সিলেটে টিলা খুঁড়ে পাথর লুট, বাড়ছে ঝুঁকি

প্রকাশিত: ৯:১৫ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৮, ২০২৩

সিলেটে টিলা খুঁড়ে পাথর লুট, বাড়ছে ঝুঁকি

ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : সিলেটের সীমান্তবর্তী জৈন্তাপুর উপজেলার টিলা ও পাহাড় থেকে গর্ত খুঁড়ে প্রতিনিয়ত পাথর উত্তোলনের কারণে বাড়ছে ভূমিধসের ঝুঁকি; সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে সৌন্দর্য হারাচ্ছে পর্যটন এলাকাটি।

পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, ‘প্রভাবশালী গোষ্ঠী’ আইন অমান্য করে টিলায় বড় বড় গর্ত খুঁড়ে শ্রমিক দিয়ে পাথর উত্তোলনের কাজ করাচ্ছে। আবার অনেকে টিলার দখল নিয়ে বসতবাড়ি গড়ে পাথর উত্তোলন করছেন।

স্থানীয় প্রশাসন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় টিলা ও পাহাড় কাটা বন্ধে মাঝে মাঝে অভিযান চালিয়ে জরিমানা করলেও বাস্তবে টিলা খুঁড়ে পাথর উত্তোলনের কাজ বন্ধ হচ্ছে না।

পরিবেশবাদীদের আশঙ্কা, এই অবস্থা চলতে থাকলে একটা সময় টিলাগুলোর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। পরিবেশের ব্যাপারে প্রশাসন এখনও উদাসীন, তাদের যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

সিলেট জেলার টিলাগুলো নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি-বেলা। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, ১৯৫৬ সালে ভূমির মাঠ জরিপের তথ্যে সিলেটের ছয় উপজেলায় ১ হাজার ২৫টি টিলার অস্তিত্ব ছিল। এর বাইরে আরও তিনটি উপজেলায় বেশ কিছু টিলা ছিল। এর মধ্যে জৈন্তাপুরে ৯৮টি টিলা ছিল।

২০০৯ সালে উপজেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্যে জৈন্তাপুরে ৯৮টি টিলার কথা উল্লেখ করা হলেও বেলার ধারণা, জৈন্তাপুরে এরই মধ্যে অনেক টিলা কেটে ফেলা হয়েছে।

বেলার সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা আখতার বলেন, “২০২২ সালের জুলাই ও ২০২৩ সালের মে জৈন্তাপুর উপজেলায় বর্তমানে কী সংখ্যক টিলা আছে বা কী সংখ্যক টিলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার তথ্য উপজেলা প্রশাসনের কাছে চেয়েছিলাম। কিন্তু উপজেলা প্রশাসন তথ্য দেয়নি। এতে ধরা নেওয়া যায়, টিলা সংরক্ষণে উপজেলা প্রশাসনের কোনো মাথাব্যথা নেই।

“উচ্চ আদালতের রায় অমান্য করা হচ্ছে। টিলা কাটা বন্ধে সাইনবোর্ড টাঙানোর কথাও উপজেলা প্রশাসনকে বলা হয়েছিল; তাও বাস্তবায়ন হয়নি।”

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আল-বশিরুল ইসলাম বলেন, “টিলা কাটা বন্ধে উপজেলা প্রশাসন নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। এ ছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তরও অভিযান চালাচ্ছে।”

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ৬ (খ) ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সরকারি বা আধাসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন বা মোচন করতে পারবে না। তবে অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে পাহাড় বা টিলা কাটা যেতে পারে।

পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, এসব টিলার অনেক ক্ষেত্রে শ্রেণি পরিবর্তন; আবার অনেকে টিলাকে ‘টিলা-বাড়ি’ হিসেবে রেকর্ড করেছেন। আইনের এই ফাঁক গলেই টিলা উজাড় করা হচ্ছে।

সরকারি জায়গায় ব্যক্তির পাথর উত্তোলন

সম্প্রতি জৈন্তাপুর উপজেলার নিজপাট ইউনিয়নের গোয়াবাড়ি এলাকা ঘুরে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে বসবাসরত বাসিন্দারা টিলা থেকে পাথর তুলছেন। বেশিরভাগ বাড়ির আশপাশে পাথর উত্তোলনের গর্ত করে রাখা হয়েছে। নারী-পুরুষরা সেই গর্ত খুঁড়ে পাথর উত্তোলন করছেন।

