গত ২রা মে বুধবার গণভবনে অনুষ্ঠিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিকবৃন্দরা নিঃসন্দেহে ছিলেন গুণী ব্যক্তিদের এক অনন্য উদাহরণ। তাদের জ্ঞানের ভান্ডার এতোই প্রসার তার কাছে নিজেকে তুচ্ছ পরিমাণ সমতুল্যও মনে করি না এবং এতে সন্দেহেরও কোনো অবকাশ নেই। তবে নিজের সত্য, ন্যায়, অধিকার, ঐক্য এই চারটি মূল ভিত্তির উপর বেঁচে থাকতে গিয়ে সাংবাদিকদের কিছু প্রশ্ন সেদিন অসম্পন্ন এবং কোণঠাসা মনে হচ্ছিল। সংবাদ সম্মেলন সরাসরি মিডিয়া চ্যানেলে না দেখতে পারলেও পরবর্তীতে সেটি ইউটিউবে দেখার এক তীব্র ইচ্ছা, উদ্দীপনা এবং কৌতুহুল সৃষ্টি হয়। কেননা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও সৌদি আরব সফরের সাফল্য তুলে ধরতে গত ২রা মে বুধবার বিকেল চারটায় গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলি তুলে ধরেন।
তিনি গত ১৫ থেকে ১৬ এপ্রিল সৌদি আরবে, ১৭ থেকে ২২শে এপ্রিল লন্ডনে, ২৬ থেকে ২৯ শে এপ্রিল অস্ট্রেলিয়া। ১৫ থেকে ১৬ এপ্রিল সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলীয় আল জুবাইল প্রদেশে অনুষ্ঠেয় ‘গালফ শিল্ড-১’ নামের একটি যৌথ সামরিক মহড়ার কুচকাওয়াজ ও সমাপনী অনুষ্ঠানে যোগদান, ১৭ থেকে ২২শে এপ্রিল কমনওয়েলথ সরকার প্রধানদের সাথে বৈঠকে (সিএইচওজিএম) এবং ২৬ থেকে ২৯শে এপ্রিল সিডনির আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে (আইসিসি) এক অনুষ্ঠানে গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড-২০১৮ গ্রহণ করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী-কে ধন্যবাদ জানাই এরকম একটি মূল্যবান পুরষ্কারে পুরস্কৃত হওয়ার জন্য।
সেদিন সংবাদ সম্মেলনে প্রথম সারিতে থাকা বেশিরভাগ সাংবাদিক ছিলেন জাতীয় পত্রিকার সম্পাদকবৃন্দ। বেশ ভালোই চলছিল সংবাদ সম্মেলন কিন্তু প্রশ্নের পালা বদল হতে হতে এক পর্যায়ে সিনিয়র সাংবাদিক ভাইদের কয়েকটি প্রশ্ন আমাকে হতভম্ব করে দেয়। একজন সাংবাদিক ভাই সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন করলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বললেন, আপনারা চালকের দোষ না দেখে পথচারীর দোষটাও খেয়াল করবেন এবং তিনি এও বললেন মিডিয়া সাংবাদিক ভাইদের, আপনারা তো পারেন দু-তিন মিনিট সময় ব্যয় করে টিভিতে রাস্তা পারাপারের সময় কি করণীয়, হাঁটাচলা করার সময় কি করণীয় তার উপর সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কিছু ভিডিও চিত্র বানিয়ে প্রত্যেকটি চ্যানেলে প্রচার করতে। বেসরকারি টিভি চ্যানেল আমি এনে দিয়েছি। সবগুলোই তো আমার দেয়া। সহমত জানাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলিকে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এক পর্যায়ে জবাব দিতে গিয়ে বললেন, দেশকে আর্থিক স্বচ্ছলতা এনে দিয়েছে আওয়ামীলীগ। জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়াও দেশ পরিচালনা করেছেন তাদের সময় কেন উন্নয়ণ হয়নি দেশের। আগে আপনার পরিবার গাড়ি চালাতো একটি এখন সেই পরিবার গাড়ি চালাচ্ছে তিনটি। এই আর্থিক স্বচ্ছলতা কে এনে দিয়েছে, একমাত্র আওয়ামীলীগ।
পুরো সংবাদ সম্মেলন বিশ্লেষণ না করে এই কথাগুলির উপর সাংবাদিক ভাইদের প্রশ্নের পরিপূর্ণতা এনে দিতে চাই আমি। একজন সামান্য সংবাদ কর্মী হিসেবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ এখন নি¤œ আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে। দারিদ্রতাও কমে আসছে কিন্তু গরিবের কি উন্নতি হচ্ছে..? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে এখনও এরকম অনেক পরিবার আছে যারা সরকারি টেলিভিশন বিটিভি তো দূরের কথা যাদের ঘরে একটি টিভি পর্যন্ত নেই। কেনো তারা আর্থিক দিক দিয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছে না..? তাহলে কিভাবে তাদের কাছে সেই সচেতনতামূলক ভিডিও চিত্রটি পৌছাবেন..? আপনি বললেন সব বেসরকারি টিভি চ্যানেল আপনার দেয়া, তাহলে আপনি ক্ষমতায় আসার পর কেন দিগন্ত টেলিভিশন, চ্যানেল ওয়ান, ইসলামী টিভি বন্ধ করে দেয়া হলো। শুধুমাত্র এই গণমাধ্যমগুলো নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে একনিষ্ঠ ছিলো বলে তাদেও সম্প্রচার আজ বন্ধ। আমার দেশ পত্রিকাটিও আজ এই একই কারণে বন্ধ হয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল পত্র-পত্রিকা ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে কথা বলতে অনেক থমকে যায়। বাংলাদেশের শীর্ষ স্থানীয় জাতীয় পত্রিকা প্রথম আলো গত ৪ই মে (“জাফর ইকবালের উপর হামলা: আ.লীগ নেতা আটক”) হেডলাইন নামক নিউজটি যখন তাদের অনলাইন থেকে কেঁটে দেয় তখনই সাংবাদিক এবং সংবাদপত্র নিরপেক্ষ, সাহসী, সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল, মানুষের আস্থা এই কথাগুলো কেন জানি মন আর মানতে চায় না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার কথামতো যে পরিবার আগে একটি গাড়ি চালাতো সেটি এখন তিনটি চালাচ্ছে কিন্তু কিভাবে..? এই পরিবারগুলি আপনি এবং এই আওয়ামী লীগ সরকারের সিস্টেমের সাথে জড়িত যারা এই দেশের গরিব পরিবারকে চুষে তাদের আরাম আয়েশের মূল উৎস করে। ঠিক যখনই গরিব পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা দেখা দিচ্ছিল তারা যখন টিভি কিনতে যাচ্ছিল তখনই আপনার কথায় যারা একটি গাড়ি থেকে তিনটি করেছে তারা গরিব পরিবারকে চুষে তিনটি গাড়িতে পরিণত করে এবং তখনই সেই গরিব পরিবারটি আশা করেছিলো একটি টিভি সেটিও কেনা হয় না এমনকি তাদের আর সেই সচেতনমূলক ভিডিও চিত্রটি টিভিতে দেখা হয় না। সেই গরিব পরিবারের কোনো এক সদস্য যখন দুর্দশাগ্রস্ত জীবন থেকে উত্তরণ পাওয়ার চিন্তায় রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলো তখনই তার মৃত্যু হয় একজন সাধারণ পথচারী হয়ে। গরিব দিন দিন কেন আরো গরিব হয়ে যাচ্ছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী..?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার কথামতো শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া’র আমলে দেশের অবস্থা করুণ ছিলো। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার প্রশ্ন এই জায়গায় যদি আপনার কথা এই হয় তাহলে বাংলাদেশের প্রথম শাসক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাহলে উনার সময় কি দেশ সোনায় সোহাগা ছিলো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিভাবে আপনার বুদ্ধিমত্তা লোপ পায় একজন প্রধানমন্ত্রী হয়েও। আপনি হয়তো ভুলে গেছেন, স্মরণ করিয়ে দেই আপনাকে, আপনি এখন নতুন যুগে পা দিয়েছেন কিন্তু আগে নতুন যুগ ছিলো না। তারপরও যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ কখনোই চলেনি। শ্রদ্ধেয় শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের হৃদয়ের মণিমুক্তা ছিলেন কিন্তু তিনি সেটি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেননি কেন..? কারণ ছিলো সংবাদপত্র বন্ধ, চাল ২৫ পয়সা থেকে ১ টাকা, বাকশাল প্রতিষ্ঠা। যার কারণে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিলো। এর পর থেকে যারা দেশ পরিচালনা করেছেন তারা দেশকে এরকম একটি পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ দিতে অনেক কষ্ট হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
সাংবাদিক, সংবাদপত্র এবং মিডিয়ার ভূমিকা সবাই নিরপেক্ষ চায়। কিন্তু সেদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে তাদের ভূমিকা ছিল ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের মতো।
আমার ঘনিষ্ঠ একজন মানুষ আমাকে একদিন একটি কথা বলছিলেন, “কচুর উপর বিল্ডিং তোলা”। এই বাক্যের প্রাসঙ্গিক রূপই ছিলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন।
মো.নাঈমুল ইসলাম
ছাত্র ব্যক্তিত্ব লেখক, সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সংগঠক।
Sharing is caring!