সিলেট ৩০শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৭শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ৯:২৩ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ৮, ২০২৪
কোম্পানীগঞ্জ সংবাদদাতা :: সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই সজিব দেব রায় এর মামলা বাণিজ্যে ৩ পুলিশ সদস্যকে ক্লোজড করা হয়েছে। মামলা বাণিজ্য ছাড়াও তার বিরুদ্ধে ভারতীয় কাপড়, চিনি, চকলেট-কসমেটিক্স ও সাদাপাথরের লাইনের সাথে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
এসআই সজিব রায় কুলাউড়া উপজেলার ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের মীর্জাপুর গ্রামের শ্রী শৈলেন্দ্র দেব রায়ের ছেলে। ২০১৯ সালে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানার উপ-পরিদর্শক থাকাকালীন সময়ে এসআই সজিবের বিরুদ্ধে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে এক তরুণীর শারিরীক সম্পর্কের অভিযোগ উঠে।
পরে ২০১৯ সালের ৬ মার্চ সিলেটের অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ওই ধর্ষিতা নিজে বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। কোতোয়ালী সিআর মামলা নং- ৩৭৭/২০১৯ইং। নির্যাতিতা নারী সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার বাসিন্দা। পরে ন্যায় বিচার পাওয়ার জন্য আদালত পাড়ায় দীর্ঘদিন দৌড়ঝাপ করেছেন ওই তরুণী। কিন্তু স্বৈরাচারী পুলিশ সজিব রায়ের পক্ষে রিপোর্ট দেওয়ায় মামলায় হেরে যান ওই তরুণী। সেই থেকে বিতর্কিত এসআই সজিব দেব রায়।
অভিযোগ রয়েছে ভারতীয় চোরাচালানীদের কাছ থেকে মাসোহারা ও চিনির বস্তা প্রতি টাকা নিতেন এসআই সজিব। কাঠালবাড়ী-লম্বাখান্দির পশ্চিম হাওরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলনকারীদের কাছ থেকেও থানার একজন এসআই এর মাধ্যমে প্রতিরাতে ৫০ হাজার টাকা আনতেন। অন্যদিকে আওয়ামীলীগ নেতাদের নামে দায়েরকৃত মামলার আসামিদের কাছ থেকেও টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আর তার এসবের হিসাব কষতে মাসিক বেতনে মান্না নামের একজন সহকারীও রয়েছে। সেকেন্ড অফিসারের এসব কর্মকান্ডের কারণে আরও ২ পুলিশ সদস্যকে ক্লোজড হতে হয়েছে।
গত ৫ নভেম্বর সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমানের স্বাক্ষরিত এক আদেশে প্রশাসনিক কারণ দেখিয়ে কোম্পানীগঞ্জ থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই সজিব দেব রায়, এএসআই মো. জাহিদুল ইসলাম ও ডিএসবি’র এসআই মো. দেলোয়ার হোসেনকে সিলেট পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করা হয়। এর আগে ভারতীয় চিনি আটকের বিষয়ে এসআই সজিব দেব রায় ৩৩ জনের নামে মামলার এজাহার তৈরি করেন। এই এজাহার থেকে নাম বাদ দেওয়ার জন্য টাকা দাবির অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়। পরদিন তাকেসহ আরো ২ পুলিশ সদস্যকে ক্লোজড করা হয়।