তারা দাবি করেন, এটি তাদের ব্যক্তিগত জায়গা; তা থেকে তারা পাথর তুলে বিক্রি করছেন। তবে উপজেলা প্রশাসন জানিয়েছে, গোয়াবাড়ি এলাকার পুরো টিলাটি সরকারি জায়গায়। সে কারণেই সেখানে সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্প ‘মুজিব পল্লি’ করা হয়েছে।

আব্দুল মতিনের বাড়ির উঠানে বড় বড় গর্ত করা আর তার পাশে বড় বড় পাথর তোলে রাখা হয়েছে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বাড়ির উঠানে পাথরের জন্য হাঁটা যায় না। হাঁটতে গিয়ে পড়ে যায় মানুষজন; তাই পাথর তুলে সামান করা হচ্ছে।”

টিলা খুঁড়ে পাথর তোলার কাজ করছিলেন মারুফ নামের এক যুবক। তার ভাষ্য, টিলাতে ঘর তৈরি করার জন্য ১৬ শতাংশ জায়গা তিনি কিনেছেন। একমাস ধরে টিলা কেটে পাথর বিক্রি করছেন। তিনদিনে একটি ডিআই ট্রাক ভরার মত পাথর তুলতে পারেন। প্রতি ট্রাক পাথর তিন হাজার টাকায় বিক্রি করেন।

কার কাছ থেকে টিলার জায়গা কিনেছেন জানতে চাইলে মারুফ কারও নাম বলতে পারেননি। তখন প্রতিবেশী এক বাসিন্দাকে ডেকে এনে বলেন যে, তার কাছ থেকে তিনি জায়গা কিনেছেন। প্রতিবেশীকে জায়গার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে, তিনিও জায়গার মালিকানার ব্যাপারে কোনো সঠিক তথ্য দিতে পারেননি।

একপর্যায়ে মারুফ স্বীকার করেন, পাথর তোলে জায়গাটি সমান করে এখানে তিনি বাড়ি তৈরি করবেন।

আরেকটু সামনে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় আধা কিলোমিটার লম্বা একটি গর্তে নারী-পুরুষ মিলে মাটি খুঁড়ে পাথর উত্তোলন করছেন। সেখানকার শ্রমিকরা জানান, জায়গার মালিক পাথর তুলতে তাদের কাজে লাগিয়েছেন।

তখন সেখানে থাকা হাবিবুর রহমানের ছেলে মো. হুজুর নামে এক যুবক দাবি করেন, এটি তাদের নিজস্ব জায়গা; আর এ অংশটি তার বোনের। এখনও নিচে পাথর থাকার কারণে কোনো কাজে আসছে না জায়গাটি। তাই পাথর তুলে গাছ লাগানো হচ্ছে। এজন্য পাথর সরিয়ে ফেলা হচ্ছে।”

আরেকটু সামনে এগিয়ে দেখা মেলে সুলতান আহমদ নামে এক যুবকের। তিনি তার ঘরের পাশে টিলার জায়গা কেটে পাথর উত্তোলন করছেন।

তার ভাষ্য, ঘর ঠিক করার জন্য টিলার মাঠি কেটে সমান করছেন; এ সময় পাথর উঠছে। ঘরটি উঁচু-নিচু জায়গায় হওয়ায় মাটি কেটে সমান করছেন।

সুলতান দাবি করেন, তার পরিবার সেলিম নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে জায়গাটি কিনেছেন।

সুলতানের মত নজরুলও তার বাড়ির সামনে গর্ত করে পাথর তুলছেন। তার দাবি, পাথর থাকার কারণে ছোট ছেলেমেয়েরা উঠানে পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছিল; তাই পাথরগুলো তুলে জমা করছেন।

তবে ওই টিলায় থাকা অনেক বাসিন্দা অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের বিষয়ে কোনো কিছু বলতে চাননি। তারা এড়িয়ে চলে যান।

এছাড়া গোয়াবাড়ির করিমের বাগান এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও টিলা কেটে পাথর তুলে স্তূপ করে রাখা হয়েছে।

শ্রমিকদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, তারা দুভাবে কাজ করেন। প্রথমত দৈনিক ভিত্তিতে। প্রতিদিন গড়ে ৫০০ টাকার মত মজুরি পান। দ্বিতীয়ত ট্রাক ভরার চুক্তিতে। এক ট্রাক পাথর ভরে দিলে এক হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত পান শ্রমিকরা। একটি গাড়ি ভরতে ৩০ থেকে ৩৫ ঘনফুট পাথর লাগে।

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার কাছে টিলা খুঁড়ে পাথর উত্তোলনের কথা জানতে চাইলে তারা কোনো কথা বলতে চাননি।

কয়েকজন বলেন, এটি ‘একটি চক্রের’ কাজ। চক্রটি মাঝে-মধ্যে তাদের কার্যক্রম বন্ধ রাখে। তারপর আবার শুরু করে।

এ ছাড়া বন্ধ থাকা শ্রীপুর পাথর কোয়ারি থেকেও ‘কৌশলে’ পাথর লুট করা হচ্ছে বলে তাদের ভাষ্য।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জৈন্তাপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) রিপামনি দেবী বলেন, ছয় মাসে টিলা কাটা বন্ধে গোয়াবাড়ি, কমলাবাড়ি, মোকামবাড়ি, শ্রীপুরসহ আরও কয়েকটি স্থানে ৫০টি বেশি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। অভিযানে দুই লাখ টাকার বেশি জরিমানাও করা হয়েছে। অভিযান চলমান রয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক মোহাম্মদ এমরানের মোবাইলে ফোন করা হলে তিনি কেটে দেন; পরে আর তিনি সাড়া দেননি।

জৈন্তাপুরে টিলা কেটে পাথর উত্তোলনের বিষয়ে জেলা প্রশাসকের বক্তব্য জানতে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

তবে জুলাই মাসে সিলেটের টিলা কাটা বন্ধে প্রশাসনের উদ্যোগ বিষয়ে জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “সিলেটে টিলা কাটা বন্ধে সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী কাজ করা হবে। আইনগত প্রক্রিয়া মেনেই জেলা প্রশাসন পাহাড়-টিলা রক্ষায় কাজ করবে।”

ভূমিধসের আশঙ্কা পরিবেশবাদীদের

এভাবে অবাধে টিলা খুঁড়ে পাথর উত্তোলনের ফলে ভূমিধসের আশঙ্কা বাড়ছে বলে মনে করেন পরিবেশবাদীরা।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, “সিলেটে পরিবেশ-প্রকৃতি রক্ষায় যারা প্রশাসনের দায়িত্বে রয়েছেন তাদের অধিকাংশই দুর্নীতিপরায়ণ। সঠিকভাবে কাজ করলে এমন হওয়ার কথা না। প্রকৃতি ধ্বংসের খেসারত একদিন সিলেট অঞ্চলের মানুষদের দিতে হবে। পর্যটন নগরী সিলেটের পাহাড়-টিলা কেটে চলছে অপরিকল্পিত উন্নয়ন; এসব দেখার কেউ নেই।”

জৈন্তাপুরের আলুবাগান, খরমপুর মোকামেরগুল, রাংপানিনদী, গোয়াবাড়ী এলাকার আদর্শ গুচ্ছগ্রাম পরিদর্শনের সময়ও টিলা খুঁড়ে পাথর উত্তোলনের সত্যতা পাওয়ার কথা বলছেন তারা।

এ ছাড়া সিলেট-তামাবিল আঞ্চলিক মহাসড়কের দুপাশেই গভীর গর্ত করে চলছে পাথর উত্তোলন।

একই সংগঠনের সিলেটের কোষাধ্যক্ষ ছামির মাহমুদ বলেন, “সিলেটের টিলাগুলো নানা কৌশলেই কাটা হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে প্রকৃতি ধ্বংস হয়ে যাবে। পরিবেশবিনাশী কার্যক্রমের কারণেই এরই মধ্যে জলবায়ুতে প্রভাব পড়ছে। কখনো গরম বেশি লাগছে, আবার কখনো ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে; শীতেও গরম অনুভব হয়।” সূত্র- বিডি নিউজ

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..