অফুরান রহমত ঝরুক শাবান মাসের মধ্যরাত্রী

প্রকাশিত: ১১:৩২ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৪

অফুরান রহমত ঝরুক শাবান মাসের মধ্যরাত্রী

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
বছর ঘুরে ফিরে এলো পবিত্র শব-ই-বরাত বা লাইলাতুল বরাত। শাবান মাসের মধ্য রাত আজ ১৪ তারিখের দিবাগত রাতকে শবে বরাতের রাত্রী বলে ঘোষণা করা হয়। শব শব্দটি ফার্সি যার অর্থ রাত আর বরাত শব্দের অর্থ ভাগ্য।
বিশেষ এ রাতে মহান আল্লাহ তায়ালা আগামী এক বছরের জন্য মানুষের রিজিক, জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদি বিষয় নির্ধারণসহ তার সৃষ্ট জীবের ওপর অসীম রহমত নাজিল করে থাকেন বলে এ রাতকে শবেবরাত বা ভাগ্যরজনী বলা হয়।
আজ দিনের সূর্য অস্ত গেলেই চরাচর ঘিরে নিবে এক ধর্মীয় উৎসবের আবহ। মসজিদগুলো ভরে উঠবে।
কবি গোলাম মোস্তফার ভাষায়-‘সারা মুসলিম দুনিয়ায় আজি এসেছে নামিয়া ‘শবেবরাত’/রুজি-রোজগার-জান-সালামৎ বণ্টন করা পুণ্য রাত/এসো বাংলার মুসলেমিন/হূতবঞ্চিত নিঃস্ব দীন/ভাগ্য-রজনী এসেছে মোদের, কর মোনাজাত-পাতো দু’হাত/বলো, কথা দাও, সাড়া দাও আজি, জবাব দাও এ প্রার্থনার/যদি নাহি দাও/খাবো না আমরা আজি এ ফিরনী-রুটি তোমার।’
ধর্মচিন্তাবিদদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও উনিশ শতকের শেষের দিক থেকে বাংলাদেশে ঘটা করেই পালিত হয়ে আসছে। একটি মাত্র ‘হাসান’ হাদিসে এটাকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বলা হয়েছে। এই রাতকে লাইলাতুল বরায়াতও বলা হয়।
শবে বরাতের প্রকৃত নাম: এ রাতের নাম হাদীসের ভাষায় লায়লাতুল নিসফ মিন শা’বান বা শা’বানের মধ্য রাত। আমরা এ রাতকে শবে বরাত কিংবা লায়লাতুল বরাত বলে থাকি। কিন্তু কুরআন এবং হাদীসে এ রাতের এ নাম কোথাও আসেনি।
(১) বোখারী শরীফ, (২) সহীহে মুসলিম শরীফ, (৩) সুনানে আবু দাউদ, (৪) সুনানে নাসায়ী, (৫) সুনানে তিরমিযী ও (৬) সুনানে ইবনে মাজাহ। এ ছয় কিতাবের মধ্যে চার কিতাবে লাইলাতুল বরাত সম্পর্কে কোন আলোচনা আসেনি। অর্থাৎ বিশুদ্ধতার দিক হতে প্রথম শ্রেণীর চার গ্রন্থ যথা- বোখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী এসব কিতাবে ১৫ শা’বানের রাত সম্পর্কে কোন বর্ণনা খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ শরীফে এ রাত সম্পর্কে হাদীস উদ্বৃত হয়েছে। হ্যাঁ, ছয় গ্রন্থের বাইরেও হাদীসের অন্যান্য কিছু কিতাবে এ রাতের আলোচনা এসেছে। তম্মধ্যে বিশুদ্ধ একটি কিতাবের নাম হল সহীহ ইবনে হাব্বান। যাতে ইমাম ইবনে হাব্বান বিশুদ্ধ সব হাদীস চয়ন করেছেন। এ কিতাবে এ রাত সম্পর্কে আলোচনা এসেছে। চারজন বিখ্যাত ফেকাহর ইমামদের মধ্যে একজন হচ্ছেন ইমাম আহমদ (রহ.)