‘প্রয়োজন সামাজিক দায়বদ্ধতার সাংবাদিকতা’

প্রকাশিত: ৪:২৮ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৫, ২০২১

‘প্রয়োজন সামাজিক দায়বদ্ধতার সাংবাদিকতা’

সাঈদুর রহমান রিমন :: বিভিন্ন আকারের, হরেক নামের হাজারো পত্রিকা প্রকাশনার দেশ-বাংলাদেশ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অসংখ্য অনলাইন পোর্টাল, টোয়েন্টি ফোর ডট কম, আইপি টিভি লাইফের ছড়াছড়ি। পাশাপাশি আছে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ভিত্তিক গুজব খবরের নানা আয়োজন। বাস্তবেই নানা জৌলুসতা, নিত্য নতুন প্রযুক্তির সংযুক্তি, অর্থ-বিত্ত, প্রভাবে সাংবাদিকতা এখন অভিজাত হয়ে উঠেছে, কিন্তু আসল সাংবাদিকতা হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। শুধু তাই নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতাহীন সাংবাদিকতার কারণে ক্রমেই আমরা বৃহত্তর সমাজ ও জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি। দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীও সাংবাদিকদের সমাজচ্যুত প্রাণী হিসেবে ভাবতে শুরু করছেন। আসলেই কী আমরা বিচ্ছিন্ন দল-উপদলের সদস্য হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছি? সম্ভবত এসব কারণেই ঘন ঘন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হলেও সার্বজনীন কোনো প্রতিবাদ হয় না। আমার ধারনা-বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মানুষ অতি প্রয়োজনে শুধু এগিয়ে আসে এবং কাজ হাসিল করেই সটকে পড়ে, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলে। নিরাপদ দূরত্বে না থেকেই বা করবেটা কী?

ভূয়াদের শেকড় জাতীয় পর্যায়ে
খোদ রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যায়েও যত শ্রেণীর সাংবাদিক আছেন-তাদের বেশিরভাগই তান্ডব সৃষ্টিকারী। ভূয়া সাংবাদিক, ফেসবুক সাংবাদিক, সোর্স সাংবাদিক, দলবাজ সাংবাদিক, টোয়েন্টিফোর ডট কম মার্কার সাংবাদিক- সম্পাদক, আইপি টিভি, ফেসবুক লাইভ সাংবাদিক…আরো কত শত পদ পদবীর সাংবাদিকদের দৌরাত্ম্যে জনজীবন অতিষ্ঠ। জনস্বার্থ, সামাজিক দায়বদ্ধতা, রাষ্ট্রীয় কল্যাণ নিয়ে এসব সাংবাদিকের চিন্তা ভাবনার সুযোগটা কোথায়? দিনরাত উন্মাদের মতো ছোটাছুটির মধ্যেই অবিরাম তাদের ধান্ধাবাজি চালাতে হয়। তাদের যাঁতায় বৃহত্তর সমাজ, প্রশাসন, বুদ্ধিজীবী, সমাজ সংগঠক সবাই পিস্ট হন প্রতিনিয়ত। বুদ্ধিমান, সম্মানীতরা এ শ্রেণী থেকে পালিয়ে থাকাটাই নিরাপদ ভাবে। কে আসল, কে নকল, কে ভূয়া তা নিয়ে যাচাই বাছাই করার মতো পন্ডশ্রম দেয়ার সময় তাদের নেই। তারা মাঝে মধ্যে বিণয়ের সঙ্গে প্রশ্ন তোলেন: র্যাবের হাতে ভূয়া র্যাব ধরা পড়ে, ডিবির হাত থেকে ভূয়া ডিবির গ্রুপও নিস্তার পায় না। কিন্তু ভূয়া সাংবাদিক, সোর্স সাংবাদিক, প্রতারক সাংবাদিক দমনে জাতীয় পর্যায়ের সাংবাদিক সংগঠনগুলোর ভূমিকাটা কি? তবে কী গ্রাম পর্যায়ে চষে বেড়ানো ভূয়াটার শেঁকড়ও জাতীয় পর্যায়ে মজবুত ভাবে প্রোথিত?

