কুলাউড়ার জনপ্রিয় ৩ নেতা নিজগৃহে পরবাসী

প্রকাশিত: ৯:৫১ অপরাহ্ণ, আগস্ট ৩১, ২০২৩

কুলাউড়ার জনপ্রিয় ৩ নেতা নিজগৃহে পরবাসী

ক্রাইম সিলেট ডেস্ক : মৌলভীবাজার-২ নির্বাচনী আসনে জনপ্রিয় তিন নেতা হলেন বর্তমান এমপি সুলতান মো. মনসুর আহমদ, তিনবারের সাবেক এমপি নওয়াব আলী আব্বাস খান এবং দুবারের সাবেক এমপি এমএম শাহীন। আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তায় এরা একে অপরকে হারিয়ে প্রমাণ করেছেন। ভোটারদের মধ্যে তাদের ঘিরে সবসময় আলোচনা সমালোচনা। এরা তিনজনই এখন নিজ গৃহে পরবাসী।

কে কোন দল থেকে নির্বাচন করছেন? আগামী নির্বাচন নিয়ে তাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং নির্বাচনী ভাবনা নিয়ে ভোটারদের যত কৌতূহল।

মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার ১৩ ইউনিয়ন আর একটি পৌরসভা নিয়ে মৌলভীবাজার-২ নির্বাচনী আসন। ভোটের রাজনীতিতে চমক জাগানিয়া এ আসন। বরাবরই আলোচনায় থাকেন প্রার্থীরা। আগামী ১২তম জাতীয় নির্বাচনের আগেও এ আসন নিয়ে মানুষের আগ্রহের কোনো কমতি নেই। এই আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৮৪ হাজার ৮১৭। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৪৬ হাজার ১৯২ এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৩৮ হাজার ৬২৫। ৯৩টি ভোট কেন্দ্রে এ আসনের ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন।

সুলতান মো. মনসুর আহমদ: ডাকসুর সাবেক ভিপি ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক বর্তমান এমপি সুলতান মো. মনসুর আহমদ। নৌকার সুলতান খ্যাত এই প্রার্থী বিগত ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করেন। সেই সময় বিএনপি জোটের শরিক গণফোরামের প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। যেটি ছিল কুলাউড়ার রাজনীতির ইতিহাসে একটি অকল্পনীয় ঘটনা।

নির্বাচনকালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য ধানের শীষে ভোট চান। ওই সময় তিনি বলেন, মাত্র ২ কোটি টাকার মামলার জন্য একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী কারাগারে আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কোটি কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার করছে। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক। তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা নিজ কানে শুনেছেন। এমন অবাক করা বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা তার জন্য জানপ্রাণ দিয়ে মাঠে কাজ করেন। শেষতক তিনি ৭৯ হাজার ৭৭২ ভোট পেয়ে সাবেক এমপি এমএম শাহীনকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন।

নির্বাচনের পর সুলতান মো. মনসুর আহমদ বলতে শুরু করেন তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করেন। তিনি আওয়ামী লীগ ছেড়ে যাননি। আওয়ামী লীগেই আছেন। কোথাকার এক মেজর স্বাধীনতার ঘোষণা কিভাবে করে? এ দেশে রাজনীতি করতে হলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে মেনে রাজনীতি করতে হবে।

যদিও তার এসব বক্তব্য কুলাউড়ার মানুষের মনে কোনো প্রভাব ফেলেনি; কিন্তু তার কর্মী-সমর্থকরা তিনি মন্ত্রী হচ্ছেন, দলে যোগ দিচ্ছেন এবং সর্বশেষ নৌকা নিয়ে নির্বাচন করবেন বলে মাঠ সরগরম রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেলে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তিনি ৫ বছরে পাঁচবারও কুলাউড়ায় আসেনি। উন্নয়নে কুলাউড়া ছিল সবচেয়ে পিছিয়ে।

এমন অভিযোগ সরাসরি উত্থাপন করেন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও কুলাউড়া উপজেলা চেয়ারম্যান একেএম সফি আহমেদ সলমান। তিনি দলের কোনো পর্যায়ের সদস্য নন। আমরা এখানে দলীয় প্রার্থী চাই।

দলের হাইকমান্ড উনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানান কুলাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ স ম কামরুল ইসলাম।

এসব বিষয় নিয়ে সুলতান মো. মনসুর আহমদ এমপি বলেন, আমি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন চাইব, নৌকা পেলে নির্বাচন করব না হলে নীরব থাকব।

সুলতান মো. মনসুর আহমদ ২০১৮ সালের আগে ১৯৯৬ সালে ১২ জুনের ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে এমপি নির্বাচিত হন। ওয়ান ইলেভেন ইস্যুতে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে নির্বাচনে অংশ নেননি।

নওয়াব আলী আব্বাস খান: ১৯৮৮, ১৯৯১ এবং ২০০৮ সালে তিনি জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে এমপি নির্বাচিত হন অ্যাডভোকেট নওয়াব আলী আব্বাছ খান। এরপর তিনি ২০১৪ সালের ১০ম এবং ২০১৪ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জোটে (জাতীয় পার্টি, কাজী জাফর) যুক্ত হয়ে নির্বাচনে অংশ নেননি। বর্তমানেও আছেন বিএনপি জোটে। লাঙ্গল আর আব্বাছ যেন সমার্থক; কিন্তু বিএনপি জোটে যোগ দেওয়ার পর থেকে তিনি নিজগৃহে পরবাসী।

আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে নওয়াব আলী আব্বাছ জানান, এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে তিনি অংশ নেবেন না। তিনি নির্বাচন নিয়ে মাঠে কাজ করছেন। কেবল অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেই তিনি অংশ নেবেন।

এমএম শাহীন: কুলাউড়ার বিএনপির রাজনীতি যখন সংকটে। তখন প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের হাত ধরে ১৯৯০ সালে কুলাউড়া রাজনীতিতে এমএম শাহীনের যোগদান। অর্থবিত্ত আর চৌকস নেতৃত্বগুণে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে এমপি নির্বাচিত হন। এরপর ১২ জুন ৭ম জাতীয় নির্বাচনে পরাজিত হলেও বিএনপিকে কুলাউড়ায় একটি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যান।

২০০১ সালের নির্বাচনে মনোনয়নবঞ্চিত হন এমএম শাহীন। সেই সময় বিএনপি তথা ৪ দলীয় জোট মনোনয়ন দেয় জামায়াতে ইসলামী তথা ৪ দলীয় জোটের প্রার্থীকে। দলের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান মো. মনসুর আহমদকে পরাজিত করে দেশজুড়ে চমক দেখান। ২০০৫ সালে বিএনপিতে ফের যোগদান করলেও ২০০৮ সালে নির্বাচনে ওয়ান ইলেভেন ইস্যুতে মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন। এক ভোটে দুই এমপি ইস্যু তুলে জোটবদ্ধ হন সুলতান ও আব্বাছ। পরাজিত হলেও এক লাখ ৫ হাজারেরও বেশি ভোট পান শাহীন। এরপর ২০১৪ সালে নির্বাচনে অংশ নেননি তিনি।

২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ফের জমজমাট হয়ে উঠে কুলাউড়ার রাজনৈতিক অঙ্গন। সুলতান মো. মনসুর বিএনপি জোটে গিয়ে ধানের শীষ প্রতীক নিলে বসে থাকেননি এমএম শাহীন। তিনি বিকল্প ধারায় যোগ দিয়ে মহাজোট থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে অংশ নেন নির্বাচনে। সিলেটের জনসভায় মহাজোট নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে নৌকায় তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন। নৌকা প্রতীক নিয়ে এমএম শাহীন ৭৭ হাজার ১৭০ ভোট পান।

নির্বাচনের পর থেকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়ানুষ্ঠানে যোগদানের মাধ্যমে কুলাউড়ায় গণমানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন। গত প্রায় এক বছর থেকে ইউনিয়নে ইউনিয়নে সভা সমাবেশ ও উঠান বৈঠক করছেন। ২০২৩ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তার এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন বলে এমএম শাহীন জানান।

এমএম শাহীন বলেন, কোনো প্রতীকে নির্বাচন করলাম- সেটা বড় কথা নয়। আমি মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করি। আগামী নির্বাচনেও অংশ নেব। ২০০৮ এবং ২০১৮ সালে ‘এক ভোটে দুই এমপি বলে’ এরা (সুলতান- আব্বাছ) জোট বেঁধে কুলাউড়াকে পশ্চাৎমুখী (উন্নয়ন বঞ্চিত) করেছেন। কুলাউড়ার মানুষকে এই সরকারের উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত করেছেন। এমপিও কোনো উন্নয়ন করেননি।

এই ৩ জন ছাড়াও আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেসব সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম লোকমুখে শুনা যাচ্ছে এর মধ্যে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এই তালিকায় যাদের নাম লোকমুখে বেশি আলোচিত হচ্ছে তারা হলেন- প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার-২ আবু জাফর রাজু, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম নাদেল, ২০০৮ সালের নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান শামীম, সাবেক সচিব আব্দুর রউফ ও সাবেক সচিব মিকাইল সিপার, বিএমএর সাবেক সভাপতি ডা. রোকন আহমেদ, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সাদরুল আহমেদ খান, কুলাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক এমপি আব্দুল মতিন, বর্তমান সভাপতি রফিকুল ইসলাম রেনু, কুলাউড়া উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি একেএম সফি আহমদ সলমান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সাংবাদিক কামাল হাসান।

কুলাউড়া উপজেলা বিএনপি থেকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে যারা মাঠে কাজ করছেন তারা হলেন- অ্যাডভোকেট আবেদ রাজা, যুক্তরাজ্য প্রবাসী অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম ও শওকতুল ইসলাম।

জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান শামীম ও যুক্তরাজ্য প্রবাসী রেজাউল হায়দার রাজু প্রমুখ প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

Sharing is caring!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

সর্বশেষ খবর

………………………..