। তিনি হাদীসের যে গ্রন্থ সঙ্কলন করেছেন তার নাম হল ‘মুসনদ’। সেই কিতাবে এ রাত সম্পর্কে হাদীসে এসেছে। তবে আমরা পূর্বেই বলেছি হাদীসের গ্রন্থসমূহে এ রাতকে কোথাও লাইলাতুল বরাত বলা হয়নি। এ রাত সম্পর্কে নিম্নরূপ শিরোনাম ব্যবহৃত হয়েছে। শাবানের মধ্যরাত সম্পর্কে বর্ণনা। আমাদের সমাজে এ রাতের প্রচলিত নাম হল ‘শবে বরাত’। ‘শব’ শব্দটি হল ফার্সি। অর্থ হল রাত। আর ‘বরাত’ মানে হচ্ছে বন্টন। কাজেই ‘শবে বরাত’ অর্থ দাঁড়ায় বন্টনের রাত। এ নাম জন সাধারনে বহুল প্রচলিত হলেও কুরআন-হাদীসে এ নাম ব্যবহৃত হয়নি।
এ রাতের গুরত্ব ও তাৎপর্য : এ রাতের গুরুত্ব, তাৎপর্য এবং আমাদের করণীয় সম্পর্কে হযরত আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে রয়েছে, হযরত আয়শা (রাযি.) বর্ণনা করেন যে, এক রাতে আল্লাহর রাসুল আমার ঘরে থাকার পালা ছিল, রাতে তিনি আমার সাথে আমার ঘরে শুয়েছেন। হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পর আমি আশে পাশে অনেক খুঁজে দেখলাম যে, আল্লাহর রাসুল (সা.) বিছানায় নেই। আমি সন্দেহ করলাম, কি ব্যাপার, আল্লাহর রাসুল কি আজকে আমাকে ছেড়ে অন্য কোন স্ত্রীর ঘরে চলে গেলেন? আজকের রাততো আমার হক। জেনে রাখা দরকার, যাদের একাধিক স্ত্রী আছে তাঁদের সপ্তাহ কিংবা মাসকে প্রত্যেক স্ত্রীর জন্য বরাদ্দ করতে হয়। যদি দু’জন থাকে, এক মাসকে দু’ভাগে ভাগ করতে হবে। ১৫ দিন এক স্ত্রীর ঘরে, আর ১৫ দিন অন্য স্ত্রীর ঘরে। ১৫ দিন তার ঘরে থাকা তার জন্য ওয়াজিব, থাকতেই হবে। শারীরিক সঙ্গম করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু থাকতে হবে। হযরত আয়েশা (রাযি.) বলেন যে, আজ রাত্রে তো আল্লাহর রাসুল আমার ঘরে থাকার কথা, তিনি কোথায়? তার মনে সন্দেহ জাগল। রাসুলকে খোঁজার জন্য তিনি বের হয়ে গেলেন, বের হয়ে দেখলেন মসজিদে নববীর পাশে জান্নাতুল বাকী কবরস্থান, (যেখানে অসংখ্য সাহাবার কবর আছে) সেখানে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি যিয়ারত করছেন। আল্ল­াহর রাসুল যখন টের পেয়ে গেলেন যে, হযরত আয়শা (রাযি.) এসেছেন তখন তিনি হযরত আয়শার সাথে কথা বললেন, জিজ্ঞাস করলেন-হে আয়েশা: তোমার কি এ মর্মে আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর এবং তার রাসুল তোমার ওপর জুলুম করবেন? তোমার প্রাপ্য হক তিনি নষ্ট করবেন? তুমি কি ভয় করছো? জেনে রাখ আল্লাহ এবং তার রাসুল কারো হক নষ্ট করতে পারে না। কোন মানুষের ওপর জুলুম করতে পারে না। বান্দার হককে নষ্ট করতে পারেনা। তোমার সাথে থাকা তোমার হক। কিন্তু হে আয়েশা, জেনে রাখ, আজকের রাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন রাত। এ রাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রথম আসমানে অবতরন করেন, সূর্য অস্ত যাওয়ার পরেই। অর্থাৎ মাগরিব থেকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রহমত নিয়ে বান্দাদেরকে রহমত দান করার জন্য প্রথম আসমানে আসেন। ফয়জুল কাদীর কিতাবে এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লেখক বলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রহমতের দৃষ্টি বান্দাদের প্রতি নিবদ্ধ করার জন্য তার রহমত তিনি প্রেরন করেন। হে আয়েশা! আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দয়া নিয়ে আজকের এ রাতে প্রথম আসমানে নাজিল হন এবং প্রচুর সংখ্যক মানুষের গোনাহকে তিনি ক্ষমা করেন, লক্ষ লক্ষ মানুষের গোনাহকে তিনি মাফ করেন। হে আয়েশা, এজন্যেই আমি যারা কবরের মধ্যে শুয়ে আছে তাঁদের যিয়ারত করতে গেলাম। তাঁদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। তাদেরকে দেখার জন্য আজকে পবিত্র রাতে আমি এসেছি। তোমার প্রতি জুলুম করে অন্য কোন স্ত্রীর ঘরে আমি যাইনি। এ হাদীস ইমাম তিরমিযী (রহ.) বর্ণনা করেছেন। এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, এ রাত হচ্ছে তাওবার রাত, এ রাত হচ্ছে আল্লাহর কাছে পাওয়ার রাত, চাওয়ার রাত। এ রাত হচ্ছে আল্ল­াহর দরবারে কাঁদার রাত। আল্ল­াহ রাব্বুল আলামীন গোনাহ মাফ করার জন্য প্রস্তুত। আমাকে মাফ চাইতে হবে।
দু’শ্রেণীর লোককে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। শিরককারী: প্রথম ব্যক্তি হল ‘মুশরিক’। তাকে আল্ল­াহ আজ রাতে রহমত দিয়ে আচ্ছাদিত করবেন না। আল্লাহর নামের সাথে শিরক করে, আল্লাহ ইবাদতে শিরক করে, আল্লাহ সিজদার মধ্যে শিরক করে এবং শিরকের যত প্রকার হতে পারে ছোট, বড়, প্রকাশ্য, অপ্রকাশ্য সব ধরনের শিরককারীকে মুশরিক বলা হয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আজকের রাত্রে তাদেরকে ক্ষমা করবেন না। কাজেই অন্তর থেকে শিরক ও যাবতীয় কুসংস্কারকে দূর করতে হবে। আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই। তিনিই আমার সিজদা পাওয়ার উপযুক্ত। আল্লাহই দোয়া শুনবেন। আল্লাহই আমার দোয়া কবুল করবেন। আল্লাহই বান্দাকে রহমত করতে পারেন। রিজিক (জীবনোপকরণ) দেন, শুধুমাত্র আল্লাহই মানুষকে সন্তান দিতে পারেন। এ পূর্ণ বিশ্বাসের নাম হচ্ছে ঈমান, তাওহীদ ও একত্ববাদ। আর এর বিপরীতের নাম শিরক।
দ্বিতীয় ব্যক্তি যার গোনাহ আল্লাহ মাফ করবেন না, যার তাওবা কবুল করবেন না, তাকে রহমত করবেন না, যে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছেদকারী। যাদের সাথে কোন ভাইয়ের সম্পর্ক, বোনের সম্পর্ক নেই, মা-বাবার সাথে খারাপ আচরণ করেছে, অন্যায় করেছে, ফুফুর সাথে সম্পর্ক নেই, খালার সাথে সম্পর্ক নেই, মামার সাথে সম্পর্ক নেই, রক্তের আত্মীয়-স্বজনের সাথে যাদের সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক নষ্ট করেছে, আজকের এ রাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁদের গোনাহকে মাফ করবেন