‘ওয়ান ম্যান ওয়ান পোর্টাল-প্রত্যেকেই এডিটর’
এ তো গেল সাংবাদিকদের ব্যাপার! এবার সংবাদপত্রের বিষয়ও একটু ভেবে দেখা যেতে পারে। দেশে মূলত: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গণমাধ্যম ও প্রচার মাধ্যম- এই তিন ধরনের সংবাদ সরবরাহকারী মাধ্যম দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এরমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব এবং যার যেমন খুশি তেমনভাবে তৈরি করা টোয়েন্টিফোর ডট কম যুক্ত রঙ বেরঙের কথিত নিউজ পোর্টালগুলো রীতিমত ভয়ঙ্কর রুপে আবির্ভূত হয়েছে। এ ক্ষেত্রটিতে যেন ইরি ধানের মতোই বিপ্লব ঘটে চলেছে। ‘ওয়ান ম্যান ওয়ান পোর্টাল-প্রত্যেকেই এডিটর’ এমন স্লোগানকে আদর্শ বানিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়াড় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কেন্দ্রিক নিউজ পোর্টালগুলো সবার কাছেই আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলোতে সকালে একজনের সম্মান ক্ষুন্ন করা হয়তো দুপুরেই অন্যজনের সম্ভ্রমহানি ঘটানো হয়, আবার সন্ধ্যা না পেরোতেই চিহ্নিত সিঁধেল চোরাকে বানিয়ে দেয়া হয় সাদা মনের মানুষ। কোনো কোনো পোর্টাল প্রতিষ্ঠাতা প্রতিদিন তার রাজনৈতিক বক্তৃতা দিয়ে প্রধান স্টোরি বানালেও তার স্ত্রী তুলে ধরেন নিজের বিউটি পার্লারের হরেক গুণাগুণের কাহিনী। অন্যদিকে কলেজ পড়ুয়া মেয়েটির নতুন প্রেমে পড়ার ধকলযুক্ত ছড়া-কবিতায় আধা পাতা পূর্ণ করা হয়। আর ফেসবুক স্ট্যাটাসের নামে যেসব জঘণ্য মূর্খতার ছড়াছড়ি চলে তা দেখলেই ঘৃণায় শরীর রি রি করে উঠে।

গণমাধ্যম না কি প্রচারমাধ্যম?
এছাড়া বাজারে চলমান পত্রিকা ও দর্শকদের কাছে উপস্থাপন করা বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো দেখে শুনে বারবারই পাঠক, দর্শক- শ্রোতারা হকচকিয়ে উঠেন। কোনটা যে প্রচার মাধ্যম আর কোনটা যে গণমাধ্যম তা বুঝে ওঠাও কষ্টকর। তবে ধনপতি কারখানা মালিকদের স্বার্থবিরোধী কোনো কর্মকান্ড ঘটলেই তাদের প্রতিষ্ঠিত মিডিয়াগুলো যে কী ধরনের ‘প্রচার মাধ্যম’ তা টের পাওয়া যায়। রাজনীতিবিদ এবং সরকারগুলো বরাবরই যেমন জনগণের দোহাই দিয়ে গণবিরোধী অপকর্ম চালিয়ে থাকে-তার চেয়েও জঘণ্যতায় চলে গণমাধ্যম নামের প্রচার মাধ্যমগুলো। মনে রাখা দরকার প্রচার মাধ্যমের লিফলেট আর ভিডিওগুলোতে গণমানুষের ঠাঁই নেই- সেখানে থাকে নিজের ও সমমনা কারখানাসহ ব্যবসা বাণিজ্যের ‘বিজ্ঞাপনী নিউজ।’ অথচ সাধারণ জনগণের কথা লিখতে গিয়ে প্রকৃত গণমাধ্যম নানা ধকলে নি:স্ব হয়, তালা ঝুলে সদর দরজায়।

আরো কত কী

এখন সামাজিক দায়বদ্ধতাসম্পন্ন সাংবাদিকতা উপহার দেয়ার সময় এসেছে। জাতীয় পর্যায়ে সাংবাদিকতার নানা অবদান রাখার পাশাপাশি সমাজ ও জনগোষ্ঠীর জন্য সরাসরি এর সুফল প্রাপ্তি নিশ্চিত করা জরুরি। এক্ষেত্রে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ধরনকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। শুধু সংবাদ পরিবেশন করেই আমরা দায়িত্ব শেষ বলে ভাবতে চাই না। জনস্বার্থে সহায়তামূলক নানা কার্যক্রম নিয়মিত পরিচালনার লক্ষ্যে সহযোগী সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। প্রবীণ সাংবাদিক, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মি, সাবেক আমলা, জনপ্রতিনিধি, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তান সমন্বয়ে সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলা যেতে পারে। তারা প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরা খবরের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। জনসাধারণের পক্ষে যে কোনো সমস্যা-অনিয়ম-অপরাধ লাঘবে দায়িত্বশীল কর্মকর্তার কাছে আবেদন-নিবেদন, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে সরাসরি দেখা করে সমাধানে উদ্যোগ নিতে উদ্বুদ্ধ করবেন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে উকিল নোটিশ প্রদানসহ আদালতে রীট দাখিল করার ব্যবস্থা নিবেন।

Sharing is caring!

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..