সিলেট ৩১শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৭শে রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ৪:০৭ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৮
ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : ১৩ বছর পর আদরের সন্তানের মুখটা দেখে আর সইতে পারলেন না আ. সাত্তার। ‘মা- রে’ বলে সজ্ঞা হারিয়ে ফেললেন তিনি।
লোকটা জ্ঞান হারালো ঠিকই, কিন্তু চাঁদপুর পুলিশ সুপারের রুমে তখন বইছে আনন্দের বন্যা। কারও কারও চোখ থেকে গড়িয়ে পড়তে দেখা গেল আনন্দাশ্রু। কি প্রশান্তি! কি তৃপ্তি!
মেয়েটার নাম নার্গিস আক্তার। ৯ বছরের ফুটফুটে সুন্দর একটা বাচ্চা মেয়ে। তাই বাড়ির সবাই আদর করে মনি বলে ডাকে।
দুরন্ত আর উচ্ছল মনির দিনগুলো ভালই কাটছিল বাবা মা’র সাথে। বাবা হত দরিদ্র কৃষক। পেটে ভাত নেই, পরনে কাপড় নেই। অগত্যা প্রতিবেশী স্বজনের দারস্থ হতে হলো তাকে। তারা ধন্যাঢ্য পরিবার। প্রায় সারা বছর ঢাকাতেই থাকেন।
তাদের বাসায় গেলে খাওয়া পরার অভাব হবে না। ধন্যাঢ্য এই পরিবারও আশ্বাস দিল, বাসাই তেমন কাজই নেই। খাবে-দাবে টিভি দেখবে আর মাঝে মাঝে গৃহকত্রীকে সাহায্য করবে। বিনিময়ে মাস গেলে ভাল মাইনে পাবে। স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে সাত্তার ঢাকায় পাঠালো মনিকে।
যাওয়ার সময় বাবার গলা ধরে খুব কেঁদেছিল মনি। মায়ের আঁচলটা জাপটে ধরে ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিদায় নিয়েছিল ঠিকই। মা বলেছিলো সামনের মাসেই দেখা হবে আবার। বিশ্বাসও করেছিল মেয়েটা। কিন্তু তার বিশ্বাস সত্যি হয়নি।
ঢাকার বাসায় আনার পর শুরু হয় অকথ্য নির্যাতন। সইতে না পেরে মাস খানেক পরেই রাতের আধারে পালিয়ে চলে যায় সদরঘাট। ৮/৯ বছরের বাচ্চাকে একা একা ঘুরতে দেখে এগিয়ে আসে এক লোক।
এরপর ওই লোকটি মনিকে নিয়ে যায় উত্তরায় তার চাচির বাসায়। এক মাস পরেই ঢাকা থেকে তার মনিব বাগেরহাটে পাঠিয়ে দেয় তার মেয়ের কাছে। ৮ বছর কাজ করে ওই বাসায়, তবে সেখানেও তার উপর চলে নির্যাতন। আবার পালায় মনি। কিন্তু কোথায় যাবে, কি করবে বুঝতে পারে না।
আবারো অসহায়ের মত ঘুরতে থাকে পথে পথে। এবার আশ্রয় হয় এক কমিশনারের বাড়িতে। কিছুদিন পরেই কমিশনার মনিকে পাঠায় তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে। গ্রামের বাড়ি বাগেরহাট হলেও বর্তমানে ঢাকায় সেটেল্ড। গৃহকত্রী অমায়িক মানুষ। মাঝে মাঝেই গল্প করেন মনির সাথে। সদা উচ্ছল মেয়েটা মাঝে মাঝেই উদাস হয়ে যায়। একদিন কথাচ্ছলে মনি জানায় তার করুন ইতিহাস।
শুনে খুব মায়া হয় তার। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। কেননা মনির ছোট বেলার কথা কিছুই মনে ছিল না। শুধু বলতে পারে চাঁদপুরের দিকে কোথাও হরিনহাটা নামের একটা গ্রামে ছিল তাদের বাড়ি। বাবার নাম আ. সাত্তার।
যাই হোক এইটুকু সম্বল নিয়ে কারও এক যুগ আগের ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায় না। হঠাৎ একদিন গৃহকত্রীর আলাপ হয় চাঁদপুরের পুলিশ সুপার জিহাদুল কবিরের সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে মনির কথা উঠে আসে।
ঘটনাটা দুঃখ প্রকাশ আর সান্তনার মধ্য দিয়েই শেষ হতে পারতো। কিন্তু পুলিশ সুপার বাসায় এসে ঘুমোতে পারেননি। যতবার তার আদরের মেয়ে তাকে বাবা বলে ডেকেছে, ততবারই তার মনে হয়েছে কেউ হয়তো প্রতিক্ষা করছে মনির বাবা ডাক শোনার জন্য। তাই স্থির করলেন খুঁজবেন।
চাঁদপুর মডেল থানার ইন্সপেক্টর মাহবুবকে বিষয়টি দেখার দায়িত্ব দিলে শুরু হয় সন্ধান করার কাজ। কিন্তু ওই এলাকার সাবেক মেম্বার হাসানের সহায়তায় সন্ধান মেলে ১২জন আ. সাত্তারের। তবে দুঃখের বিষয় মনির বাবা সাত্তারের সন্ধান কেউ দিতে পারে না। হাল ছাড়েন না পুলিশ সুপার।
অবশেষে জানা যায়, মূল গ্রাম থেকে বসতি ছেড়ে চর এলাকায় বসতি করেছে এক সাত্তার। এ বছরের ২৬ সেপ্টেম্বার এসপি অফিসে আনা হয় তাকে। কথা শুনে কিছুটা মিল পাওয়া যায়। এরপর একটা ভিডিও কল। এক প্রান্তে পুলিশ সুপার অন্য প্রান্তে মনি।
কথার এক পর্যায়ে ফোনের ক্যামেরা তাক করা হয় সত্তারের দিকে। এরপর স্তব্ধ সবাই। ফোনের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে আসতে চায় দুটি মানুষ। কাঁদতে কাঁদতে একে অপরকে জড়িয়ে ধরতে চায় এক যুগের জমা হওয়া কান্নার জলে। একটুও ভুল হয়নি দু’জনার। এক যুগ ভুলতে দেয়নি পরস্পরের মুখ।
তথ্যসূত্র: পাবনার বেড়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আশীষ বিন হাসানের ফেসবুক থেকে নেয়া
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd