান পানির দরে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। একদিকে পরিবার পরিজনের দৈনন্দিন খরচ অপরদিকে ব্যাংকের দেনা টাকার কিস্তি নিয়ে মারাত্মক কষ্টে দিন যাপন করছেন। যন্ত্রনা সইতে না পেরে অনেকের হার্টএটাকে মৃত্যু বরণের ঘটনাও ঘটছে। কোয়ারী বন্ধ থাকার কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটে ভোগা আমাদের এসব ব্যবসায়ীদের পাশে দাড়ানোর কেউ নেই।
জাফলং বল্লাঘাট পাথর উত্তোলন ও সরবরাহ শ্রমিক বহুমুখি সমবায় সমিতির সভাপতি সিরাজ উদ্দিন বলেন, দীর্ঘদিন থেকে পাথর কোয়ারী বন্ধ থাকায় আমাদের খেটে খাওয়া শ্রমিকদের কষ্ট যন্ত্রনা দেখার কেউ নেই। মানবেতর জীবন যাপন করছে সিলেটের সবকটি পাথর কোয়ারীর খেটে খাওয়া লক্ষ লক্ষ শ্রমিক।
কোম্পানিগঞ্জ প্রেসক্লাব সভাপতি ও বিশিষ্ট পাথর ব্যবসায়ী শাব্বির আহমদ বলেন,আমরা সরকারের কাছে বার বার সনাতন পদ্ধতিতে পাথর কোয়ারী খুলে দিতে দাবি জানিয়ে আসলেও সরকারের তরফে তার বাস্তবায়নে কোন উদ্যোগ নেই। এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে আমরা সর্বশেষ প্রেসকনফারেন্সের মাধ্যমেও আমাদের রুটিরুজির এককমাত্র পথ পাথর কোয়ারী খুলে দিতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি।
সিলেটের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সিলেট চেম্বার এন্ড কমার্স ইন্ড্রাস্টির সাবেক সভাপতি তাহমিন আহমদ বলেন, সিলেটের পাথর কোয়ারী সমুহ বন্ধ থাকার কারণে এখাতে বিনিয়োগকারী ব্যবসায়ীরা বছরের পর বছর থেকে কোটি কোটি টাকার ক্ষতির সম্মূখিন। কোয়ারীর বিষয়ে বলতে পারেন আমরা এক রকম ষড়যন্ত্রের শিকার। পাথর কোয়ারী সমুহে ইতিপূর্বের সরকারের আমলে নির্বিচারে বোমা মেশিনসহ যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের ফলে পরিবেশ বিপর্যয়েে শংকায় সরকারের নির্দেশনায় পরবর্তীতে সনাতনসহ সব ধরণের পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। ফলে সবকটি পাথর কোয়ারীর নিচ থেকে পাথর বড় হয়ে উপরে উঠার পাশাপাশি নদীর উৎসমুখে পাথর স্তুপ তৈরী হয়েছে। যে কারণে বন্যার পানির তোড়ে সবকটি নদীর উৎসমুখে নদী ভাঙ্গন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সনাতন পদ্ধতিতে সবকটি পাথর কোয়ারী খুলে দিতে ইতিপূর্বে আমরা বার বার সরকার, উচ্চ আদালত, প্রশাসনের নিকট জোর দাবি জানিয়ে আসছি। আশা করবো সরকার আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে সনাতন পদ্ধতিতে আবারও সবকটি পাথর কোয়ারী খুলে দিতে দ্রুত পদক্ষেপ নিবেন।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ তেীহিদুল ইসলাম বলেন, সরকারি সিদ্ধান্তে জাফলং বিছনাকান্দিসহ বিভিন্ন পাথর কোয়ারী সমুহ বন্ধ আছে। বর্তমানে কোয়ারী সমুহের পাথর,বালি উত্তোলন অবৈধ। তাই অবৈধভাবে উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। সূত্র সিলেট প্রতিদিন
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd