আতিয়া মহল ট্র্যাজেডির দু’বছর : ক্ষতিগ্রস্তরা পায়নি ক্ষতিপূরণ

প্রকাশিত: ৮:৩৩ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৫, ২০১৯

আতিয়া মহল ট্র্যাজেডির দু’বছর : ক্ষতিগ্রস্তরা পায়নি ক্ষতিপূরণ

মো.নাঈমুল ইসলাম :: আতিয়া মহল ট্র্যাজেডির গতকাল ২৪শে মার্চ রবিবার ২বছর পূর্ণ হল। তার উপর একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে এই প্রতিবেদক গতকাল দুপুরে যান আতিয়া মহলে। নির্জন এই মহলে মানুষের বসবাস থাকলেও পরিবেশ যেন ছিল সংকীর্ণ, নিস্তব্দ। তৎকালীন জঙ্গী অভিযান চলাকালীন পুরনো দু’একটি পরিবার থাকলেও অনেক পরিবার ছিল নতুন। ভিতরে প্রবেশ মাত্রই এক বয়স্ক মহিলার সাথে দেখা। অন্যরা বললো, ইনিই ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছেন। উনিও নিজের মুখে স্বীকার করলেন। সাংবাদিক পরিচয়ে একটু ভীত হলেও শুধু এই টুকুই বললেন, আমরা ভালো আছি বলে দরজা বন্ধ করে দেন। গেলাম পাশের রুমে সেখানেও একজন মহিলা বের হলেন। জিজ্ঞেস করলে একই উত্তর আমরা ভালো আছি। আমাদের কোনো সমস্যা হচ্ছেনা। আরেকজন লোক এসে বলল আতিয়া মহলের দুটি অংশ রয়েছে। যেখানে হামলা হয়েছে সেই পিছনের অংশে যান। সেখানে হয়তোবা পুরনো কাউকে পেতে পারেন। যাওয়া হলো পিছনের অংশে সেখানেও একজন মহিলার সাথে দেখা বললেন, আমরা নতুন আমরা কিছুই বলতে পারবনা। উপরে হয়তোবা পুরনো কেউ থাকতে পারে। উপরে উঠে তিন তলায় গেলাম। রুম নম্বর ১২ এর কলিং বেল প্রেস করলাম। একটি ছোট্র শিশু বেরিয়ে আসলো। সাথে তার বাবা। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে আতিয়া মহলের ঘটনার পর আপনারা কেমন আছেন জানতে চাইলে এক লোমহর্ষক বর্ণনার সম্মুখীন হতে হয়। যিনি বেরিয়ে আসলেন মো: শহীদুল ইসলাম (৩২) নামের এই ব্যক্তি আবুল খায়ের কোম্পানীর মার্কস দুধের এসআর হিসেবে চাকরি করছেন। আগে তিনি প্রাণ কোম্পানিতে চাকরি করতেন। উনার স্ত্রী মোছা: শামীমা ইয়াসমিন গোটাটিকরে লেডিস কাপড় এন্ড টেইলার্স এর স্বত্তাধিকারী। জহির তাহির মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণীতে পড়–য়া ছেলে সাকলাইন মোস্তাক (১২) এবং কিশোলয় কিন্ডারগার্টেনে ২য় শ্রেণীতে পড়–য়া মেয়ে ছামিয়া ইসলাম দুটি সন্তান রয়েছে। সম্মানের সহিত উনি বাসায় নিয়ে আমার সম্মুখে বসলেন। একটি প্রশ্নই করেছিলাম ঘটনার আজ দুবছর হলো আপনার কেমন আছেন? উত্তরে তিনি বললেন, যে মিডিয়াগুলোর সাথে পরিচয় হইছে তারা শুধু নিজেরটাই বলে। আমরা যে ক্ষতিগ্রস্ত হলাম এটা কেউ বলেনা। একাত্তর, নিউজ ২৪, এটিএন বাংলা প্রায় সব টিভি চ্যানেলে সাক্ষাতকার দিলাম। তারা শুধু তাদেরটাই প্রচার করে বেড়ায়। আতিয়া মহল এবং আমরা কেমন আছি। আমরা যে ক্ষতিগ্রস্ত হলাম, আমাদের ৫/৬ লক্ষ টাকা ক্ষতি হলো এটা প্রচার করেননা কেন