মো. আবুল কাশেম, বিশ্বনাথ :: সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার অলংকারী ইউনিয়নের রহিমপুর পূর্বপাড়া (রামপুর) গ্রামের ফারুক মিয়ার পুত্র রুবেল আহমদ (২৫)। ৪ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে সে সবার বড়। অভাবে সংসার হওয়ায় ছোট বোন-ভাইদের পড়ালেখার খরচ চালাতে ও পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষন করতে স্বপ্ন ছিলো বিদেশ যাওয়ার। সেই স্বপ্ন পুরণ করতে সে আত্মীয়-স্বজনদের সহযোগীতায় সিদ্ধান্ত নেয় মধ্যপ্রচ্যের একটি দেশে যাওয়া।
গত ২৯ আগষ্ট বুধবার সকালে বাড়ি থেকে বিদেশের উদ্দেশ্যে তার যাত্রা করার কথা ছিলো। কিন্ত একটি অগ্নিকান্ডের ঘটনা কেড়ে নিয়েছে রাজুর সব স্বপ্ন। হারাতে হয়েছে গর্ভধারিনী মাকে। হাসপাতালের বেডে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তার বাবা, আদরের ছোট বোন ও ভাইয়েরা। সব কিছু মিলিয়ে এখন দিশেহারা রাজু।
রাজু আহমদ জানান, গত ২৮ আগষ্ট দিবাগত রাতে পরিবারের সকল সদস্যদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে নিজ সবত ঘরের সমানের একটি মাটির টিনসেট ঘরে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। আর দালান সবত ঘরের একটি রুমে ঘুমিয়ে পড়েন পরিবারের অন্য সদস্যরা। সবতঘরে তাদের থাকার মাত্র একটি রুম থাকায় ওই রুমের মধ্যে রাজুর মা-বাবা, বোন ও ৩ ভাই ঘুমান। ওই দিন রাত আনুমানিক প্রায় ২টার দিকে রাজুর মা চম্পা বেগম তার ছোট পুত্র নিজাম উদ্দিন প্রস্রাব করতে চাইলে তাকে তিনি (চম্পা) ঘরের বাহিরে নিয়ে প্রস্রাব করান। এরপর তিনি ঘরে ফিরে আসার কিছু সময় পর (জাগ্রত অবস্থায়) দেখতে পান ঘরের সামনের ষ্টীলের দরজার নীচ দিকের ভাঙ্গা ছিদ্র দিয়ে কেউ একজন বাহির থেকে ঘরের ভিতরে আগুণের মতো কিছু নিক্ষেপ করছে। মহুর্তেই আগুণের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ে ঘরে দরজার পাশে রক্ষিত কাঠের সোফায়। এসময় চম্পা বেগম, তার স্বামী ফারুক মিয়া ও তাদের সন্তানরা ঘরের দরজা খুলার চেষ্টা করেন কিন্ত দরজার সামনে আগুণ থাকায় তারা তাতে ব্যার্থ হন। তাদের আত্ম চিৎকারে সবত ঘরের সমানের একটি মাটির ঘরে ঘুমিয়ে থাকা রাজু আহমদ ও আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে দরজা ভেঙ্গে তাদেরকে উদ্ধার করেন।
আগুণে দগ্ধ হন ফারুক মিয়া (৫০), তার স্ত্রী চম্পা বেগম (৪৫), মেয়ে রিফা বেগম ( ১৮), ছেলে এমাদ উদ্দিন (১৪), ইমরান আহমদ (১২) ও নিজাম উদ্দিন (১০)। ঘাটনার পর তাদেরকে গুরুতর আহত অবস্থায় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আহতদের মধ্যে চম্পা বেগম ও তার মেয়ে রিফা বেগমের অবস্থা আশংকাজনক হওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শে তাদেরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য গত বৃহস্পতিবার ঢাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়।
পরবর্তীতে গত শনিবার রাতে অগ্নিদগ্ধ ফারুক মিয়া, তার পুত্র এমাদ উদ্দিন, ইমরান আহমদ ও নিজাম উদ্দিনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজে হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে ভর্তি করা হয়। ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার (২সেপ্টেম্বর) ভোরে মৃত্যুবরণ করেন চম্পা বেগম।
