সিলেট ৩০শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৭শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
প্রকাশিত: ২:৫৯ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২০
ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : সিলেটে ব্যঙ্গের ছাতার মত গড়ে ওঠা হাসপাতাল, ক্লিনিক, চেম্বার ও ডায়োগনিস্টিক সেন্টারগুলোতে অপ্রয়োজনীয় মেডিকেল টেস্ট ও কমিশন ব্যবসা জমজমাট আকার ধারন করেছে। ডাক্তারের কাছে গেলেই সিরিয়াল টেস্ট। পরে দেখা যায় এসব টেস্টের কোন রোগই নেই। প্রাথমিক নিরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় করে প্রয়োজনীয় টেস্ট দেওয়ার কথা থাকলেও ডাক্ততাররা এমনটা না করে টেস্ট দিয়েই রোগ নির্ণয় করেন। আর এতেই তাদের ও তাদের মনোনীত টেস্টসেন্টারগুলো র ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠেছে।
রোগযন্ত্রণায় এমনিতে মানুষ কাতর। তারপর যদি অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করিয়ে পকেট খালি করা হয় তাহলে কেমন লাগে। চরম শত্রুরও যেন কোন রোগ না হয়Ñ এমন কামনাই করেন অনেক রোগী। সম্প্রতি সিলেটের এক হৃদয়রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিসকের টেম্বারে আসেন বুকের ব্যথার এক রোগী। ডাক্তার বেশ কয়েকটি পরীক্ষা লিখে দিয়ে পাঠালেন পাশের একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সেখানে পরীক্ষাগুলো বাবদ খরচ হয় প্রায় পাঁচ হাজার টাকা। পরে রিপোর্ট হাতে নিয়ে ওই ডাক্তারকে দেখানোর পর বলা হলো হার্টের কোনো রোগ নেই। গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট রিখে দিয়ে বিদায় করে দিলেন তাকে।
অপ্রয়োজনীয় টেস্টের এমন অভিযোগ শুধু ওই রোগীরই নয়,সিলেটের সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব হাসপাতাল ক্লিনিক ও চেম্বারে চিকিৎসা নিতে আসা অসংখ্য রোগীর। তারা ডাক্তারদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ তুলে এর প্রতিকার দাবি করছেন। বলছেন ডাক্তারি একটি মানবসেবা মূলক পেশা। অথচ ডাক্তাররা সবার আগে রোগীর স্বার্থের কথা চিন্তনা করে আগে করেন নিজের স্বার্থের চিন্তা। শরীরের কোনো সমস্যা নিয়ে তাদের কাছে গেলেই ধরিয়ে দেন একগাদা টেস্ট। রক্ত, এমআরআই থেকে শুরু করে অনেক কিছু। অথচ ডাক্তাররা কমিশন না নিলে রোগীদের অনেক টাকা বেঁচে যেত। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বাড়তি খরচ জোগাড় করতে গিয়ে ভিটেমাটিও বিক্রি করতে হতো না।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কমিশনের লোভেই কতিপয় ডাক্তার এই অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করাচ্ছেন এবং প্রতিটি টেস্টে ৫০ শতাংশ অর্থাৎ একশ টাকায় ৫০ টাকা কমিশন পকেটস্থ করছেন। তবে প্রয়োজনীয় টেস্ট বাবদও তারা একশ টাকায় ৩০ খেকে ৩৫ টাকা পর্যন্ত কমিশন পাচ্ছেন। অর্থাৎ যতো পরীক্ষা ডাক্তারের ততো লাভ আর মাথায় হাত রোগীদের। বিশেষ করে গরিব ও নিম্নবিত্ত রোগীরা অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করিয়ে রীতিমতো নিঃস্ব। অনেক রোগী ঘটিবাটি বিক্রি করে পথে বসছেন। গ্রাম-শহর সবখানের ডাক্তারদের বিরুদ্ধেই রয়েছে এ অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করানোর অভিযোগ। রক্ত-এমআরআই, সিটিস্ক্যানসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় এভাবে দিনের পর দিন কমিশন নেওয়া হচ্ছে। অপ্রয়োজনে সবথেকে বেশি টেস্ট হচ্ছে রক্তের। ৫০ শতাংশ কমিশনও আসছে রক্ত থেকেই। কারণ রক্তের টেস্ট না করেও রিপোর্ট দেওয়া সম্ভব। আর টেস্টে খরচ না হলে ফির পুরো টাকাই সমানভাগে ভাগাভাগি করা যায়। যেমনÑ দুই হাজার টাকার অপ্রয়োজনীয় রক্তের টেস্টের অর্ধেক অর্থাৎ এক হাজার টাকা ডাক্তারকে দিলেও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাভ। কিছু কমিশনলোভী ডাক্তার যখন প্রাইভেট সেন্টারে রক্তের টেস্ট করাতে পাঠান তখন প্রেসক্রিপশনে টেস্টের ওপর একটি বিশেষ চিহ্ন দিয়ে দেন। যাতে অপ্রয়োজনীয় টেস্ট বুঝতে অসুবিধা না হয় প্রাইভেট ডায়োগনিস্টিক সেন্টারগুলোর। এ চিহ্ন দেখার পর টেকনিশিয়ানরাই নরমাল রিপোর্ট দিয়ে দিচ্ছেন। তবে এই জালিয়াতি হচ্ছে খুবই অখ্যাত প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। রক্তের টেস্টে এমন করা গেলেও এমআরআই, সিটিস্ক্যান পরীক্ষায় তা অসম্ভব। কারণ এসব পরীক্ষায় ফিল্ম দরকার হয় এবং এতদামি এমআরআই ও সিটিস্ক্যান মেশিন কেনার সামর্থ্যও নেই এই অখ্যাত সেন্টারগুলোর। রক্তের পাশাপাশি অযথা এমআরআই পরীক্ষা করাতেও বেশ আগ্রহ দেখা যাচ্ছে অনেক ডাক্তারের। একটি এমআরআই পরীক্ষা প্রাইভেট সেন্টারে করালে ৭ হাজার টাকা ফি। তা থেকে ডাক্তারের কমিশন কমপক্ষে ৩ হাজার টাকা। সরকারি হাসপাতালেও এমআরআই পরীক্ষা ৩ হাজার টাকা। অনেক সময় রোগীরা নিজে থেকেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে চাচ্ছে। এরকম ঘটনা দুয়েকটি। বেশিরভাগ সময় ডাক্তারই অপ্রয়োজনে টেস্ট করাচ্ছেন। তবে ব্যতিক্রম ডাক্তারও আছেন, যারা অপ্রয়োজনে টেস্ট করাতে রাজি নন। তারা বলছেন, প্রতিটি ডাক্তারের উচিত রোগীর সমস্যার কথা ভালো করে শোনা। রোগীর কথা ভালো করে শুনলে অনেক রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই শনাক্ত করা যায় এবং চিকিৎসা দেওয়া যায়। এমনই দুজন খ্যাতিমান ডাক্তারও রয়েছেন সিলেটে। অতীতে সিলেটের নামকরা অনেক ডাক্তার ও মেডিকেল প্রফেসর ছিলেন ছিলেন যারা রোগরি চেহারা দেখে ও কথা শোনেই রোগ নিরীক্ষণ করে নিতে পারতেন। রোগীর লক্ষণ শুনেই অনেক রোগ ধরা যায় এমন মন্তব্য অনেক বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন প্রতিটি ডাক্তারের উচিত প্রথমেই বেশি বেশি টেস্ট না দিয়ে ওষুধ দিয়ে রোগীকে কিছুদিন পর্যবেক্ষণে রাখা। তাতে দেখা যায় কিছুরোগী টেস্ট ছাড়াই সুস্থ হচ্ছে। তবে লক্ষণ জানার পর অনেক ক্ষেত্রেই টেস্ট প্রয়োজন আছে। তবে অবশ্যই অপ্রয়োজনীয় টেস্ট যেন না দেওয়া হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। নাম প্রক্শা না করার শর্তে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এ প্রতিবেদককে এই বিষয়টি সম্পর্কে বলেছেন, রোগীর সমস্যার কথা শুনে এবং সাধারণ যন্ত্র দিয়ে দেখেই অনেক রোগ বোঝা যায়। তাহলে শুধু রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেন? তিনি সব ডাক্তারকেই রোগী দেখার সময় নিজের সর্বোচ্চ মেধা প্রয়োগ করার পরামর্শ দেন।
অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করিয়ে কোনো ডাক্তার কমিশন বা অবৈধ সুবিধা নিলে এবং তার বিরুদ্ধে বিএমডিসিতে ভুক্তভোগীদের কেউ অভিযোগ করলে বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
Sharing is caring!
………………………..
Design and developed by best-bd