না। তাদের দোয়া কবুল করবেন না। তাদেরকে রহমত করবেন না। কারো ভাইয়ের সাথে যদি সম্পর্ক নষ্ট থাকে, বোনের সাথে যদি সম্পর্ক নষ্ট থাকে, মা-বাবার সাথে যদি কখনো বেয়াদবি হয়ে থাকে, তাহলে এখনই ক্ষমা চেয়ে তার পর আল্লাহর রহমত চাইতে হবে, এর আগে যদি আল্লাহর রহমত চাওয়া হয় আল্লাহ রহমত করবেন না। বিশেষ করে মা-বাবার ব্যাপারেও হাদীসে বিশেষ সতর্ক বাণী উচ্চারিত হয়েছে। অন্য হাদীসে আছে, এ রাতে যারা মা-বাবার সাথে কোন বেয়াদবি করেছে মা-বাবার অন্তরে আঘাত দিয়েছে, কথায় কষ্ট দিয়েছে, কাজে কষ্ট দিয়েছে, সামর্থ থাক সত্তেও মা-বাবার জন্য ব্যয় করেনি, মা-বাবার অসুস্থ থাকা অবস্থায় তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আজকের রাতে তাদেরকে ক্ষমা করবেন না। যাদের মা-বাবা এখন দুনিয়াতে নেই, ক্ষমা চাওয়ার মত উপায় নেই তাদের পরিত্রানের উপায় হল তাদের কবর যিয়ারত করা, তাদের জন্য আল্লাহর দরবারে তাওবা এবং দোয়া করা।
তাওবা কি ও কেন
কুরআনে করীম যদি আপনি পড়ে দেখেন বারবার আপনি পাবেন তওবার কথা। মানে হচ্ছে যারা তওবা করে, আল্লাহর দরবারে ফিরে আসে। হে আমার বান্দা আস ফিরে আস। অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি এ গোনাহ করেছি আর করবো না, (১) এ গোনাহর জন্য আমি অনুতপ্ত, (২) আমি বর্তমানে এ গোনাহকে ছেড়ে দিয়েছি, (৩) আমি ভবিষ্যতে আর এ গোনাহ করবো না। এটিকে বলা হয় তাওবা। এ তিন জিনিস যদি হয় তাহলে এটাই হবে খাঁটি তাওবা। আমি এ পাপ করেছি, আমি সুদ খেয়েছি, আমি ঘুষ খেয়েছি, আমি মিথ্যা বলেছি, আমি এ ধরনের অন্যায় করেছি, হে আল্লাহ এ জন্য আমি অনুতপ্ত, আমি দুঃখিত, আমি লজ্জিত, আমি বর্তমানে আর এ গোনাহ করছি না, হে আল্লাহ ভবিষ্যতে আর এ গোনাহ করব না। এ তিন বস্তু যদি পাওয়া যায় তাহলে আমার ‘তাওবা’ হবে ‘নাসুহা’ পবিত্র, নির্ভেজাল ও খাঁটি। এমন যদি হয়, আমি বলছি, হে আল্লাহ তুমি আমাকে মাফ করে দাও কিন্তু যে গুনাহ করলাম সে গোনাহের জন্য কোন অনুতপ্ত হলাম না, সে গোনাহ এখনো আমি করছি, ভবিষ্যতে ছাড়ার কোন সম্ভাবনা নেই। এভাবে মানুষ যখন তাওবা করে তখন আল্লাহ ক্ষুদ্ধ হন। একজন কবি তার ফার্সি কবিতায় বলেছেন-হে আল্লাহর বান্দা! তুমি আল্লাহর দরবারে তওবার চিন্তা কর? যে গোনাহের জন্য তুমি তওবা করছো সে পাপে তুমি আপাদ মস্তক নিমজ্জিত (আবার তাওবা কর) আল্লাহকে তুমি অসন্তুষ্ট করছো আর পাপ তোমার ‘তাওবা’ দেখে হাসে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ রাতে প্রথম আসমানে নাজিল হয়ে বলেন, তোমাদের মাঝে কি গুনাহ ক্ষমা চাওয়ার আছো? আমার কাছে ক্ষমা চাও। আমি ক্ষমা করে দিব। তোমাদের মাঝে কি কোন বিপদগ্রস্ত নেই? বিপদে আক্রান্ত, পারিবারিক বিপদে আক্রান্ত, চাকরির বিপদে আক্রান্ত, টাকা পয়সার, বিপদে আক্রান্ত, ব্যবসায়ি সবাই আমার কাছে বিপদ থেকে মুক্তি চাও। আমি বিপদ থেকে তোমাকে মুক্ত দেব। কোন বেকার চাকরি নেই, টাকা-পয়সার অভাবে আছে, আমার কাছে রিজক চাও। চাওয়ার মতো করে যদি তুমি চাইতে পার তাহলে আমি তোমার রিজকের ব্যবস্থা করবই করব। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরো ডেকে বলেন, ‘তোমাদের মাঝে কি কোন অসুস্থ নেই? তোমরা রোগ থেকে মুক্তি চাও, আমি রোগ মুক্ত করে দেব। এভাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন একেক বার একেকটি প্রয়োজনের কথা বলে মানুষকে ডাক দেন। আর ক্ষমা করে দেন।
বর্ণিত আছে, এক বুযুর্গ স্বপ্নে শয়তানকে দেখলেন। শয়তান খুবই ব্যস্ত ও চিন্তিত। জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার তুমি এত চিন্তিত? সে বলল আমি আল্লাহর একজন বান্দাকে অনেক কষ্টের মাধ্যমে একটি পাপ করাই, করার পর সে অনুতপ্ত হয়, সে আবার তাওবা করে ফেলে। আমি এক সপ্তাহ চেষ্টা করে তার মাধ্যমে একটি গোনাহ করালাম, তাওবা করার মাধ্যমে সে যেন আমার কোমরে একটি লাথি দেয়। কারণ আমি তার মাধ্যমে যে গোনাহ করালাম তাওবার কারণে সে গোনাহ মাফ হয়ে গেল। এত কষ্ট নিমিষেই সে নষ্ট করে দিল। এ জন্য আমি চাই যে লোকেরা তাওবা না করুক। আসুন, আমরা সবাই আজকের এ রাতে মনকে খুলে কি কি গোনাহ করেছি আল্লাহর দরবারে পেশ করি। মহান রাব্বুল আলামীন সূরায়ে দুখানে বলেন, পুরো বৎসরে একটি রাত আসে যে রাতে তিনি মানুষের জীবন-মৃত্যু, মানুষের রিজিক, মানুষের সম্মান, মানুষের ক্ষমতা, মানুষের সুখ ও দুঃখ, সুস্থতা-অসুস্থতা, সব কিছুর একটি তালিকা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রণয়ন করেন এবং ফেরেশতাদেরকে তা জানিয়ে দেন। মহান রাব্বুল আলামীন, বান্দার সব অবস্থা ফেরেশতাদের কাছে পেশ করেন।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন, আল্লাহর রাসুল বলেছেন, তুমি আশ্চর্য হবে আল্লাহ তাআলার ডায়েরীতে যে নাম লেখা হয়েছে সে ব্যক্তি কিছু দিন পরে মারা যাবে অথচ সে দিব্যি বাজারে আড্ডা দিচ্ছে, হাসছে, বিয়ে করছে বাচ্ছা হচ্ছে, সে জানে না যে, মাত্র কিছু দিন পরেই তার মৃত্যু আসবে। তাকে কবরে ডুকতে হবে। সে জানে না যে, মাত্র কিছু দিন পরেই তার মৃত্যু আসবে। তাকে কবরে ডুকতে হবে। সে জানেনা যে, মৃত্যু তালিকায় তার নাম লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে। আল্লাহ তাআলা এ রাতে সব কিছুর তালিকা প্রনয়ন করবেন।
আমরা এ রাতে ঘরে কিংবা মসজিদে নীরব জায়াগায় আল্লাহ দরবারে কান্নার চেষ্টা করব। কারণ এ রাত হচ্ছে কান্নার রাত, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ রাতে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষকে ক্ষমা করবেন। আর আমি যেন এ লক্ষ মানুষের বাইরে না থাকি। আল্লাহ রহমতের চাদরে যেন আমি অন্তর্ভূক্ত থাকি। চাদরের বাইরে যেন আমার স্থান না হয়। এ জন্য আল্লাহর দরবারে ফুঁপিয়ে কাঁদতে হবে। বুক ফেটে কাঁদতে হবে। যার চোখ দিয়ে এক ফোটা অশ্রু বের হবে একমাত্র আল্লাহকে রাযি করার জন্য, কাউকে দেখানোর জন্য নয়। হাদীসে আছে মশার ডানা পরিমান অর্থাৎ এক কণা চোখ দিয়ে যদি পানি বের হয়ে ঝরে পড়ে যায় তাহলে সে চোখকে কখনো জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না। অর্থাৎ সে লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেবেন। আসুন আমরা কাঁদি আল্লাহর দরবারে কাঁদি, হে আল্লাহ তুমি আমাদেরকে ক্ষমা করে দাও, তুমি যদি মাফ না কর তাহলে মাফের কোন উপায় নেই। হে আল্লাহ তুমি মাবুদ, তুমি রহমান, তুমি রহীম, আমাদেরকে ক্ষমা করে দাও। এভাবে বলব আর কাঁদবো। আল্লাহর কাছে চাইব, নিজেকে ছোট করব, তাওবা করব। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে বার বার বলেন, হে বান্দা তাওবা কর, ক্ষমা চাও, মাফ চাও, দুনিয়ার মানুষ মাফ চাইলে মাফ করতে পারে না, কিন্তু আল্লাহ পাক বলেন, আমি মাফ করে দিতে প্রস্তুত। আমি রাহমানুর রাহীম।
এ রজনিতে অধিক হারে নফল নামায আদায় করার জন্য চেষ্টা করব। দু’রাকাত নফল নামায যদি আল্লাহ তাআলার দরবারে কবুল হয় আমরা জান্নাতে যাওয়ার জন্য সে দু’রাকাআতই যথেষ্ট হয়ে যাবে। বোখারী এবং মুসলিম শরীফের হাদীস-অর্থাৎ এমনভাবে তুমি এবাদত করবে আল্লাহকে যেন তুমি দেখছো। অতটুকু যেতে না পারলেও অন্তত মনে করবে যেন আল্লাহ তোমাকে দেখছেন। আমি আল্লাহ তাআলার দরবারে দাঁড়িয়েছি শুরু থেকে সালাম ফিরানো পর্যন্ত পুরা দু’রাকাআত নামাযে যদি আমার এ মনোভাব থাকে অবশ্যই তিনি আমাদের নামায কবুল করবেন। বৎসরের প্রতি রাতেইতো আমরা ঘুমাচ্ছি। অন্তত কয়েকটি রাত, শা’বানের মধ্য রাত, কদরের রাত এবং দু’ঈদের রাত জাগ্রত থেকে পূর্নরাত এবাদত করে আল্লাহর দরবারে যদি কাটিয়ে দিই তাহলে আমাদের কোন ক্ষতি হবেনা। কাজেই পুরা রাত আমরা এবাদত করার চেষ্টা করব। নামায পড়বো, এরপর সুন্দরভাবে শুদ্ধ করে কুরআন তেলওয়াত করার চেষ্টা করতে করবো। যখন জান্নাতের কথা আসবে ‘জান্নাত’ শব্দ আসবে তখন আল্লাহ তাআলার কাছে ফরিয়াদ করব, হে আল্লাহ, তুমি আমাকে জান্নাতের অধিকারী করে দাও। আর যখন জাহান্নাম শব্দ আসবে তখনও আল্লাহর কাছে বলব, হে আল্লাহ তুমি আমাকে জাহান্নাম হতে পরিত্রাণ দাও। এভাবে কুরআন করীমের তেলাওয়াত করব।
এরপর বেশি করে আল্লাহর নবীর ওপর দুরুদ শরীফ পাঠ করব। একবার যে ব্যক্তি আল্লাহর নবীর ওপর দুরুদ পাঠ করবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার ওপর দশটি রহমত নাজিল করবেন।যে দোয়ার শুরুতে আল্লাহর নবীর ওপর দুরুদ পড়া হয়না আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তা কবুল করেন না। এজন্য দোয়ার শুরুতেও দুরুদ পাঠ করতে হবে এবং শেষেও দুরুদ পাঠ করতে হবে। সংক্ষিপ্ত দুরুদ আছে যেমন- ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’ বা ‘আস-সালাতু ওয়াসসালামু আলা সাইয়িদিল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন’ ছোট বড় দুরুদ শরীফ বেশি করে আমরা পড়ব। এরপর আমরা ‘ইস্তেগফার’ করব।
হে আল্লাহ অনেক গোনাহ করেছি, সে গোনাহ থেকে আমরা ক্ষমা চাই এটাকে বলা হয় ‘ইস্তেগফার’। বার বার করতে থাকব। কারণ এটা তাওবার রাত, গোনাহ মাফ চাওয়ার রাত। এ জন্য দুরুদ এবং ইস্তেগফার বেশি বেশি আদায় করতে হবে। আর রাতে আমরা কবর যিয়ারত করব। একটু আগেই হযরত আয়শা (রাযি.)-এর বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, এ রাতে মহানবী (সা.)-কে জান্নাতুল বাকীতে যিয়ারত করা অবস্থায় তিনি দেখতে পেয়েছেন। কাজেই কবর যিয়ারত করার জন্য আমরা চেষ্টা করব।
দিনে রোযা পালন- ইবনে মাজাহ শরীফের হাদীসে আছে, যখন শাবানের মধ্যরাত আসবে তখন তোমরা আল্লাহর দরবারে দাঁড়িয়ে ইবাদত কর, আল্ল­াহর দরবারে কান্নাকাটি কর, ইবাদতের মাধ্যমে রাতকে জাগ্রত কর। আর দিনের বেলায় রোজা রাখ। শাবান মাসে আল্লাহর রাসুল সবচেয়ে বেশি রোযা রাখতেন, বিশেষ করে মধ্য শাবান ১৫ তারিখের রোজা রাখার কথা হাদীস দ্বারা প্রমানিত। এটাই হল সংক্ষিপ্তভাবে আজকের ইবাদতের নিয়ম।
যারা অসুস্থ কিংবা দুর্বল পুরা রাত এবাদত করার সুযোগ হবেনা, তারা তাড়াতাড়ি শুয়ে ভোর রাতে উঠে যাবে। যাতে তাহজ্জুদ নামায আদায় করা যায়। কারণ তাহাজ্জুদের সময় দোয়া কবুলের উপযুক্ত সময়। বিশেষ করে মধ্য শাবানের এ রাতে তাহাজ্জুদ যেন কারো ছুটে না যায়। রাতে যখন পরিবারের সবাই জাগ্রত থাকবে এ রাতে যদি আমি তাহাজ্জুদ পড়তে না পারি আমার চেয়ে পোড়া কপাল আর কে হতে পারে। এজন্য দুর্ভাগা মানুষের তালিকায় যেন আমার নাম অন্তর্ভূক্ত না হয়। সেহরী খেয়ে ফজরের নামায মসজিদে এসে জামাত আদায় করার চেষ্টা করতে হবে, কারণ হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি এশার নামায এবং ফজরের নামায মসজিদে এসে জামাতের সাথে আদায় করবে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পুরা রাত ইবাদত করার সওয়াব তাঁকে দান করবে। কাজেই এশা এবং ফজরের নামাযকে প্রথম তাকবীরের সাথে আদায় করার চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে কুরান হাদিসের আলোকে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন
লেখক- গবেষক, কলামিস্ট, মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান, পাঠান পাড়া, (খান বাড়ী) কদমতলী, সদর, সিলেট-৩১১১, মোবাঃ ০১৯৬৩৬৭১৯১৭

Sharing is caring!

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

February 2024
S S M T W T F
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
242526272829  

সর্বশেষ খবর

………………………..