ঘটনার পর অগ্নিদগ্ধ ফারুক মিয়ার সৎ ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী ও পার্শ্ববর্তী বাড়ির বাসিন্দা তাদের ভগ্নিপতি কয়েলের আগুণ থেকে এই অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়েছে বলে আত্মীয়-স্বজন এবং পাড়া-প্রতিবেশী লোকজনকে বলেন। কিন্ত ওই দিন রাতে চম্পা বেগমের স্বজনেরা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখতে পান খাটের নীচে জ্বালানো কয়েলটি পুড়ে ছাইভষ্ম হয়ে একটি টিনের কৌটার উপর এখনও অক্ষত রয়েছে এবং খাট ও বিচানাপত্রে আগুণে পুড়ার কোন চিহৃ নেই। ঘরের ভিতরে দরজার পাশে থাকা একটি কাটের সোফা ছাড়া আর কিছুই আগুণে পুড়েনি। তাছাড়া ওই সোফার উপড়ের অংশ ও ফোম আগুণে পুড়েছে। যদি কয়েল থেকেই আগুণের সূত্রপাত হতো তাহলে সোফার নীচের অংশটা পুড়ে যেত এবং এতো দ্রুত আগুণ বিস্তার করতো না।
তাদের ধারণা কয়েল থেকে আগুণের সূত্রপাত হলে পুড়া কয়েলের গুড়াসহ টিনের কৌটার উপর থাকার কথা নয় এবং যে খাটের নীচে পুড়া কয়েলটি রয়েছে সেই খাট ও বিচানাপত্রে আগুণে পুড়ার কোন চিহৃ নেই। ধারণা করা হচ্ছে স্টীলের দরজার নীচ দিকের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে ঝাড়–র মাধ্যমে কেই অগ্নিসংযোগ করেছে। আর প্রকৃত ঘটনাটি আড়াল করতে মশার কয়েল থেকে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়েছে বলে ঘটনার পর গুজব ছাড়ানো হয়েছে বলে অনেকেই ধারণা করছেন।
পরিবারের সকলকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে কেউ অগ্নিসংযোগ করেছে এমন অভিযোগ করে ক্ষতিগ্রস্থ ফারুক মিয়ার পুত্র রাজু আহমদ বলেন, আমার মা বলেছেন তিনি নিজ চোখে দেখেছেন কেউ ঘরে আগুণ দিচ্ছে। আমি নিশ্চিত আমার পরিবারের সকলকে হত্যার উদ্দেশ্যে এই অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ঘটনাটি সুষ্ট তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের বিচার দাবি করেন রাজু।
এদিকে, ঢাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজে হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে চিকিৎসাধিন অগ্নিদগ্ধ ফারুক মিয়া তার স্ত্রী চম্পা বেগমের মৃত্যুর সংবাদটি শুনতে পেলেও মেয়ে রিফা বেগম, ছেলে এমাদ উদ্দিন, ইমরান আহমদ ও নিজাম উদ্দিন এখনও তারা কেউ জানে না যে তাদের গর্ভধারিনী মা চিরদিনের জন্য এই দুনিয়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন রিফা বেগমের দুই হাত, বুক থেকে সমস্ত মুখ দগ্ধ হওয়ায় তার অবস্থা আশংকাজনক। ফারুক মিয়ার শারিরিক অবস্থা অনেক উন্নতির দিতে থাকলেও তার তিন পুত্র এমাদ উদ্দিন, ইমরান আহমদ ও নিজাম উদ্দিনের শরীরে গুরুত্বর জখম রয়েছে। উন্নত চিকিৎসা না তারা তিন জন পঙ্গু হওয়ার আশংকা রয়েছে।
এদিকে, আহতদের চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। যা এই অসহায় পরিবারের পক্ষে কিছুতেই ব্যয় করা সম্ভব নয়। ঘটনার পরদিন বিশ্বনাথ সহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে মানবিক আবেদন জানিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলে হৃদয়বান ব্যক্তিরা এই অসহায় পরিবারের প্রতি হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে এপর্যন্ত আহতদের চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে।
দেশ-বিদেশের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের রাজু আহমদ বলেন, যারা আমাদের অসহায় পরিবারের পাশে আজ দাঁড়িয়েছেন এবং বিভিন্নভাবে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন আমরা সকলের কাছে চির কৃতজ্ঞ। আমি আমার মাকে হারিয়েছি। আমার বাবা ও ভাই-বোনদের হারাতে চাই না। আমার ভাই-বোনরা বাঁচতে চায়। তাদের চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। যা আমাদের পক্ষে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এজন্য সকলের সহযোগীতা প্রয়োজন।
Sharing is caring!