মিডিয়ায়। আমরা জঙ্গি না। কে দিবে আমাদের ক্ষতিপূরণ সরকার নাকি প্রশাসন এটা প্রচার করেননা কেন। শুধু যদি আতিয়া মহল আর আমরা কেমন আছি এটা প্রচার করেন তাহলে কেন আপনাদের সাথে আমরা কথা বলতে যাবো। আপনি অন্য কারোর কাছ থেকে জানেন। অনেক মিনতি করার পর রাজি হন এই প্রতিবেদকের সাথে কথা বলতে। শুরু হলো লোমহর্ষক বর্ণনা। ‘আমরা কি কোনো দোষ করেছিলাম। দোষ করছে তো ওই জঙ্গিরা। আর প্রশাসন এই দুইটা লোক মারতে গিয়ে আমাদের জিনিসপত্র নষ্ট করবে কেন। বিল্ডিংসহ আমাদের বসতঘরের সবকিছু নষ্ট করা হলো। কে দিবে এই ক্ষতিপূরণ। এই ক্ষতিপূরণের দিকটা মিডিয়ায় কেন প্রচার করা হয়না। তারা শুধু তাদের স্বার্থটা দেখে। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের কিছু তো লিখতে হবে। এখানে পুরাতন কেউ নেই শুধু আমরা তিনটি ফ্যামিলি বাদে। সেদিন শুক্রবার ছিল। সকাল ১০টায় ঘুম ভাঙ্গে বমের আওয়াজে। আগেরদিন বৃহস্পতিবার আমি আর আমার স্ত্রী বাজারে যাই। রাত্রে বাজার-টাজার করে বাসায় ফিরলাম আমি আর আমার স্ত্রী। আমরা জানিনা যে রাত্রেই আমরা ঘেরাউ হয়ে গেছি। পরদিন শুক্রবার সকালে যখন বমের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে। বমের আওয়াজ শুনে আমি বারান্দায় দেখার জন্য যাই এবং আমার স্ত্রী আমার ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে নিচে চলে যায়। ওইদিন আমার পরনে হাফপ্যান্ট ছিলো ওদের সাথে নিচে নামতে পারিনি। ভাবলাম ওরা যাক লুঙ্গিটা পড়ে আমিও নিচে চলে যাবো। বের হতেই দেখি ওরা আবার উপরে চলে আসছে। স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, পুলিশ তাদেরকে উপরে পাঠিয়ে দিয়েছে এবং বলছে সবকিছু বন্ধ করে ঘরে বসে থাকার জন্য। শুক্রবার সারাদিন বাসায় বসে থাকলাম। চতুর্দিকে দেখি পুলিশ আর পুলিশ। গুলাগুলি চলছে। পাশের রুমে একটা পালং ছিলো। বাচ্চাদেরকে পালংয়ের নিচে শুইয়ে দিলাম। আমরা সবাই খুব ভয়ে ছিলাম। যেকোনো সময় মারা যাবো এরকমও ভয় ছিলো। যেহেতু ওরা জঙ্গি, যদি মেরে ফেলে। বাড়িওয়ালাকে ফোন দিলাম। বাড়িওয়ালা বললেন, চিন্তা করবেন না আপনাদেরকে উদ্ধার করা হবে। এখানে আজহার ভাই ছিলো এসআই। উপ-পুলিশ কমিশনার বণিকের কার্যালয়ে কাজ করতো। এপাশে ছিলেন দক্ষিণ সুরমা থানার একজন এসআই। আমাদের নিচে একজন এসআই থাকতো। শুক্রবার সারাদিন এভাবে বন্দি অবস্থায় কাটালাম। রান্নাবান্না করবো কিভাবে। রান্নাবান্না করলেও ভয়ে খাবার মুখ দিয়ে যাচ্ছে না। মাইকিং শুনতে পেলাম। মাইকিংয়ে বলা হচ্ছিল শুক্রবার রাতে সোয়াটবাহিনী আমাদেরকে উদ্ধার করবে। মাইকিংয়ে মর্জিনা আর কাউসারকে স্যারেন্ডার করতে বলা হলো। তারা বললো আমরা স্যারেন্ডার করবো না, আপনাদের সাথে কোনো কথা নেই আমরা সোয়াট বাহিনীর সাথে কথা বলবো। তারা স্যারেন্ডার করল না। আমরা টেনশনে ছিলাম। গুলাগুলি দেখে বাচ্চারাও ভয়ে কাঁপছে। রাত ১২টার দিকে অভিযান চালিয়ে আমাদেরকে উদ্ধার করা হবে বলা হলো। আমার পরিচিত কিছু প্রশাসনিক কর্মকর্তাদেরকে ফোন দিলে তারা বলে আপনারা চিন্তা করবেন না আপনাদেরকে উদ্ধার করা হবে। এরপর ১২টা বেজে গেল। অভিযান চলে না। আমি আবার ফোন দিলাম। তারা বললো আজকে আর হবেনা কাল সকালে সেনাবাহিনী আপনাদেরকে উদ্ধার করবে। পরে সকালে ফোন দিলাম। তারা বললো সেনাবাহিনী আপনাদেরকে উদ্ধার করবে। সেনাবাহিনী ৪র্থ তলার লোক সরিয়ে নিয়েছে। ৫ম তলার লোকও সরিয়ে নিয়েছে। এখন আপনাদেরকে উদ্ধার করা হবে। তারা বললো আমরা আপনার দরজার সামনে আসবো এসে টুকা দিবো। আপনি মনে করবেন সেনাবাহিনী। কোনো ভয় নেই। আপনাদেরকে উপরে নিয়ে ৫ম তলা দিয়ে পার করবো ঐ বিল্ডিংয়ে। সেনাবাহিনীর লোক আসলো। আমাদের তথ্য কিন্তু তারা নিয়ে নিয়েছে বাড়িওয়ালার কাছ থেকে। সেনাবাহিনী আসলো, হাত তুলে সবাই বের হলাম। কিছুই নিতে দিলনা। মোবাইলও না। অনেক কান্নাকাটির পর আমারটা শুধু নিয়েছিলাম। আমার বউয়ের ব্যাগে মোবাইল ছিল। সেখানে ২০ হাজার টাকা ছিল। সোনার গয়না ছিল। পরে সেনাবাহিনী আমাদেরকে উদ্ধার করলো। উদ্ধার করে ঐ বিল্ডিংয়ে আমাদেরকে নিয়ে গেল। উপর দিয়ে মই সেট করে আমাদেরকে ঐ বিল্ডিং দিয়ে পার করে নিচে নেয়া হলো। সকাল ১০টার দিকে। বাহিরে নেয়ার পর সারাদিন আমাদেরকে সেখানে দাড় করিয়ে রাখলো। সারাদিন দাড়ানোর পর রাত ১০টার দিকে বললো আপনার চলে যান, কারো বাসায় থাকেন। আমরা বললাম, আমাদের বাসা তো রাজশাহী, কোথায় যাবো। আমরা চাকরি করি ভাড়া থাকি। আমরা এখন কার বাসায় যাবো। কে আছে আমাদের? নজরুল কাউন্সিলর আর বাড়িওয়ালার জিম্মাতে আমাদেরকে ছেড়ে দিল। আমার এক ভাই ছিল পরিচিত সিএনজি নিয়ে আসলে আমরা উনার বাসায় যাই। একরাত সেখানে যাপন করি। পরের দিন সকালে আসলাম। সেনাবাহিনী ডাকলো আমাদেরকে। কারণ আমরা হেযবুত তওহীদ দল করি। হেযবুত তওহীদ সম্পর্কে ডিজিএফআই, সেনাবাহিনী, র‌্যাবের কিছু লোকজন, পুলিশের কিছু লোকজন আমাদেরকে বিভিন্ন প্রশ্ন করলো। আমাদের জেলা আমির থাকতো চার তলায়। উনারে নিয়া একদিকে গেলো আর আমাকে নিয়া আরেকদিকে। তারা মনে করছিল আমরা হেযবুত তওহীদ করি বলে আমরাও জঙ্গির সাথে জড়িত থাকতে পারি। আমাকে নিয়ে বসলো পুলিশ প্রশাসন। যখন কিছুই জানতে পারলো না তখন বললো আপনারা তো আওয়ামী লীগের খাস চামচা। সরকারের দালাল। এই কথা বলে তারা চলে গেলো। আমাদেরকে ছেড়ে দেয়ার পর আমরাও চলে গেলাম। কিন্তু আমরা বের হওয়ার পর ভাবছিলাম আমরা আবার আমাদের বাসায় ফিরবো। ফিরে এসে আমাদের জিনিসপত্র সব ভালো অবস্থায় পাবো। ১৮দিন পরে আমরা ফিরলাম আমাদের বাসায়। আমাদের আসবাবপত্র কিছুই ছিলনা। শুধু আমাদের ফ্রিজটা ছিল। কয়েক’শ গুলি হয়েছে ফ্রিজের গায়েও অনেক গুলির দাগ ছিলো। অন্তত ৮ থেকে ১০টা হবে। একটা স্যুটকেছ ছিল নষ্ট হয়ে গেছে। একটা ওয়্যারড্রব, টেলিভিশন ছিল সব নষ্ট হয়ে গেছে। আমার বাচ্চাদের একটা কম্পিউটার ছিল সেটাও পুরো নষ্ট ছিল। আমার পালংটা তারা শাবল দিয়ে ভাঙ্গলো। বম আছে কিনা জানার জন্য। স্টিল আলমারিতে যা কিছু ছিল সব নিয়ে গেছে। আমার স্ত্রীর ব্যাগে থাকা অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন, ২০হাজার টাকা এমনকি সোনা গহনাও। আমার মোটরসাইকেলটা অগ্নিদগ্ধ ছিল। আমি স্বচক্ষে কোনো জঙ্গি-টঙ্গি দেখিনি। হতে পারে জঙ্গিও ছিল। যেহেতু তাদেরকে বলতে শুনছি আমরা স্যারেন্ডার করবো না। ওরা নাকি জঙ্গি। আমি দেখিনি। তবে তাদের আওয়াজ নিচতলায় একদম লাস্ট থেকে আসছিলো। সব মিলিয়ে টাকা পয়সা, আসবাবপত্রসহ আমি প্রশাসনের কাছে সাহায্য চেয়ে দরখাস্তের মাধ্যমে হিসেব দিয়েছিলাম। অ্যাকচুয়েল হিসাব ৩ থেকে ৪ লক্ষ টাকার মালামাল আমার নষ্ট হয়েছে। এজন্য আমি বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, সমাজকল্যাণ অফিস, ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে দরখাস্ত পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু সুরাহা পাইনি এখন পর্যন্ত। আমার যে ক্ষতিপূরণ হল আমার তো কোনো দোষ ছিলনা। এই ক্ষতিপূরণ কে দিবে সরকার না প্রশাসন।’ বাবার সেই ছোট্র মেয়েটি কোমল কন্ঠে বললো, ‘বমের শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল যেন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আব্বু-আম্মুর সাথে এসে দেখি আমার পুতুল, খেলনা সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে। আমার কম্পিউটারও।’ সাক্ষাতকার নেয়ার সময় শহীদুল ইসলামের ছেলে সাকলাইন স্কুলে এবং স্ত্রী শামীমা ইয়াসমিন নিজ দোকানে ছিলেন। উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৪শে মার্চ শুরু হয়ে ২৮শে মার্চ ৫ দিন পর্যন্ত শিববাড়ির আতিয়া মহলে জঙ্গিবিরোধী অভিযান চলে। প্রথমে আতিয়া মহল এসএমপি পুলিশ ঘেরাও করলেও পরে ঢাকা থেকে আসে সিআইডির বিশেষ বাহিনী ‘সোয়াট’ দল। কিন্তু চূড়ান্ত অভিযানে অংশ নেয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা। সেনা সদস্যরা সেই অভিযানের নাম দেয় ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’। অভিযান শেষে আতিয়া মহল থেকে চার জঙ্গির লাশ উদ্ধার করা হয়। কমান্ডোদের অভিযান চলাকালেই আতিয়া মহলের পাশেই একটি সড়কে দুই দফা বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন সাতজন। আতিয়া মহলের এই সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় মামলা এখনোও তদন্তে রয়েছে বলে জানা যায়। তবে নিহত মর্জিনার বোন আর্জিনা এবং তার স্বামীসহ তিনজন আটক রয়েছেন।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..