জানা যায়, ৩ নভেম্বর দিবাগত রাত ২টায় ডিএসবি’র এসআই মো. দেলোয়ার হোসেনের কাছে ফোন আসে তেলিখাল বাজারে ২টি ট্রাকে চিনি লোড হবে। এমন খবর পেয়ে ডিএসবি’র এসআই মো. দেলোয়ার হোসেন ও এএসআই জহিরুল ইসলাম সেখানে যান। গিয়ে দেখেন ২টি ট্রাকে চিনি বোঝাই করা হচ্ছে। তাদের দেখে চিনি চোরাকারবারিরা সেখান থেকে দ্রুত পালিয়ে যায়। এসময় রাত্রিকালীন জরুরি ডিউটিতে থাকা পুলিশের টিমকে কল করেন এসআই দেলোয়ার। তাদেরকে না পেয়ে সেকেন্ড অফিসার এসআই সজিব দেব রায়কে কল দেন তিনি। পরে সেকেন্ড অফিসার জরুরি ডিউটিতে থাকা এএসআই জালাল উদ্দিনকে সেখানে পাঠান। এর কিছুক্ষণ পর সেকেন্ড অফিসার নিজেও সেখানে চলে যান। এরপর সকাল ১০টায় গাড়ি ২টি থানায় নিয়ে আসেন তারা। এসময় গাড়ির একজন লেবারকে আটক করা হয়। এ ঘটনায় লেবারসহ ২জনের নাম উল্লেখ করে ৪ নভেম্বর বেলা ১.৩০ মিনিটে থানায় মামলা দায়ের করা হয়।
সুত্র আরও জানায়, এ ঘটনায় এসআই সজিব ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে একটি এজাহার তৈরি করেন। এই এজাহারের কপি তার এক বিশেষ সহকারীকে দিয়ে আসামিদের কাছে পাঠান। আসামিরা এজাহারে তাদের নাম দেখে হতভম্ব হয়ে পড়েন। তখন ঐ বিশেষ সহকারী তাদের অভয় দেন যে টাকা দিলে মামলা থেকে তাদের নাম বাদ দেওয়া যাবে। এদিকে মামলা দিনে ১.৩০ মিনিটে রেকর্ড হওয়ার খবর গোপন রেখে রাত ৯টায় ৩৩ জনের নামের তালিকা সেকেন্ড অফিসার বিশেষ সহকারীকে দিয়ে ঐ এলাকায় পাঠিয়ে ছিলেন। তখন তারা একটি বাড়িতে একত্রিত হয়ে সেকেন্ড অফিসারের সাথে ফোনে কথা বলেন। এসময় মামলা থেকে ১৯ জনের নাম বাদ দেওয়ার জন্য জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা দাবি করেন তিনি। লাউড স্পিকারে সকলের সামনে তার সাথে টাকার বিষয়ে কথা বলেন স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার দিলোয়ার মিয়া।
উত্তর রনিখাই ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের মেম্বার দিলোয়ার মিয়ার সাথে এসআই সজিব দেব রায় এর দরকষাকষির একটি অডিও রেকর্ড হাতে আসে এই প্রতিবেদকের। এতে এসআই সজিবকে বলতে শুনা যায় ‘দ্রুত যা করার করেন।’ তখন ফোনের ওপর প্রান্তে থাকা দিলোয়ার মেম্বার বলেন ‘আমরা এখানে ১৮-১৯ জন আছি, কত দেওয়া যায় একটু সীমিত করে যদি বলেন।’ সজিব বলেন ‘১৯ জনের কাছ থেকে ১০ হাজার করে নেন।’ তখন মেম্বার বলেন ‘ওরা মরে যাবে এত টাকা দিতে পারবে না।’ সজিব বলেন ‘তাহলে আপনে মুরব্বি মানুষ আপনিই বলেন।’ মেম্বার বলেন ‘তারা আমাকে ধরছে যে ২০ হাজার টাকা দিবে আর যাতে তাদেরকে হয়রানি করা না হয়।’ তখন এসআই সজিব ১৯ জনের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা করে নিতে বলেন মেম্বারকে।
এদিকে, একটি ভিডিওতে দেখা যায় ঐ এলাকার একজন লোক বলছেন ‘সেকেন্ড স্যার আমাকে বলছেন মামলায় ৩৩ জনের যে নাম দেওয়া হয়েছে তা থেকে বাদ দেওয়ার সুযোগ আছে। মামলা এফআইআর করার আগে যদি কথা মতো হয় আর বুঝে পড়ে তাহলে মামলা থেকে বাদ দেওয়া যাবে। আমরা কথা বলে এসেছি। আর উনাকে বলেছি আমাদের যে ভাই ভাতিজা আছে তাদের জন্য কোন সুযোগ সুবিধা আছে কি না। তখন তিনি (সেকেন্ড অফিসার) বলেন আলোচনার মাধ্যমে যদি বুজে পড়ে তাহলে বাদ দেওয়া যাবে।’ এসব অডিও বা ভিডিওতে এসআই দেলোয়ার বা এএসআই জাহিদুল ইসলামের বিষয়ে আলাপ করতে শুনা যায়নি।
এদিকে, সেকেন্ড অফিসার ভারতীয় চকলেট ও কসমেটিকসের লাইন থেকে জনপ্রতি ৩০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা মাসোহারা নিতেন। পূর্ব ও পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়নের প্রায় ৩০ জন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রতি মাসে এই টাকা নেন। তাছাড়া পশ্চিম ইসলামপুরের সীমান্ত দিয়ে যে ভারতীয় চিনি আসে সেই ব্যবসায়ীদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ ছিল তার। তারা বস্তাপ্রতি ১’শ টাকা দিত। যার জন্য কখনো এই লাইনের চিনি বা অন্যান্য ভারতীয় পণ্য আটক করেননি তিনি।
৪ নভেম্বর সকাল ৮টা থেকে থানার ডিউটি অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন এএসআই জাহিদুল ইসলাম। তিনি রাত ৮টা পর্যন্ত ডিউটি অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। চিনি আটক করতে রাতে তিনি তেলিখাল বাজারে যাননি। ৪ নভেম্বর বেলা ১.৩০ মিনিটে মামলা রেকর্ড হলেও তিনি ঐ মামলার এজাহার সম্পর্কে কিছুই জানেনি বলে জানান।
এএসআই জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমি সেদিন ডিউটি অফিসারের দায়িত্বে ছিলাম। চিনি ধরা কিংবা মামলার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। তাছাড়া এসংক্রান্ত বিষয়ে আমি করো সাথে কোন আলাপও করিনি।
এসআই দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমি বিভিন্ন সময় ভারতীয় পণ্য ও মাদক আটক করিয়েছি। যার কারণে মাদক ও চোরাকারবারিরা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। যখন আমি চিনির ট্রাক আটক করিয়েছিলাম তখন চিনি চোরাকারবারির গডফাদার আমাকে ফোন দিয়ে ট্রাক ছেড়ে দেওয়ার জন্য বলে। তাছাড়া সে আমাকে বিভিন্ন অফার দিয়েছিল কিন্তু আমি ট্রাক ছাড়িনি। যার জন্য সে আমাকে কোম্পানীগঞ্জ থানা থেকে সরানোর ব্যবস্থা করেছে।
এসআই সজিব দেব রায় বলেন, গোয়াইনঘাট থেকে আসা চিনি ধরার কারণে আমাদেরকে পুরষ্কারের পরিবর্তনে পানিশমেন্ট দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া এই চিনি ধরতে ডিএসবির এসআই দেলোয়ার সাহেব আমাকে ফোন করে নিয়ে আসেন এবং এএসআই জাহিদুল ইসলাম এসবের মধ্যে ছিল না। এসআই সজিববের বিরুদ্ধে অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে অস্বীকার করে বলেন, আমি কোন আওয়ামীলীগ নেতার কাছ থেকে টাকা নেইনি বা চিনির মামলা থেকে কাউকে বাদ দিব বলেও টাকা নেইনি। শত্রুতা করে ওরা আমার বিরুদ্ধে এসব বলছে।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার অফিসার ইনচার্জ উজায়ের আল মাহমুদ আদনান বলেন, পুলিশ সুপার ৩ পুলিশ সদস্যকে পুলিশ লাইন্সে সংযুক্তির আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু কি কারণে তা আমার জানা নাই। তারা ইতিমধ্যে সিলেট পুলিশ লাইন্সে চলে গেছেন।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd