সিলেট ৩০শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৭শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ১১:১৩ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৩১, ২০১৯
ওটি বয় হিসেবে মাঝে মধ্যেই সুযোগ হতো চিকিৎসকের সঙ্গে অপারেশনে সহযোগিতা করার৷ দীর্ঘদিন এই কাজ করে একসময় নিজেই বনে যান সার্জন৷ গ্রামে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে রোগী দেখা, অপারেশন করা—সবই শুরু করেন৷ দালালচক্রের মাধ্যমে ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকেন৷ গণমাধ্যমের কল্যাণে বিষয়টি জানাজানি হলে প্রশাসনের অভিযানে থমকে দাঁড়ায় তার অপকর্ম। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে দফারফা করেন চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার ওমর ফারুক৷ আর প্রতারণার পথে বাধা-প্রতিবন্ধকতা স্থায়ীভাবে মুছে দিতে ভারত থেকে নিয়ে আসেন ভুয়া এমবিবিএস সনদ। এবং সেই সনদের ভিত্তিতে কৌশলে বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) রেজিস্ট্রেশনও সংগ্রহ করেন তিনি৷
সর্বরোগের বিশেষজ্ঞ
সূ্ত্রে জানা গেছে, ওমর ফারুক শেখ ডাক্তার পরিচয়ে প্র্যাক্টিস করেন নারায়নপুর বাজারে নিজের প্রতিষ্ঠিত বায়েজীদ মেমোরিয়াল হাসপাতালে৷ মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি, অর্থোপেডিক্স, হৃদরোগসহ সব রোগের চিকিৎসা দেন৷ নিজেই রোগীকে অচেতন করে করেন টনসিল, এপেন্ডিক্স, সিজার ও জরায়ুর জটিল সব অপারেশন৷
ব্যবসা ভালোভাবে জমে উঠায় নিজে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে গ্রামে গ্রামে দালাল নিয়োগ করেন। আর তাদের সহযোগিতায় প্রায় দেড়যুগ ধরে এ অপচিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি৷
বারবার হাসপাতালের নাম পরিবর্তন
অপারেশন করতে গিয়ে হাতুড়ে এ ডাক্তারের কাছে বিভিন্ন সময় রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। তবে স্থানীয় প্রভাবশালীদের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করে বারবারই পার পেয়ে যান তিনি৷ প্রতারণা অব্যাহত রাখার সুবিধার্থে করেন হাসপাতালের নাম পরিবর্তন৷ শুরুতে ‘পল্লী মঙ্গল হাসপাতাল’ নামে শুরু করেন, যা পরবর্তীতে পাল্টে রাখেন ‘স্কয়ার হাসপাতাল’ এবং সবশেষ ‘বায়েজীদ মেমোরিয়াল হাসপাতাল’৷ এছাড়াও মতলব, কচুয়া ও সাচারের বেশ কিছু ক্লিনিকে তিনি অনকলে অপারেশন করেন৷
বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন নম্বরে অসঙ্গতি
এলাকার লোকজনের কাছে ওমর ফারুক ভুয়া ডাক্তার হিসেবে পরিচিত৷ তিনি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখা করেছেন এমন কোনো তথ্য তাদের জানা নেই৷ তবে তিনি নিজেকে ডাক্তার দাবি করে কখনও বলেন ২০০৫ সালে আবার কখনও বলেন ২০১১ সালে ভারত থেকে এমবিবিএস পাস করেছেন এবং বিএমডিসি থেকে ৮৪৭৩৩ নম্বর রেজিস্ট্রেশনটি নিয়েছেন৷ কিন্তু তার দাবি যে মিথ্যা তা সহজেই অনুমেয়৷ কারণ বিএমডিসি ৮৪ হাজার সিরিয়ালের রেজিস্ট্রেশন প্রদান করে ২০১৭ সালে, ২০০৫ কিংবা ২০১১ সালে নয়৷
টাকায় ম্যানেজ করেন সব
ওমর ফারুক শেখের এসব দুর্নীতি নিয়ে ২০১২ সাল ও ২০১৪ সালে একাধিক জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়৷ সে সময় জেলা সিভিল সার্জন তাকে নামের সাথে ডাক্তার উপাধি ব্যবহার করতে নিষেধ করলেও তিনি তা মানেননি৷ চালিয়ে গেছেন তার প্র্যাক্টিস৷ অদৃশ্য কারণে তার বিরুদ্ধে কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷ তবে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, তিনি টাকা দিয়ে সবকিছু ম্যানেজ করে চলছেন৷
সবশেষ গত ৭ সেপ্টেম্বরে বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল নিউজ টোয়েন্টিফোর’র টিম আন্ডারকভারে তথ্য-প্রমাণসহ সচিত্র প্রতিবেদন প্রচার করে হয়৷তারা ওমর ফারুক ও বিএমডিসি কতৃপক্ষের মুখোমুখি হন৷ এসময় ওমর ফারুককে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হলে তিনি সেসব প্রশ্নের সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হন৷
ভারতের মেডিকেলের সনদও ভুয়া
বিএমডিসিতে ওমর ফারুক যে কাগজপত্র জমা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন নিয়েছেন তাতে উল্লেখ ছিল তিনি ভারতের মনিপাল একাডেমি অব হায়ার এডুকেশন এর অধীনে কাস্তুবা মেডিকেল কলেজ থেকে ২০১১ সালে এমবিবিএস পাস করেন৷ টিম আন্ডারকভার ভারতে সংশ্লিষ্ট মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সনদের ছবিসহ ই-মেইল করলে কর্তৃপক্ষ জানান, এমন কোন সনদ তারা ওমর ফারুককে প্রদান করেননি৷
টিম আন্ডারকভার বিষয়টি বিএমডিসিকে অবহিত করলে তারা জানান, ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে তাদের কাছে অভিযোগ এসেছে৷ তার ভিত্তিতে এবছরের মার্চ মাসে ওমর ফারুকের সনদপত্র যাচাই বাছাইয়ের জন্য ভারতে সংশ্লিষ্ট মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। তবে এখনো তারা কিছু জানাননি৷ তবে টিম আন্ডারকবারের কাছে মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিরতি ই-মেইলে ওমর ফারুকের সনদ ভুয়া হওয়ার কথা বললে বিএমডিসি জানায়, তাদের কাছে আবারও জানতে চাওয়া হবে৷ তার সনদ ভুয়া প্রমাণিত হলে ওমর ফারুকের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা হবে৷
তবে ৩১ অক্টোবরে মেডিভয়েস এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত প্রায় ২ মাস অতিবাহিত হলেও বিএমডিসির ওয়েব সাইটে ৮৪৭৩৩ নং রেজিস্ট্রশনে ওমর ফারুকের নাম, ঠিকানা ছবিসহ প্রদর্শিত হতে দেখা গেছে৷ এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি তার হাসপাতালে বহাল তবিয়তেই তার প্র্যাক্টিস চালিয়ে যাচ্ছেন৷
বিএমডিসির বক্তব্য
জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ মেডিভয়েসকে বলেন ‘অনেকে ভুয়া রেজিস্ট্রেশন নম্বর নিয়েছে বা কোনোভাবে ম্যানেজ করে প্র্যাকটিস করছে—এতে আমাদের জনগণের সীমাহীন ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। এটা আমরা সমূলে উৎপাটন করতে চাই। এজন্য পুলিশ, র্যাব এবং গণমাধ্যমের সহযোগিতা প্রয়োজন।’
তিনি আরও বলেন, ‘ওই চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশন নম্বর ঠিক কিনা, আমরা তা শনাক্ত করতে পারি। ভুয়া প্রমাণিত হলে আমাদের চাওয়া হচ্ছে, তাকে যেন গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সে যেন কিছু দিন বেরই হতে না পারে। আইনে বিএমডিসিকে মেজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া নাই। আমাদের কাজ হচ্ছে চিহ্নিত করে দেওয়া।’
ওমর ফারুকের রেজিস্ট্রেশন নম্বর বহাল থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএমডিসির ডেপুটি রেজিস্ট্রার ডা. মো. লিয়াকত হোসেন মেডিভয়েসকে বলেন, ‘তার বিষয়ে আমরা তদন্ত চালিয়েছিলাম। নেগেটিভ রিপোর্ট এসেছে। মনি পাল ইন্ডিয়া থেকে সার্টিফিকেট দিয়েছে—এটা ও না। ভুয়া সার্টিফিকেট ছিল, এটা আমরা আগে ধরতে পারিনি। এটা এখন পুরোপুরি পরিষ্কার হয়েছে। আগামী শনিবার (২ নভেম্বর) বিএমডিসির এক্সিকিউটিভ কমিটির মিটিংয়ে এটি একটি এজেন্ডা হিসেবে রাখা হয়েছে। সাধারণত এ ধরনের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে রেজিস্ট্রেশন বাতিলের নোটিস আসে। বাতিল হলে আমাদের আইনজীবীদের মাধ্যমে এফআইআর করার সিদ্ধান্ত দিয়ে দেওয়া হয়। সুতরাং আগামী মিটিংয়ে তার রেজিস্ট্রেশন বাতিলের সিদ্ধান্ত আসবে।’
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd